গণতন্ত্র-ভাবনা

ব্যালট বাক্সপ্রতীকী ছবি

১.

সক্রেটিস ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের দার্শনিক। এথেন্সের নাগরিক ছিলেন তিনি। তাঁর দর্শন ও জীবনকাহিনি আমরা জানতে পারি তাঁর প্রখ্যাত শিষ্য প্লেটোর রচনাবলি থেকে। প্লেটোর সব গ্রন্থেরই নায়ক হচ্ছেন সক্রেটিস।

প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ বইতে আমরা সক্রেটিসকে দেখতে পাই গণতন্ত্রের ফাঁকফোকর নিয়ে অ্যাডিমেন্টাস নামের একজনের সঙ্গে আলোচনা করতে। তিনি মূলত একটি আদর্শ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করছিলেন ওই সময়। আলোচনার একসময় তিনি অ্যাডিমেন্টাসকে জিজ্ঞেস করেন, একটি সমুদ্রযাত্রায় যাওয়ার জন্য তিনি জাহাজের ক্যাপ্টেন হিসেবে কাকে নির্বাচন করবেন। একজন দক্ষ, প্রশিক্ষিত ক্যাপ্টেনকে, নাকি ইচ্ছেমতো যেকোনো একজন ব্যক্তিকে? উত্তর হিসেবে অ্যাডিমেন্টাস প্রথম অপশনটি বেছে নিলেন। আর সক্রেটিস তাই যুক্তি দেখালেন যে একটি আদর্শ রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা হওয়া উচিত সর্বগ্রাসী, যেখানে শাসকেরা হবেন দেশশাসনে বহুদিনের অভিজ্ঞ এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিয়ে বছরের পর বছর দেশ শাসন করবেন।

সক্রেটিসের গণতন্ত্রের দুর্বলতার আরেকটি দিক তুলে ধরেছিলেন একটি উদাহরণের মধ্য দিয়ে। উদাহরণটি হচ্ছে এই রকম—একটি দেশের নির্বাচনে দুজন ভোটপ্রার্থীর একজন মিষ্টির দোকানদার এবং অপরজন ডাক্তার। ‘মানুষকে ডাক্তার তিতা ওষুধ খাওয়ান এবং তাঁদের পছন্দের খাবার খেতে বাধা দেন’, এই বলে ভোটারদের আকৃষ্ট করতে মিষ্টির দোকানদার লোক হিসেবে ডাক্তারকে জনগণের কাছে খারাপ প্রমাণের চেষ্টা করলেন। আরও প্রতিশ্রুতি দিলেন জনগণকে, তাঁকে ভোট দিলে জনগণ যত চান মিষ্টি খেতে পারবেন। নিজের ডিফেন্সে ডাক্তার বললেন, তিনি যা করেন, খারাপ লাগলেও তা জনগণের ভালোর জন্যই করেন। এই ক্ষেত্রে দেশের ভোটাররা যদি অশিক্ষিত এবং নিজেদের ব্যাপারে অসচেতন হয়ে থাকেন, তবে ইলেকশনে কে জিতবেন? নিঃসন্দেহে মিষ্টির দোকানদারই জিতবেন। সক্রেটিস তাই ভোটের গণতন্ত্র অপছন্দ করতেন। তাঁর মতে, গণতন্ত্র থেকে সর্বোত্তম ফল তখনই পাওয়া যায়, জনগণ যখন হন শিক্ষিত। রাষ্ট্র এবং নিজেদের ভালোর ব্যাপারে যুক্তিসংগত চিন্তার ক্ষমতা যখন তাঁদের থাকে। তা না হলে মিষ্টি কথার ফাঁদে পড়ে এবং ভুল মানুষ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ডাক্তারের পরিবর্তে মিষ্টির দোকানদারকেই নির্বাচিত করে ক্ষমতায় বসাবেন।

