রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা: ইউরোপীয় ও ভারতীয় শিল্পের সম্মিলন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২৫ বৈশাখ ১২৬৮—২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ)ছবি: সংগৃহীত

‘রবীন্দ্রনাথ ছবি আঁকেন খাঁটি ইউরোপিয়ান ভঙ্গিতে’, শিল্পী-সমালোচক যামিনী রায়ের কথাটি ধরে আমরা একটু এগিয়ে যেতে পারি। আমরা জানি, যেখানে পশ্চিমা শিল্পী বা সমালোচকেরা চীন-জাপান ছাড়া প্রাচ্যের কোনো শিল্পকে স্বীকৃতি দিতে চান না, সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রকলা অকুণ্ঠ প্রশংসিত হয়েছে। কারণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি নতুন শৈলী সৃষ্টি করেছিলেন। ভারতবর্ষের চিত্রকলার নান্দনিকতায় ও বহুমুখী রেখায় নতুনত্ব এনে আধুনিকতায় নতুন মাত্রা যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ইউরোপে তাঁর চিত্রকলাবিষয়ক আলোচনা হয়েছে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কবিতার কাটাকুটি করতে গিয়ে আঁকা শুরু করলেন চিত্রকলা। প্রায় আড়াই হাজার ছবি এঁকে তিনি এক বিস্ময়কর শিল্পপ্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২৫ বৈশাখ ১২৬৮—২২ শ্রাবণ ১৩৪৮)
ছবি: সংগৃহীত

শিল্পসুষমা ও রং প্রয়োগের ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথ বিস্ময়কর উৎকর্ষে এগিয়ে। এসব কারণেই পশ্চিমারা তাঁর শিল্পকলাকে প্রশংসা করেছে। রবি ঠাকুর পেয়েছেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। নোবেল পুরস্কার লাভের পরে বিশ্বের শিল্প-সাহিত্যের দেশগুলোর সাহিত্য ও শিল্প আন্দোলনের ভাবধারা ও বিকাশ তাঁকে আলোড়িত করে। ইউরোপের রেনেসাঁপ্রসূত বিজ্ঞানচেতনা, মানবতাবাদ, কিউবিজম, ফিউচারিজম, সুররিয়ালিজমের চেতনা চিত্রজগৎকে নাড়া দিয়েছিল। সূচনা হয়েছিল পরাবাস্তবতা। ভ্রমণসূত্রে ১৯১৩ সালেই রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন মাতিস, ভ্যান গঘ, গগ্যাঁ, কানডিনস্কি, তুলুস ল্যোত্রেক প্রভৃতি সাড়াজাগানো মডার্নিস্ট শিল্পীর কাজের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। ১৯২০-এর দশকের গোড়ায় রবীন্দ্রনাথ জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট কাজের সঙ্গেও পরিচিত হন। জাপান ভ্রমণ ছিল তাঁর উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। সে সময়ে চীন-জাপানের চিত্রকর্মের সঙ্গে পরিচিত লাভ করেন। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সহযোগিতায় রবীন্দ্রনাথের ছবির বড় একটি প্রদর্শনী হয়েছিল ১৯৩০ সালে। শিল্পের তীর্থস্থান প্যারিসের গ্যালারি পিগালে। চিত্র প্রদর্শনীতে তাঁর চিত্রকলা প্রশংসিত হয়। প্রখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক ও সমালোচক পল ভ্যালোরি, আদ্রে জিদ প্রমুখ তাঁর চিত্রকর্মের প্রশংসা করে লিখতে থাকেন। পরে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে এ প্রদর্শনী চলে। প্রতিটি প্রদর্শনী সমসাময়িক চিত্রসমালোকদের আকৃষ্ট করেছে।

‘নটীর পূজা’ চলচ্চিত্রে অভিনেতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছবি: সংগৃহীত

জার্মানি ও লন্ডনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রকলা ব্যাপকভাবে প্রশংসা লাভ করে। তিনি সমালোচকদের সুদৃষ্টি লাভ করতে সমর্থ হন। ফ্রান্সে তাঁর আঁকা জীবজন্তু ও প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং জার্মানিতে তাঁর মনুষ্যচেহারার চিত্র বেশি প্রশংসা লাভ করতে থাকে। মস্কোয় তাঁকে একজন মহান চিত্রশিল্পী হিসেবে স্বাগত জানানো হয়। এতে চিত্রশিল্পী হিসেবে কবির আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। পরে যুক্তরাষ্ট্রে চিত্র প্রদর্শনীর সময় তিনি বলেন, তিনি একজন দার্শনিক বা কবি হিসেবে নয়, চিত্রশিল্পী হিসেবেই গিয়েছেন।

