ঈর্ষা মানুষকে ছোট করে
আচ্ছা, আপনি কি ঈর্ষাপরায়ণ? কারও ভালোতে আপনার মন খারাপ হয়? বলতে লজ্জা পাচ্ছেন? মন খুলে বলে ফেলুন। ঈর্ষা একটা সহজাত প্রবৃত্তি। অনেক সময় আমরা না চাইলেও আমাদের মনের ভেতর ঈর্ষা এসে উঁকি দেয়। তখন আমরা ছোট হয়ে যাই। হ্যাঁ, ঈর্ষা মানুষকে ছোট করে, লজ্জিত করে।
আমার এক বন্ধু আছে, সে তো অকপটে স্বীকার করে, অন্যের ভালো দেখলে ওর নাকি খারাপ লাগে, হিংসা হয়। অথচ সে কিন্তু মানুষ হিসেবে খারাপ না। ভীষণ হাসিখুশি, পরোপকারী একটা মেয়ে। কিন্তু জীবনে কিছু অপ্রাপ্তি আছে আমার সেই বন্ধুর। হয়তো এ কারণেই অন্যের ভালো দেখলে ওর মনটা খারাপ হয়ে যায়। বিভিন্ন কারণে মানুষের মধ্যে ঈর্ষার সৃষ্টি হতে পারে।
ছাত্র–ছাত্রীদের মধ্যে হিংসা কাজ করে, কেউ যখন তার চেয়ে ভালো ফল করে। অফিসের কোনো সহকর্মীর পদোন্নতি হলে পাশের টেবিলের কলিগের মন খারাপ হয়ে যায়। এমনকি ভাই–বোনের মধ্যেও জেলাসি কাজ করে, যখন মা–বাবা তার চেয়ে অন্য ভাই বা বোনকে একটু বেশি গুরুত্ব দেয়। মজার ব্যাপার হলো, এক বান্ধবীর ভালো বিয়ে হলে অন্য বান্ধবীরাও কিন্তু হিংসা করে।
একজন প্রতিবেশী একটা ভালো বাড়ি বানালে অথবা দামী আসবাবপত্র করলেও অন্য প্রতিবেশীরা হিংসা করে। এক বন্ধু খুব জনপ্রিয়, সবাই তাকে নিয়ে মাতামাতি করে, এতে করে অন্য বন্ধুর মধ্যে একধরনের জেলাস ফিল হয়, সে মনে মনে ভাবে, তার চেয়ে আমি কম কিসে! অথচ লোকে আমার চেয়ে তার কথার মূল্যায়ন বেশি করে।
অনেক সময় দেখা যায়, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই সমান মেধাবী অথচ স্ত্রী স্বামীর চেয়ে বড় পদে চাকরি করছেন, এমনকি তার সেলারিও বেশি, এখানেও মনে মনে স্ত্রীকে স্বামী ঈর্ষা করে। এমনকি এ ইগোর জন্য অনেকের ঘর পর্যন্ত ভেঙে যায়। তাছাড়া প্রেমিকা অথবা স্ত্রী যদি অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে কথা বলে, কিম্বা তার ছেলে সহকর্মীর সঙ্গে একটু ভালো সম্পর্ক হয়, তাতেও ছেলেরা ঈর্ষান্বীত হয়, শুধু ছেলেরা নয়, এ ক্ষেত্রে মেয়েরা বরং জেলাসিতে এগিয়ে।
অনেক সময় মায়েরাও অন্য বাচ্চাদের হিংসা করে। কেনো তার বাচ্চা অমুকের চেয়ে পরীক্ষায় কম মার্কস পেল, সে তো তার বাচ্চাকে গোটা দশেক প্রাইভেট টিচার দিয়ে পড়ায়, আলাদা কোচিং করায়, তাহলে কেনো অন্যদের চেয়ে কম মার্কস পাবে। এসব ছোট ছোট বিষয় কিছু মায়েদের কাছে অনেক বিরাট আকার ধারণ করে। এতে করে বাচ্চাদের ওপর একটা নেগেটিভ প্রভাব পড়ে।
রাজনৈতিক বিষয়ে তো বলার অপেক্ষাই থাকে না। সেখানে দিবালোকে ক্ষমতার জন্য আমরা মানুষ হয়ে অন্য মানুষকে কুপিয়ে হত্যা করছি। কি নির্মম আমরা। সবই করছি হিংসার বশবর্তী হয়ে।