জাতীয় সংসদ ভবন
ফাইল ছবি

গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি সক্রেটিসের আপত্তি অন্যান্য কাজেও পাওয়া যায়। তিনি স্পার্টান রাজতন্ত্রকে ভালোভাবে পরিচালিত বলে প্রশংসা করেছিলেন, এবং গুণাবলি সম্পর্কে বেশ কয়েকটি সংলাপে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন যে এত কম লোকের কাছে সেগুলো রয়েছে এবং তার চেয়ে আরও কম লোক তা বুঝতে সক্ষম।

জরিপে উঠে এসেছে, ‘বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয় শাসনব্যবস্থা হলো গণতন্ত্র। বিশ্বের ৮৬ শতাংশ মানুষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বাস করতে চান এবং দুই-তৃতীয়াংশ (৬২ শতাংশ) মানুষ অন্য যেকোনো শাসনব্যবস্থার চেয়ে এটিকে বেশি পছন্দ করেন।’

সক্রেটিস সাধারণ জনগণকে যথেষ্ট স্মার্ট হিসেবে বিবেচনা করেননি। তিনি মনে করেন, ইলেকশনে ভোট দেওয়া একটি দক্ষতা, কোনো ইন্টুইশন নয়। আর এই দক্ষতা অর্জন করতে প্রয়োজন সঠিক শিক্ষার। এমন শিক্ষা, যা তাঁকে যৌক্তিকভাবে চিন্তা করতে এবং রাষ্ট্র ও নিজের কিসে ভালো হবে, সে সম্পর্কে সচেতন করে তুলবে। তাঁকে করে তুলবে রাজনীতিসচেতন। অন্যথায় দুষ্ট রাজনীতিবিদের মিষ্টি কথা এবং উন্নয়নের ফাঁপা প্রতিশ্রুতিতে সহজেই বিভ্রান্ত হয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে তিনি ব্যর্থ হবেন।

সক্রেটিসের মতো প্লেটোও গণতন্ত্র অপছন্দ করতেন। তিনি সারাটি জীবন গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলে গেছেন। তাঁর বিখ্যাত দুটি উক্তি—গণতন্ত্র হলো নিকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা, যেখানে মন্দ ও অযোগ্য লোকেরা অনায়াসে জাতির ঘাড়ে চেপে বসে উত্তম ও যোগ্য লোকদের শাসনের সুযোগ পায়। দ্বিতীয়, রাজনীতি করো; অন্যথায় তোমার চেয়ে অযোগ্য লোক তোমাকে শাসন করার কর্তৃত্ব পেয়ে যাবে।

প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টটল ‘গণতন্ত্র’ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে গিয়ে বলেছিলেন, ব্যর্থতাই গণতন্ত্রের নিয়তি। অ্যারিস্টটল মনে করতেন, গণতন্ত্রের অর্থই হলো দরিদ্র ও সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। তিনি বিশ্বাস করতেন, রাষ্ট্র পরিচালিত হতে হবে নীতিবোধ দ্বারা; অর্থাৎ শাসকশ্রেণি হবে নীতিমান। কিন্তু তিনি নিশ্চিত ছিলেন, এই নীতিনৈতিকতা ‘দরিদ্র ও সংখ্যাগরিষ্ঠ’-এর চরিত্র নয়। ফলে দরিদ্র ও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী যখন শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে, তখন তাদের পক্ষে নীতিবোধ বজায় রেখে শাসন করাও সম্ভব হবে না। কারণ, এ শ্রেণি বরাবরই নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টায় লিপ্ত থাকে, জাতির ভাগ্য বদলানোর চেষ্টা তার কাছে মুখ্য নয়। মোদ্দাকথা, অ্যারিস্টটলের কাছে গণতন্ত্র হচ্ছে গরিবতন্ত্র।

২.

