বিশ্ব ছাত্র দিবস ও আমাদের প্রত্যাশা
১৫ অক্টোবর বিশ্ব ছাত্র দিবস। প্রয়াত বিজ্ঞানী ও ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ২০১০ সাল থেকে তাঁর জন্মদিন ১৫ অক্টোবরে পালন করা হয় বিশ্ব ছাত্র দিবস। মিশাইল ম্যানখ্যাত বিজ্ঞানী আবদুল কালাম মনে করতেন, ‘বিশ্বে ভালো ভবিষ্যৎ গড়তে পারে ছাত্ররাই। ছাত্রদের অবদানে তৈরি হয় সুঠাম ও সুষ্ঠু সমাজ।’ সম্প্রতি ঘটিত নেপালের জেন–জি আন্দোলন এবং ২০২৪ সালে বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লব যেন এ ধারণারই প্রতিফল। কিন্তু প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আর নেতৃত্বের গুণাবলি ধারণ করা সত্ত্বেও বর্তমানে বাংলাদেশের ছাত্রদের একটি অংশ ডুবে আছে বেকারত্ব, অসহায়ত্ব আর মাদকের অতল সাগরে।
প্রথমেই বলি মাদকের কথা। বর্তমানে আমাদের দেশে স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাদকাসক্তির হার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। দুঃখের সঙ্গেই বলতে হচ্ছে যে এ আসক্তি কেবল ছেলেদের মধ্যেই নয়, আজকাল স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কিশোরী-তরুণীরাও মাদকে আসক্ত হচ্ছে। যার ফলে তাদের মধ্যে অল্প বয়সে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়া, কিশোর গ্যাং গঠন, পারিবারিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, ছিনতাই, রাহাজানি, এমনকি খুন করার প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাদকাসক্তির প্রবণতা যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে মাদক ব্যাবসার প্রবণতাও। মাদক ব্যবসার গডফাদারেরা শিক্ষার্থীদের ‘নিরাপদ ক্রেতা’ হিসেবে টার্গেট করছে। কেননা ছাত্ররা স্বভাবতই পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের চোখে নির্দোষ এবং সহজেই প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে যেতে পারে। তাই মাদক ব্যবসায়ীরা স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসাগামী শিক্ষার্থীদের মাদক বাহক হিসেবে কাজ করছে। বর্তমানে ছাত্রদের দিয়ে বেশির ভাগ অপরাধমূলক কাজ সংঘটিত হয় মাদকাসক্তিকে ঘিরে।
এবার আসি মুঠোফোন আসক্তির কথায়। প্রযুক্তির বিকাশ আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মুঠোফোন আসক্তি তুলনামূলকভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে করোনাকালীন অনলাইন ক্লাসের প্রকোপে শিক্ষার্থীদের মুঠোফোন ব্যবহারের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার জন্য মুঠোফোন হাতে পেলেও তারা সেটা অযাচিতভাবে ব্যবহার করছে। আজকাল বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ডুবে আছে ভিডিও গেমস, অনলাইন জুয়া আর পর্নোগ্রাফিতে। রাস্তাঘাটে, হাটবাজারে, এমনকি ক্লাসরুমে বসেও তারা মুঠোফোনের নীল সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছে। আবার মুঠোফোনের মাধ্যমে প্রেমঘটিত সমস্যা, অনলাইন ইভ টিজিং, প্রতারণা ইত্যাদি সমস্যা বেশি দেখা যাচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীদের সময়ের অপব্যবহার যেমন হচ্ছে তেমনি নীতি–নৈতিকতারও অবনতি ঘটছে। এ ছাড়া অতিরিক্ত মুঠোফোন আসক্তির ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শারীরিক ও মানসিক সমস্যাও বেশি দেখা দিচ্ছে।