নানা কারণে আমাদের মধ্যে হিংসা কাজ করে। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, এটা অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ। হিংসা মানুষকে মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কোনো ধর্মই মানুষকে হিংসা–বিদ্বেষ শেখায় না।
কেন যে মানুষ ঈর্ষার বশবর্তী হয় এটা খুঁজতে গেলে আরও অনেক কারণ হয়তো পাওয়া যাবে। সবচেয়ে বড় কথা, মানুষ নিজে যা চায়, তা যখন পায় না কিন্তু চোখের সামনে সেটা অন্যকে পেতে দেখে, তখন তার মধ্যে হিংসার জন্ম হয়। কিন্তু সবাই যে একই প্রকৃতির মানুষ, তা কিন্তু নয়। অসংখ্য মানুষ এ পৃথিবীতে আছে, যারা অত্যন্ত সাধারণ এবং সাবলীল জীবনযাপনে অভ্যস্ত। দুনিয়ার কোনো বিলাসিতাই তাদের মোহগ্রস্ত করতে পারে না।
কি করে বুঝবেন, কেউ আপনাকে হিংসা করছে? একটু সচেতন হোন দিব্যি বুঝতে পারবেন। কোনো পার্টিতে গেলেন, আপনাকে দেখতে দারুণ লাগছে। সবাই আপনার সাজপোশাক এবং আপনার খুব প্রশংসা করছে কিন্তু কেউ একজন আপনার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না, আপনার প্রশংসা করা তো দূরে থাক সে হিংসায় মরে যাচ্ছে। সব জায়গাতেই এরকম দু–একজন থাকে। এটা একধরনের রোগ। অন্যের প্রশংসা করতে যারা কার্পণ্য করে, তারা আসলে উদার প্রকৃতির মানুষ নয়।
আবার আপনার খুব চেনা মানুষেরাই উপহাসের ছলে আপনাকে জেলাস করবে। সেটা হতে পারে আপনার ভালো একটা জব, স্মার্ট সেলারি অথবা আপনার গোছানো বাড়ি কিম্বা ক্রিয়েটিভিটি—এসব নিয়ে। হয়তো আপনি বুঝবেন কিন্তু সেই মানুষটাকে বুঝতে দেবেন না।
মনে রাখবেন, ঈর্ষা আপনাকে ছোট করে। ধরুন, আপনি খুব ভালো আঁকেন অথবা দারুণ লেখেন। আপনার একটা লেখা একটা জাতীয় কাগজে পাবলিশ হলো। সবাই আপনাকে বাহবা দিল কিন্তু আপনারই কোনো কাছের মানুষ লেখাটি পড়ল অথচ একবারও আপনাকে সাধুবাদ জানাল না, এটাও কিন্তু ঐ ঈর্ষার কারণ।
আমরা সৃষ্টির সেরা কিন্তু আমাদের মন কি সেরা? সক্রেটিস বলেছেন, ‘হিংসা হলো আত্মার রোগ।’ তাই আমরা মনকে কলুষিত হতে দিব না। আত্মা যত শুদ্ধ, প্রশান্তি তত নিকটে।
অন্যের ভালোতে আমরা যদি খুশি হতে না পারি, অন্তত অখুশি যেন না হই। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, ‘মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যও আমি হিংসার আশ্রয় গ্রহণ করার ঘোর বিরোধী।’
কাজেই আমরা ভুলেও কাউকে হিংসা করব না। এমনকি কারও সঙ্গে তুলনাতেও যাব না। কার কী আছে, কতটা আছে, এসব ভাবনা ভেবে নিজেকে খারাপ রাখার কোনো মানে হয় না।