বর্তমান পৃথিবীর অনেক দেশের শাসনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা ও গণতন্ত্রের অগস্ত্যযাত্রার হালচাল নিয়ে যদি তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করি, তাহলে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এথেন্স নগরীতে বসবাসরত গ্রিক দার্শনিকদের গণতন্ত্র নিয়ে নেতিবাচক মনোভাবের কারণ খুঁজে পাব।

হার্বার্ট মার্শাল ম্যাকলুহান ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ও দার্শনিক ছিলেন। কানাডার নাগরিক, পড়াশোনা যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজে। তিনি পরবর্তীকালে প্রচারমাধ্যমের দিকে ঝুঁকে পড়েন। প্রচারমাধ্যমের মাধ্যমে সমাজের প্রভাব বিষয়ে তাঁর সম্যক আগ্রহ ছিল। তিনি ‘বিশ্বগ্রাম বা গ্লোবাল ভিলেজ’ ধারণার জনক বা প্রবর্তক।

১৯৬৯ সালে প্লেবয় ম্যাগাজিনে এক সাক্ষাৎকারে ম্যাকলুহান বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক গণতন্ত্র বলতে যা বোঝায়, তার দিন শেষ। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষের ট্রাইবাল বা গোষ্ঠীগত রূপান্তর ঘটে, কথায় কথায় আতঙ্কিত হতে থাকে, পাগলের মতো হারানো পরিচয় খুঁজতে থাকে এবং একপর্যায়ে ব্যাপক মাত্রায় সহিংসতার জন্ম দেয়।’
আসলে এখন ঘটছেও তা-ই। আমরা এখন রাজনীতির ট্রাইবালাইজেশনের মধ্যে বসবাস করছি। গণতান্ত্রিক রাজনীতি ক্রমে হচ্ছে কর্কশ। রাজনীতিতে সৃষ্টি হচ্ছে মারাত্মক বিভাজন। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে রাজনৈতিক বিরোধের ধরন একেবারে পাল্টে গেছে। ধরনটা অনেকটা ট্রাইবাল হয়ে গেছে। দেখা দিচ্ছে অতিমাত্রায় পার্টিভক্তি। গোষ্ঠীগত আনুগত্য, নেতৃত্ব পূজা, নিজেদের ব্যর্থতাকে খাটো করে দেখা, শত্রুর ভুলকে বড় করে তোলা এবং প্রতিপক্ষের সঙ্গে কোনো ধরনের আপস না করার প্রবণতা বেড়ে গেছে।

৩.

গত কয়েক দশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রায়ণের অগ্রযাত্রায় দেশে দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। গণতন্ত্রায়ণের বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচনের ওপর এতটাই জোর দেওয়া হয়েছে যে অনেক অগণতান্ত্রিক দেশ ১৯৯০-এর দশক থেকে নিয়মিতভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে দেখাতে চায় যে তারা গণতন্ত্রের চর্চা করছে।

স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। হার্ভার্ডের এই অধ্যাপক নব্বইয়ের দশকে ‘সভ্যতার সংঘাত’ (clash of civilizations) নামক তত্ত্বের জন্ম দেন, যেটি পরে ৯/১১-র সন্ত্রাসী হামলার পর তাঁকে ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয়। তাঁর ‘দুবার হাতবদলের পরীক্ষা’ (two turnover test) নামে আরেকটি তত্ত্ব আছে। তাঁর এ তত্ত্ব মতে, একটি দেশের গণতন্ত্র স্থায়ী রূপ নিয়েছে কি না, সেটা বোঝা যাবে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে ওই দেশ পরপর দুটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করতে পারছে কি না, যাতে ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে। পরাজিতরা ফলাফল মেনে নিয়েছে কি না এবং বিজয়ীরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও প্রতিষ্ঠানকে পাল্টে দিয়ে কর্তৃত্ববাদী শাসনের সূচনা করেছে কি না, সেটা গণতন্ত্রায়ণের নির্ধারক পরীক্ষা।

৪.