আর্জেন্টিনার প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী, সাহিত্য সমালোচক ও লাতিন আমেরিকার নারীবাদী আন্দোলনের নেত্রী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর বাড়িতেই ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ লিখেছিলেন বলে জানা যায়। ওকাম্পো আবিষ্কার করেন চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথকে। ছোট্ট কবিতার খাতায় কবিতার কাটাকুটি ও তা থেকে ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। চিত্রশিল্পী হিসেবে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক। ভারতের আধুনিক চিত্রকলায় তাঁর অবস্থান আলোচনা করা যেতে পারে। অবনীন্দ্রনাথের অবস্থানকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। পথিকৃৎ হিসেবে সোমেন্দ্রনাথ সাহিত্যকেন্দ্রিক চিত্র নির্মাণ করেছেন। তবে আধুনিক চেতনতার আবির্ভাব কিন্তু রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই।

এরপর নন্দনাল বসু, রামকিঙ্কর প্রমুখের হাত ধরে আধুনিক চিত্রকলার পুষ্টিলাভ করেছে। ইউরোপীয় স্টাইল কিছুটা এলেও ভারতীয় মূল চেতনা রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলার প্রধান বৈশিষ্ট্য। এখানে তিনি অনন্য। বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী চিত্রকলায় ক্রমবর্ধমান বৈচিত্র্য ও খোলস বদল করেছেন তিনি। এ ক্ষেত্রে তিনি প্রথার সঙ্গে আটকে থাকেননি। ইউরোপীয় ও ভারতীয় শিল্পের সম্মিলন করে তৈরি করেছেন নতুন বোধ। তিনি হাতের কাছে যা পেতেন, তা-ই দিয়ে ছবি এঁকেছেন। ভাঙা কলম-পেনসিল, বাদ দেওয়া কাগজ নিয়েই তৈরি করেছেন নতুন ছবি। তিনি ব্যবহার করতেন পেলিক্যান কালি। ভারতীয় মিথভিত্তিক এবং মুঘল চিত্রকলার সুদীর্ঘ অচলায়তন ভেঙে রবীন্দ্রনাথ নিজস্ব ঢঙে ছবি আঁকতে শুরু করেন। ভারতবর্ষের চিত্রকলার হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যবোধ থেকে বের হয়ে উপমহাদেশের চিত্রজগতে নতুন এক ধারার সৃষ্টি করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে প্রতিমা ঠাকুর বলেন, তাঁর আঁকার ভঙ্গিটি সম্পূর্ণ নিজস্ব ছিল, তিনি স্বদেশি বা বিদেশি—কোনো অঙ্কনপদ্ধতিই অনুসরণ করতেন না। রবীন্দ্রনাথের ছবি দৃশ্যমান জগতের বাস্তবানুগ অনুকরণ অথবা চেনা শৈল্পিক ফর্মের অনুসরণ নয়। নিসর্গ, নারী-পুরুষ বা পশুপাখি, যা-ই হোক, তা কোনোভাবেই বাস্তবের দাসত্ব করেনি। শুধু পশ্চিমি নয়, প্রাচ্যের চীন-জাপানের শিল্প, পেরু ও উত্তর-পশ্চিম আমেরিকার ‘প্রিমিটিভ আর্ট’-এ মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। শিলাইদহ বা শাহজাদপুরে কবির আঁকা চিত্রকর্ম দেখা যাবে। কলকাতার জোড়াসাঁকো বা শান্তিনিকেতনে এ শিল্পকর্ম লক্ষ করা যাবে। রবির জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে ভারত সরকার কবির চিত্রকর্ম নিয়ে বই প্রকাশ করেছে।

রবীন্দ্রনাথের ছবিকে কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন ১. নর-নারীর মুখের ছবি, ২. জীবজন্তুও প্রতিকৃতি, ৩. প্রকৃতির পটভূমিকায় মানুষের রূপক চিত্র, ৪. আলংকারিক চিত্র, ৫. প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি।

১৯২১ সালে স্ট্রসবার্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২৫ বৈশাখ ১২৬৮—২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ)
ছবি: সংগৃহীত