অনেক মানুষ আছে, যারা পৃথিবীতে স্বর্গ বানিয়ে থাকতে চায়। জমিজমা ঘরবাড়ি সম্পদ—এসব নিয়ে মারামারি–কাটাকাটি, এমনকি খুন পর্যন্ত করে ফেলে কি অনায়াসে। আপন ভাইবোনের মধ্যেও এমন ঘটনা হরহামেশা লক্ষ করা যায়। যার যত আছে, সে আরও চায়, আরও চায়। কোনো কিছুতেই যেন তাদের তৃপ্তি মেটে না। অথচ ভাবুন তো একবার, চোখটা বন্ধ হলে, শ্বাসটা থেমে গেলে সাঙ্গ হবে সব। মিথ্যে এ দুনিয়া। তাহলে কি লাভ এত হিংসা, এত লোভে? ভাবতে অবাক লাগে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আসলেই কি আমাদের প্রকৃত শিক্ষায় সুশিক্ষিত করছে? আমাদের স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। নিজেদের মননশীলতা বাড়াতে হবে।
শুরুতেই বলেছি, হিংসা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। সব সময় মানুষ নিজেকেই প্রথম প্রায়োরিটি দিতে চায়। সে যোগ্যতা তার থাক বা না থাক।
ধরুন আপনি আপনার বন্ধুর দেওয়া কোনো পার্টিতে গিয়েছেন। সবাই আপনাকে নিয়ে আনন্দ করছে। ইতিমধ্যে সেখানে একজন বিশিষ্ট মানুষের আগমন ঘটল। আপনি তখন আর সেই প্রায়োরিটির জায়গায় থাকলেন না। সবাই ব্যস্ত হয়ে গেল সেই বিশিষ্ট অতিথিকে নিয়ে। তখন মনের অজান্তেই আপনার ভেতর এক ধরনের ঈর্ষা কাজ করবে। মনে হবে কেন তাঁকে আপনার চেয়ে বেশি মূল্যায়ন করা হচ্ছে। আমরা আসলে ক্ষমতা জাঁকজমক চাকচিক্য এসবকে অনেক বেশি মূল্যায়ন করি একজন গুনীজনের চেয়ে।
দুম করে শুনলেন আপনার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর বেতন বেড়ে গেছে এবং অফিস থেকে তাকে গাড়িও দেওয়া হয়েছে। আপনি কি জেলাস হবেন নাকি মন থেকে তাকে শুভকামনা জানাবেন। কথায় আছে, বন্ধু ফেল করলে খারাপ লাগে কিন্তু বন্ধু প্রথম হলে আরও বেশি খারাপ লাগে। সত্যিকার বন্ধু হলে কি খারাপ লাগা উচিৎ? না কি বন্ধু বলে পৃথিবীতে কিছু হয়ই না? সবটাই কেবল লোক দেখানো আর সময়ের দাবী।
আসলে হিংসার জন্ম হয় লোভ থেকে। লোভ সংবরণ করুন, দেখবেন জগতটাকে কী মায়াময় লাগছে। অল্পতেও বেশ ভালো থাকা যায়। যদি আপনি ভালো থাকতে চান।
এক্সট্রা অর্ডিনারি যারা, তাদের লোকে একটু বেশি কদর করবে, আলাদা চোখে দেখবে, এটাই তো স্বাভাবিক। তাতে ঈর্ষান্বীত হওয়ার কিছু নেই। অন্যের প্রশংসা করতে শিখুন, অন্যের ভালোতে খুশী হতে শিখুন—দেখবেন আপনার জন্য এক অপার আনন্দ অপেক্ষমান। বিধাতা কাউকেই ফিরিয়ে দেন না।
আপনি পড়ালেখায় ভালো হলে শিক্ষকেরা আপনাকে ভালোবাসবে, অফিসে পারফরমেন্স ভালো হলে বস আপনাকে সুনজরে দেখবে, ভালো চাকরি করে সংসারে বেশি টাকা দিতে পারলে মা–বাবা বেশি আদর করবে, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ালে ওপরওয়ালা আপনাকে ভালো রাখবে—এটাই তো বাস্তবতা।