জন স্টুয়ার্ট মিল উনিশ শতকের একজন ইংরেজ দার্শনিক। স্বাধীনতা বা লিবার্টি এবং গণতন্ত্র নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনার ধারণা পাওয়া যায় তাঁর দুটি বই ‘অন লিবার্টি’ এবং ‘কনসিডারেশন অন রিপ্রেজেন্টেটিভ গভর্মেন্ট’-এ।

মিলের লেখাতে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা—দুটি বিষয়ের কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন, জনগণের চিন্তার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য স্বাধীনতা বা লিবার্টি অত্যাবশ্যক। তাঁর কথা হচ্ছে, একটি দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সেই দেশের সক্রিয় জনগোষ্ঠীর হাত ধরেই স্বাধীনতার সর্বোত্তম সুরক্ষা সম্ভব। তিনি যে ধরনের স্বাধীনতার কথা বলেছেন, তার মধ্যে একটি হলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। মিলের বক্তব্য হচ্ছে, শাসনক্ষমতায় অনিবার্য শর্ত হিসেবে এমন একটি সাংবিধানিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা থাকা দরকার, যেখানে জনগণের সম্মতির বিষয়টি জনগণের প্রতিনিধিদের ওপর বহাল থাকে; অর্থাৎ ক্ষমতায় যাঁরা থাকবেন, তাঁদের ওপর নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা সংবিধানের মধ্যেই থাকা দরকার।

ভোট এবং ভোটাধিকার বিষয়ে মিলের বক্তব্য হলো, ভোটাধিকার নিশ্চিত করার আগে সর্বজনীন শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি আরও মনে করেন, যাঁরা কর প্রদান করেন না, তাঁদের ভোটাধিকার থাকা উচিত নয়। তিনি বিজ্ঞ, বিচক্ষণ ও বিদ্বান ব্যক্তিরা যাতে তাঁদের মূল্যবান বিচারশক্তি দিয়ে সরকারের গুণগত উৎকর্ষ সাধন করতে সক্ষম হন, তার জন্য তিনি শিক্ষিত ও বিদ্বান ব্যক্তির জন্য একাধিক ভোটের নীতি সমর্থন করেন। কিন্তু তিনি এখানে যেন শ্রেণিস্বার্থের উৎপত্তি না ঘটে, সেদিকেও সজাগ ছিলেন। আর এ জন্য তিনি এটি বলেছেন যে, ‘যোগ্যতা থাকলে দরিদ্রতম ব্যক্তিটিও যাতে একাধিক ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত না হন।’

মিল প্রচলিত সংখ্যাভিত্তিক উদার গণতন্ত্রকে যথার্থ গণতন্ত্র বলে গণ্য করেন না। তাঁর মতে, যেখানে কেবল সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের স্বার্থ ও মতামতকে সমগ্র জাতির স্বার্থ ও মতামতের সঙ্গে শনাক্ত করা হয়, সেখানে সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র থাকতে পারে না। এখানে যে গণতন্ত্র বিরাজ করে, তা ভ্রান্ত গণতন্ত্র; যথার্থ গণতন্ত্র নয়।

৫.

আমেরিকান রাজনৈতিক তত্ত্ববিদ এবং ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক রবার্ট ডালের মতে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাতটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। সেগুলো হলো ১. নির্বাচিত কর্মকর্তা, ২. অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, ৩. সর্বজনীন ভোটাধিকার, ৪. ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য প্রার্থী হওয়ার অধিকার, ৪. মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ৬. তথ্যের বিকল্প উৎস ও ৭. সংগঠন তৈরির স্বাধীনতা।

