রান্না: শিল্প, প্রকৌশল না অভ্যাস
লকডাউনের কল্যাণে বেশ কিছুদিন নিয়মিত রান্নাবান্না করতে হয়েছে। ভাত, তরকারি, মাছ, মাংস সবকিছুই। জীবনে কখনো রান্না না করা আমি হুট করেই রাঁধুনি হয়ে গেছি। জীবন চলার মতো রান্না, আর সেই সঙ্গে গুরু ইউটিউবের কল্যাণে নানা শখের আইটেম করারও চেষ্টা করেছি। দুটো কারণে এ চেষ্টা। এক. আসলে রান্না করতে খারাপ লাগে না। দুই. সাবলম্বী হওয়ার ইচ্ছা।
এমনিতে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে আমার বিশ্বাস হলো, ‘যাহা সেদ্ধ, তাহাই খাদ্য’ টাইপ। ভালোমন্দ অত বুঝি না, তবে এ অল্প দিন রান্না করতে গিয়ে কিছু জিনিস বুঝতে পারছি, জিনিসটা অতটা সহজ নয়। এখানে প্রতিটা পরতে পরতে বিজ্ঞানের খেলা বা প্র্যাকটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং।
এই যেমন ধরুন, ভাত রান্নার ক্ষেত্রে পানির পরিমাণের একটা চলতি নিয়ম আছে। চালের সারফেস পর্যন্ত হাত ডোবালে মধ্যাঙ্গুলির দুই–তৃতীয়াংশ পর্যন্ত পানি দিয়ে দিলেই হয়। এখন রান্না শুরুর কয়েক দিনের মধ্যেই বুঝে গেলাম এ চলতি নিয়মে কাজ হচ্ছে না। ভাত পুড়ে যাচ্ছে। এবার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যানালাইসিস শুরু। প্রথম কথা হলো, আমাদের পাত্র গতানুগতিক পাতিল থেকে আলাদা। কিছুটা কড়াইয়ের মতো বোল টাইপের। সুতরাং, পাতিলের মুখের চেয়ে আমাদের বোলের মুখের আকার বড়। আর পানি টপ সারফেস থেকে বাষ্পীভূত করে। সারফেস এরিয়া বেশি হওয়ায় পানি তাড়াতাড়ি বাষ্পীভূত হয়, ভাত সেদ্ধ হয় না। বরং পুড়ে যায়, না হয় তলায় লেগে যায়। তাই চলতি নিয়মের চেয়ে বেশি পানি দিয়ে রান্না শুরু করলাম। ট্রায়াল এরর করতে করতে এখন মোটামুটি শেপে চলে আসছে। আসলে সামান্য ভাত রান্না করাতেই চালের গুণাগুণ, পরিমাপ, পাত্রের আকার—এ রকম নানা ভেরিয়েবল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কাজটা এতটা সহজ নয়।
যুগ যুগ ধরে যাঁরা রান্না করেন, তাঁদের এত কিছু জানতে হয় না। যুগ যুগ ধরে মায়েরা এ দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছেন (অন্তত বাংলাদেশের মায়েরা)। ইঞ্জিনিয়ারিং বা সায়েন্স কিছুই বুঝতে হয় না। তাঁরা কীভাবে যেন প্রসেস বের করেই ফেলেন। আর রান্না করেন শ্রেষ্ঠ খাবারগুলো। সেগুলো খেয়ে বেঁচে থাকি, বড় হই, সুখে থাকি।
আবার শখ করে একদিন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই করতে গেলাম। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই কিছুই না শুধু আলুভাজা। কিন্তু সামান্য ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের ধাপে ধাপে ইঞ্জিনিয়ারিং। প্রথমে আলুকে কেটে ধুয়ে হাল্কা সেদ্ধ করতে হবে। তারপর ধীরে ধীরে অ্যামবিয়ান্ট টেম্পারেচারে এনে আবার তেলে হালকা ভেজে নিতে হবে। এরপর ধীরে ধীরে ঠান্ডা করে অ্যামবিয়ান্টের নিচের টেম্পারেচারে নিতে হবে। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ভাষায় এ পদ্ধতিকে বলা হয় অ্যানিলিং। এ পদ্ধতিতে মেটালের ডাকটাইলিটি বা নমনীয়তা বাড়ানো হয়। এখানেও আলুর নমনীয়তা বাড়ে এ পদ্ধতিতে। এরপর ফ্রিজিং টেম্পারেচারে রেখে দিয়ে সেটাকে র্যাপিড কুলিং করা হয়। এই পদ্ধতিকে বলা হয় কোয়েঞ্চিং। এভাবে মেটালে মার্টেন্সাইটের পরিমাণ বাড়িয়ে ব্রিটল বা ভঙ্গুর মেটাল তৈরি হয়। আলুও এভাবে মচমচে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ে পরিণত হয়ে যায়। এই যে পদ্ধতি, এটা ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়া আর কী হতে পারে।
এ রকমই প্রতিটি তরকারি রান্নার ক্ষেত্রে একটা বড় বিষয় হলো তরকারি কাটা। কাটার সময় অবশ্যই চেষ্টা করতে হয়, যাতে সব সবজি প্রায় সমান হয়। এটা হলে আসলে কী হয়? সবগুলোর সারফেস এরিয়া কাছাকাছি হলে সবার তাপ শোষণ কাছাকাছি হয়। ভেতর থেকে যে পানি বের হয়ে আসে, সেটাও সমান জায়গা পায়। ফলে সব সবজি একই সঙ্গে সেদ্ধ হয়ে যায়। বাকি সব ঠিক থাকলে রান্না মজা না হয়ে উপাই নেই!
আবার কিছু সবজি আগে ভেজে রান্না করতে হয়। কিছু জিনিস আগে একটু সেদ্ধ করে নিতে হয়। কিছু সবজি হাইড্রোফোবিক তো কিছু হাইড্রোফিলিক। সবই আসলে ম্যাটেরিয়ালের প্রোপার্টির ওপর। এ রকম হাজার হাজার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাপ্লিকেশন লুকিয়ে থাকে রান্নায়।
যুগ যুগ ধরে যাঁরা রান্না করেন, তাঁদের এত কিছু জানতে হয় না। যুগ যুগ ধরে মায়েরা এ দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছেন (অন্তত বাংলাদেশের মায়েরা)। ইঞ্জিনিয়ারিং বা সায়েন্স কিছুই বুঝতে হয় না। তাঁরা কীভাবে যেন প্রসেস বের করেই ফেলেন। আর রান্না করেন শ্রেষ্ঠ খাবারগুলো। সেগুলো খেয়ে বেঁচে থাকি, বড় হই, সুখে থাকি। শুভকামনা মায়েদের প্রতি।
*লেখক: মো. আতিকুর রহমান শিমুল, প্রকৌশলী (যন্ত্রকৌশল), রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, ঈশ্বরদী, পাবনা