আর যদি আপনি নেতিবাচক চিন্তা ধারন করেন, অন্যের কল্যাণে মঙ্গল কামনা না করে বরং ঈর্ষান্বীত হন, তাহলে কেউই আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী হবে না। সবাই আপনাকে এড়িয়ে চলবে।
গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, ‘তোমাদের সবাইকে সদয়, জ্ঞানী ও সঠিক মনের অধিকারী হতে হবে। যতোই বিশুদ্ধ জীবনযাপন করবে, ততই উপভোগ করতে পারবে জীবনকে।’
কী দারুণ কথা। আসলে সাজপোশাক অর্থবিত্তেই কি জীবন সুন্দর? না তা মনে হয় না, জীবন সুন্দর ত্যাগে-জ্ঞানে–মননে।
আমরা শুধু হাহাকার করি, নাই নাই বলে চিৎকার করি, আসলে দূর থেকে কাশফুল ঘন মনে হয় কাছে যেয়ে দেখুন ভীষণ হালকা। তেমনি আমরা বাইরে থেকে অন্যের রঙমাখা যাপিতজীবন দেখে হা–হুতাশ না করে ঠিক নিজের মতো করে যদি বাঁচতে জানি, তাহলে দেখব জীবন সত্যি সুন্দর।
নির্লোভ স্বার্থহীন মানুষের ভেতর হিংসা থাকে না। তারা কখনো অন্যের আনন্দে কষ্ট পায় না, তারা চেষ্টা করে কী করে অন্যদের ভালো রাখা যায়, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো যায়।
মনে রাখবেন, সৎ এবং বিনয়ী মানুষ সব জায়গাতেই সম্মানিত হয়। তাঁদের হয়তো বিভিন্ন বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়ে যেতে হয়, কিন্তু এটাও সত্যি, টিকে থাকার জন্য লড়াই করতেই হয় এবং শেষ পর্যন্ত সততার জয় হয়।
আমাদের সমাজের মানুষ বড় বিচিত্র স্বভাবের। যার যত আছে, সে আরও চায়। চাহিদা মানুষকে ধ্বংসের পথে নিমজ্জিত করে। একটার পর একটা চাওয়া তাদের আগ্রাসী করে তোলে। তার জন্য তারা যা খুশী তাই করতে পারে। নিজেকে যতটা নিচে নামানো সম্ভব, নামাতে পারে। চারপাশে এমন বিদ্বান মানুষ দেখি, আর ভাবি, কেনো যে তারা আলোকিত মানুষ হতে পারল না!
আবার গৌতম বুদ্ধের কথা বলতে হয়, যখন কারও সঙ্গ দ্বারা আপনার চিন্তা শুদ্ধ হতে শুরু করে, তখন বুঝবেন, সে সাধারণ মানুষ নয়।
কাজেই অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করুন। যে আপনার মঙ্গল সহ্য করতে পারে না, আপনার ভালোতে যার হৃদয় পুড়ে ছারখার হয় তেমন বন্ধু পরিত্যগ করুন। আপনার মানবিক মূল্যবোধ যত উন্নত, মানুষ হিসেবে আপনি তত গর্বিত। আমাদের ভেতর থেকে মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে, আমরা বিবেকবর্জিত মানুষে পরিণত হচ্ছি। আমরা স্রোতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু দিন শেষে সম্পদ নয়—আপনি বেঁচে থাকবেন আপনার অর্জিত মূল্যবোধে।
*লেখক: ফিচার লেখক