রবার্ট ডাল মনে করেন, গণতন্ত্রের জন্য ‘শুধু অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনই নয়, বরং এগুলোকে সত্যিকারভাবেই অর্থপূর্ণ করে তোলার মতো স্বাধীনতাও প্রয়োজন (যেমন: সংগঠন গড়ে তোলার স্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা)। প্রয়োজন তথ্যের বিকল্প উৎস এবং নাগরিকদের ভোট ও পছন্দের ওপর ভিত্তি করে সরকারি নীতিমালা প্রণয়নের নিশ্চয়তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর।’ কোনো দেশকে গণতান্ত্রিক হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে তার এই সব কটি মানদণ্ডই উতরাতে হবে। কারণ, এর যেকোনো একটি অনুপস্থিত হলেই অন্যগুলোর উপস্থিতি প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট দিতে নারী ভোটারদের সারি। পাঠানটুলা শাহজালাল জামেয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসা ভোটকেন্দ্র, সিলেট, ২১ জুন, ২০২৩
ছবি: আনিস মাহমুদ

৬.

গণতন্ত্র কিংবা নির্বাচন নিয়ে সারগর্ভ কথা তো অনেক হলো, এবার দেখি বিশ্বজুড়ে আমরা আমজনতা গণতন্ত্র নিয়ে কী ভাবছি। ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা মার্কিন ধনকুবের জর্জ সরোস। তিনি একজন দানশীল ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন ন্যায়বিচার, গণতান্ত্রিক শাসন ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে। তারা এ বছর গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের আস্থা কেমন, তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী এক জরিপ করে। ‘ওপেন সোসাইটি ব্যারোমিটার: ক্যান ডেমোক্রেসি ডেলিভার?’ শীর্ষক জরিপটি এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশ করা হয়।

তাদের জরিপে উঠে এসেছে, ‘বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয় শাসনব্যবস্থা হলো গণতন্ত্র। বিশ্বের ৮৬ শতাংশ মানুষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বাস করতে চান এবং দুই-তৃতীয়াংশ (৬২ শতাংশ) মানুষ অন্য যেকোনো শাসনব্যবস্থার চেয়ে এটিকে বেশি পছন্দ করেন।’ জরিপটি করা হয়েছে বাংলাদেশ, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, চীন, কলম্বিয়া, মিসর, ইথিওপিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, ঘানা, ভারত, ইতালি, জাপান, কেনিয়া, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, পোল্যান্ড, রাশিয়া, সৌদি আরব, সেনেগাল, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা, তিউনিসিয়া, তুরস্ক, ইউক্রেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের ওপর।

চলতি বছরের ১৮ মে থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত জরিপের জন্য তথ্য সংগ্রহ করা হয়। জরিপে গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, সমতা, ন্যায়বিচার, জনগণের চাওয়া, অর্থনীতি, ক্ষমতা ও রাজনীতি, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি নানা বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। জরিপে অংশগ্রহণকারী সবাই প্রাপ্তবয়স্ক।

জরিপে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রশ্নে ভারতের ৯৩ শতাংশ, শ্রীলঙ্কার ৮৫ শতাংশ, পাকিস্তানের ৭৯ শতাংশ, চীনের ৯৫ শতাংশ, যুক্তরাজ্যের ৮২ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রের ৮০ শতাংশ, জাপানের ৮১ শতাংশ, সৌদি আরবের ৭৪ শতাংশ ও রাশিয়ার ৬৫ শতাংশ মানুষ গণতান্ত্রিকভাবে শাসিত দেশে বাস করা তাঁদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন।
ওপনে সোসাইটির জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের মানুষ গণতান্ত্রিক শাসনের পক্ষে। জনগণ নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার চান। মানবাধিকারকে বিশ্বের কল্যাণের জন্য একটি বড় শক্তি হিসেবে মনে করেন এ দেশের বেশির ভাগ নাগরিক।

রাঙামাটির বাঘাইছড়ি পৌরসভা নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছেন ভোটাররা
ফাইল ছবি প্রথম আলো

