জাঁতাকলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ
বর্তমানে বাংলাদেশে রয়েছে ১০৪টি মেডিকেল কলেজ। আসনসংখ্যা ১১ হাজার ৬৭৩। সামরিক বাহিনীর ৬টি মেডিকেল কলেজ এ হিসাবের বাইরে। সরকারি ৩৭টি মেডিকেল কলেজের আসন ৫ হাজার ৩৮০টি। বেসরকারি ৬৭ মেডিকেলে আসন ৬ হাজার ২৯৩টি। কলেজের সংখ্যার বিচারে বেসরকারি খাত ৬৪ শতাংশ, যেখানে সরকারি খাত ৩৬ শতাংশ। আসন সংখ্যার হিসাবে বেসরকারি খাত ৫৪ শতাংশ, আর সরকারি খাত ৪৬ শতাংশ।
যেখানে বেসরকারি খাত মেডিকেল শিক্ষায় সরকারের চেয়ে বেশি অবদান রাখছে কোনোরকম সরকারি সহায়তা ছাড়াই, সরকারের উচিত ছিল সেই বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করা, সাহায্য–সহযোগিতা করা, প্রয়োজনে প্রণোদনা প্রদান করা। কিন্তু সব সম্ভবের এই দেশে বেসরকারি খাতকে সহযোগিতা না করে সরকারের প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করা হচ্ছে বেসরকারি খাতকে সংকুচিত করার লক্ষ্যে। এর একটি উদাহরণ মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজ/ইউনিট-এ এমবিবিএস/বিডিএস কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তি নীতিমালা-২০২৫। এই নীতিমালার ফলে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ফাঁকা গেছে ২২টি, আর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে আসন খালি রয়েছে ৪৩৭টি। ৪৫৯ জন চিকিৎসক তৈরি থেকে বঞ্চিত হলো দেশ। ৪৫৯ শিক্ষার্থীর স্বপ্নভঙ্গ হলো। ৪৫৯ পরিবার সুযোগ হারাল উন্নতির সম্ভাবনার। অথচ ১ লাখ ৩৫ হাজার ৬৬৪ পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাসকৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬০ হাজার ৪৪৮ জন (৪৫ শতাংশ), আর ভর্তি হয়েছেন ১১ হাজার ২১৪। যেখানে সরকার ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ৬০ হাজার ৪৪৮ জনকে উত্তীর্ণ ঘোষণা করেছে, সেখানে মাত্র ১১ হাজার ২১৪ জন ভর্তি হওয়ার পর ৪৫৯টি আসন খালি থাকার কথা নয়। ভর্তি ইচ্ছুক ও ভর্তি যোগ্য শিক্ষার্থী রয়েছেন, ভর্তির জন্য আসনও রয়েছে, অথচ সংশ্লিষ্টদের কারণে ৪৫৯টি আসন ফাঁকা রেখে জাতীয় ক্ষতি করা হলো।
সরকারের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আসন ফাঁকা থাকার কারণ বর্তমানের মেডিকেল কলেজগুলো যথেষ্ট মানসম্মত নয়, তাই সচেতন শিক্ষার্থীরা মানহীন মেডিকেল কলেজে ভর্তিতে অনীহা প্রকাশ করায় আসন ফাঁকা রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করা যেতে পারে, সরকারি যেসব মেডিকেল কলেজে সর্বমোট ২২টি আসন খালি থেকে গেল, সরকারের ভাষায় মানহীন সেসব মেডিকেল কলেজ সরকার চালাচ্ছে কেন? সরকার (স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর) সংশ্লিষ্ট সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে বেসরকারি মেডিকেলগুলো পরিচালিত হয়ে থাকে। বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো মানহীন হলে তার দায়িত্ব কি এসব তদারককারীর ওপর বর্তায় না? এ ব্যাপারে এসব কর্তৃপক্ষ কী জবাব দেবে?
ভালো চিকিৎসক বানানোর জন্য মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছে কর্তৃপক্ষ। মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভর্তির নিশ্চয়তার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চেষ্টার কোনো ঘাটতি নেই। বিভিন্ন নিয়মনীতি তৈরি করা হচ্ছে যেন সেসব পেরিয়ে শুধু মেধাবীরাই ভর্তির মঞ্জিলে পৌঁছাতে পারেন। কোনোভাবেই যেন কম মেধাবীরা নিয়মনীতির ফাঁক গলে ভর্তি হতে না পারেন। তার জন্য গলদঘর্ম কর্তৃপক্ষ আসন ফাঁকা থাকলেও মোটেও চিন্তিত নয়। মেডিকেল শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানেন বেশি মেধাবীরা কখনো মেডিকেলে ভালো করেন না। মেডিকেলে মেধাবীরা নয় বরং মাঝারি ধরনের কিন্তু লেগে থাকতে পারা শিক্ষার্থীরা ভালো করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজে তো দেশের সবচেয়ে মেধাবীরা ভর্তি হন, তাহলে সেখানে শিক্ষার্থীরা ফেল করেন কেন? বাংলাদেশের বর্তমানে প্রথিতযশা সব চিকিৎসক কি শিক্ষা জীবনে সবচেয়ে মেধাবী ছিলেন? তবে ন্যূনতম মেধা প্রয়োজন ডাক্তারি পড়তে ও পরে সফল পেশাগত জীবনের জন্য। মেডিকেল কলেজে তাই সবাই পড়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হন না। এসএসসি ও এইচএসসি বা সমমান দুটি পরীক্ষায় মোট জিপিএ ৭ থেকে ৯ পয়েন্ট নিয়ে উত্তীর্ণ হতে হবে এবং জীববিজ্ঞানে জিপিএ ৩.৫ থেকে ৪ পয়েন্ট থাকতে হবে, তাহলেই কেবলমাত্র আবেদন করা যাবে। মেধা ছাঁকনির দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে জাতীয় ভর্তি পরীক্ষা, যেখানে ভুল উত্তর প্রদানের জন্য নম্বর কর্তনের ব্যবস্থা রয়েছে। ভর্তি পরীক্ষায় ১০০ নম্বরের মধ্যে ৪০ নম্বর প্রাপ্তি কৃতকার্যতার প্রমাণ।
এভাবে দুই দফা ছাঁকনির পর যে শিক্ষার্থী পাওয়া যায়, তাঁরা মেডিকেলে পড়ার জন্য ও ডাক্তারের পেশাগত জীবন পরিচালনার জন্য যথেষ্ট মেধাবী। তাই কৃতকার্যদের তাঁদের পছন্দমতো মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ দিলে প্রয়োজনীয় মেধার সঙ্গে কোনো সমঝোতা করা হবে না।
এমতাবস্থায় এমবিবিএস/বিডিএস ২০২৫-২৬ ভর্তি নীতিমালাতে সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় ভর্তির পর বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর জন্য ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সব শিক্ষার্থীর জন্য সুযোগ উন্মুক্ত করে দেওয়া যেতে পারে। এতে করে শিক্ষার্থীরা যেমন তাঁদের পছন্দমতো মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবেন, তেমনি মেডিকেল কলেজগুলোয় কোনো আসন শূন্য থাকবে না। এতে করে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো ক্ষতির সম্মুখীন হবে না, ফলে তারা শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষার যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারবে।
*লেখক: অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুস সবুর, সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]