বাংলাদেশের ছাত্রদের একটি বড় অভিশাপ হলো বেকারত্ব। সাধারণত একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরপরই স্বাবলম্বী হতে চান। এ সময় নিজের হাতখরচের টাকা পরিবার থেকে চেয়ে নিতে তাঁরা হীনম্মন্যতায় ভোগেন। ফলে পড়াশোনার ফাঁকে একটি কাজের সন্ধান পেতে তাঁরা দ্বারে দ্বারে ঘোরেন। যখন কাজ পেতে ব্যর্থ হন, তখন বেকারত্বের করালগ্রাস তাঁদের কুরে কুরে শেষ করে। ফলে তাঁরা আর্থিক সমস্যায় যেমন ভোগেন, তেমনি মানসিক সমস্যায়ও জর্জরিত হন। বাংলাদেশে এখনো অনেক বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থী আছেন, যাঁরা টাকার অভাবে না খেয়ে দিনাতিপাত করছেন অথচ লজ্জায় কাউকে বলতে পারছেন না। একটি দেশের আশার আলো–তুল্য ছাত্রদের যদি এই অবস্থা হয় তাহলে এ দেশের আশা–আকাঙ্ক্ষার অবস্থা আর কী হতে পারে! পড়াশোনা যেমন ছাত্রদের ভাগ্য পরিবর্তনের চাকা, তেমনি বেকারত্ব হলো ছাত্রদের নোংরা কর্দমাক্ত পথ, যেখানে চাকা সাবলীলভাবে ঘুরতে পারে না। এই বেকারত্বের আগুনে পুড়ে অনেক শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিতেও দ্বিধা করছেন না।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
আবার বাংলাদেশের আবাসিক শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার সবচেয়ে বড় অন্তরায় হলো আবাসনসংকট। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে পর্যাপ্ত সিট নেই। বেডের আয়তন ছোট। উদাহরণস্বরূপ, প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের একেকটি বেডের আয়তন মাত্র দেড় ফুট, যেখানে কিনা দুজন ছাত্রকে রাত্রিযাপন করতে হয়। ২০২০ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে কিছুদিন পরপর করোনার প্রকোপ দেখা যায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বারবার পরামর্শ আসে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে। অথচ এ সমস্যা নিয়ে রাষ্ট্র সর্বদা নীরব ভূমিকা পালন করে আসছে। ফলে একজন শিক্ষার্থীকে প্রতিনিয়ত স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকতে হয়। এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করলে স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে, দেড় ফুট বেডে তিন ফুট দূরত্ব রাখার নির্দেশ ঠাট্টা নাকি একজন শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্যের প্রতি রাষ্ট্রের অবহেলা?
একটি দেশের আগামী দিনের চালিকা শক্তি হলো সে দেশের শিক্ষার্থীরা। তারা মানুষের জীবনকে সুন্দর ও অর্থবহ করে তোলার অন্যতম হাতিয়ার। ছাত্ররা যত সৎ, সাহসী ও কর্মদক্ষ হবে, দেশ তত উন্নতির শিখরে পৌঁছাবে। কাজেই এ দেশের উন্নতি আনতে হলে ছাত্রদের প্রতি যত্নবান হতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ধূমপানমুক্ত এলাকার আওতায় আনতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশের দোকানগুলোতে বিড়ি–সিগারেট বা অন্য কোনো মাদকদ্রব্য বিক্রি হলে বিক্রেতাকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। শিক্ষার্থীদের মাদক সেবন নিষিদ্ধ করতে তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ না করে বন্ধুসুলভ আচরণ করতে হবে। মুঠোফোন আসক্তি কমাতে ইন্টারনেটের ওপর নির্ভর করার রীতি পাল্টিয়ে শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ডিটক্স ক্যাম্প চালু করা হোক, যেখানে শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট সময়ের বেশি মুঠোফোন ব্যবহার করতে পারবে না। শিক্ষার্থীদের বেকারত্বের সমস্যা নিরসন এখন সময়ের দাবি। কেননা এই বেকারত্বকে ঘিরে ইতিমধ্যে অনেক তাজা প্রাণ আমরা হারিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরপরই একজন শিক্ষার্থীকে কর্মসংস্থান অথবা সর্বজনীন বৃত্তির আওতায় আনা হোক, যাতে পড়াশোনাকালীন কোনো শিক্ষার্থীকে হীনম্মন্যতায় ভুগতে না হয়। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসনসংকট নিরসনে অতি দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণে ছাত্ররা বেড়ে উঠুক সুস্থ, সুন্দর ও নিরাপদ পরিবেশে—ছাত্র দিবসে এই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: মাইফুল জামান ঝুমু, ফরাসি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়