জরিপে প্রশ্নের উত্তরে ৯১ শতাংশ বাংলাদেশি বলেছেন, গণতান্ত্রিকভাবে শাসিত একটি দেশে বাস করা তাঁদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনো সরকার কাঠামোর চেয়ে গণতন্ত্রকে বাংলাদেশের ৫৯ শতাংশ মানুষ পছন্দ করেন। মানবাধিকার প্রশ্নে বাংলাদেশের ৮৮ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, বিশ্বের কল্যাণের জন্য মানবাধিকার একটি বড় শক্তি।
জরিপ প্রতিবেদনে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বলতে বোঝানো হয়েছে ভোটাধিকার, ন্যায়বিচার, বাক্‌স্বাধীনতার সুরক্ষা এবং নির্যাতন ও বৈষম্য বন্ধ করাকে।

প্রশ্ন করা হয়েছিল, কোন অধিকার আপনার কাছে বেশি জরুরি? জবাবে বাংলাদেশের ৩৬ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তাঁদের কাছে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ২৮ শতাংশের কাছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার, ১৭ শতাংশের কাছে পরিবেশগত অধিকার এবং ১৩ শতাংশের কাছে ডিজিটাল জগতের অধিকার বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, এই জরিপের প্রতিবেদনে আলাদাভাবে বলা হয়েছে, অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ এ কারণে অনন্য যে এই দেশের বেশিসংখ্যক উত্তরদাতা অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারের চেয়ে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

৭.

গণতন্ত্র আর নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা হলো। এবার একটি গল্প বলে শেষ করি। তিন অন্ধ ব্যক্তি হাতি দেখবে বলে হাজির হলো জমিদারবাড়িতে। জমিদারবাড়ির গেটের সামনেই দাঁড়ানো ছিল বিশাল হাতি। এক অন্ধ গিয়ে ধরল হাতির দাঁতের মধ্যে আর সাথিদের ডেকে বলল—ভাইয়েরা আমি হাতি দেখেছি। সাথিরা জিজ্ঞেস করল: বলো তো হাতি দেখতে কেমন? অন্ধ জবাব দিল: হাতি দেখতে অনেকটা মুলার মতো। দ্বিতীয় অন্ধ ব্যক্তি ধরেছিল হাতির কানে, আর সে বলল: না না, হাতির চেহারা মুলার মতো নয়; বরং তা হবে কুলার মতো। তৃতীয় অন্ধ ব্যক্তিটি ধরেছিল হাতির পায়ের মধ্যে, তাই সে বলতে শুরু করল: হাতি দেখতে ঢেঁকির মতো। পাশে দাঁড়িয়ে মাহুত (হাতি রাখাল) কথাগুলো শুনছিল। একপর্যায়ে মাহুত বলল: ভাই, তোমরা যেভাবে হাতিটি দেখেছ, সে দেখা সঠিক নয়। হ্যাঁ, হাতির দাঁতগুলো মুলার মতোই বটে, তার কান কুলার মতো আর পা ঢেঁকির মতো। তাই বলে হাতির চেহারা মুলা, কুলা আর ঢেঁকির মতো নয়। তার নাম যেমন হাতি, চেহারাটাও হাতিরই মতো। এতক্ষণে তিন অন্ধ মাহুতের সঙ্গে ঝগড়া শুরু করে দিল। মাহুত যতই বোঝাতে চাচ্ছে, অন্ধ ব্যক্তিরা ততই ক্ষেপে উঠছে আর মাহুতের উদ্দেশে বলছে: ব্যাটা আগে হাতির গায়ে হাত দিয়ে ভালো করে জানো, তারপর হাতি নিয়ে মন্তব্য করো।

অনেক দেশেই এখনো গণতন্ত্র হলো অনেকটা অন্ধের হাতিদর্শনের মতো। রাজনীতিবিদেরা কখনো হাতির পা দেখিয়ে, কখনো মাথা বা লেজ দেখিয়ে বলেন, এটাই গণতন্ত্র। কিন্তু তাঁরা কখনোই পুরো হাতি দেখান না।

লেখক: কলামিস্ট