নারীর চরিত্র সৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ বেশি সফল হয়েছেন বলে মনে করা হয়। তাঁর আঁকা নর-নারীর মুখের ছবিতে যেমন বিশিষ্ট মনের আকৃতি, তেমনি প্রতিকৃতিতে পাওয়া যায়। নিজেরসহ বহু পোর্ট্রেট এঁকেছেন। রবীন্দ্রচিত্রকলায় লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে রেখাচিত্র ও বিভিন্ন রঙের ব্যবহার। খয়েরি রঙের ব্যবহার বেশি করা হয়েছে। তবে সবুজ ও নীল রঙের ব্যবহার নেই বললেই চলে। কালি ও কলমে আঁকা বেশ কিছু ছবি লিনিয়ার রেখায় ফুটে উঠেছে। চিত্রকলায় কবির প্রথাগত বা আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ না থাকলেও তিনি চিত্র অঙ্কনে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ‘পূরবী’ ছবিটি তাঁর আঁকা অন্যতম ছবি। ‘মা ও ছেলে’ শীর্ষক একটি ছবিতে দেখা যায়, মধ্যবয়সী এক মা তার শিশুছেলেকে কোলে নিয়ে আসীন। হালকা বাদামি শাড়ি পরিহিত মায়ের কোলে পরিধেয়বিহীন শিশুর অবস্থান আর মায়ের দৃষ্টি যেন দারিদ্র্যের প্রকাশ। প্রাণীসদৃশ ছবিগুলো তৈরি করেছেন রবীন্দ্রনাথ সেই তাঁর অনুজ্জ্বল রঙের মুনশিয়ানা ব্যবহারে। গাঢ় কালো, বাদামি, লাল আর হলুদাভ রঙে তাঁর ক্যানভাস হয়ে উঠেছে মূর্ত। উজ্জ্বল লাল রং, সাদা-কালো, ধূসর, কালচে বাদামি রঙে নানা বৈচিত্র্যে নারী রবীন্দ্রচিত্রকলার উপজীব্য হয়েছে। ‘নিসর্গ’ শীর্ষক তাঁর কাগজে কালি ও জলরঙে করা ছবিটি অনবদ্য হয়েছে। ঘন আঁধার, গাছপালার মাঝে কুটিরের আভাস আর বন-বনানীর ফাঁকে সাদা আকাশ সত্যিই নিসর্গের মাদকতা প্রকাশ করে।

২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘রবীন্দ্রনাথ টেগোর: হিজ ওয়ার্ল্ড অব আর্ট’ বইটির যৌথ লেখক সুপ্রিয়া রায় ও শিল্প-সমালোচক সুশোভন অধিকারী। ১০টি পরিচ্ছেদে ভাগ করা হয়েছে বইটি। এতে রয়েছে একান্তভাবে ছবির পরিপ্রেক্ষিত হিসেবে রবীন্দ্রজীবনের এক কালানুক্রম। বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে তাঁর পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য ভ্রমণ। রবীন্দ্রনাথের সম্পূর্ণ¤কাজ এখনো প্রকাশিত হয়নি। সব কাজ প্রকাশিত হলে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। হয়তো ভবিষ্যতে অন্যান্য ক্ষেত্রের চেয়ে চিত্রকর রবীন্দ্রনাথই প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠবেন। তাঁর রঙের ব্যবহার, রবীন্দ্রসাহিত্যের সঙ্গে চিত্রকলার সম্পর্ক, ভারতীয় জাতীয়তাবাদী শিল্প-ইতিহাসের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক, রবীন্দ্রনাথের রোমান্স নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। প্যারিসে ছবি প্রদর্শনীর পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাঁর ছবির প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিটি প্রদর্শনী সমসাময়িক চিত্রসমালোকদের আকৃষ্ট করেছে। তাঁকে ভারতীয় হিসেবে উল্লেখ না করে আধুনিক চিত্রশিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ৬৭ বছর বয়সে ছবি আঁকায় মনোনিবেশ করে চিত্রকলায় নিজের নতুন ভুবন তৈরি করেন। এখন তো রীতিমতো রবীন্দ্রচিত্রকলা হিসেবেই পূর্ণতা পেয়েছে। তাঁর ছবিগুলো বর্তমান সময়ের চিত্রগ্রাহক ও বোদ্ধাদের কাছে এক অনন্য আকর্ষণ।

লেখক: আবু আফজাল সালেহ, কবি, চুয়াডাঙ্গা

*নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস: [email protected]