শান্তনুর কবর
‘দুই শহীদের মূর্তি গড়ে, বাকি শহীদ কানাচে মরে। ওরা দুই শহীদের মূর্তি গড়ে, বাকি শহীদ কানাচে মরে’ একটানা জপ শোনা যাচ্ছে দূরের কড়ই গাছের নিচ থেকে।
ভোরে জিগাতলা বাজারের মোড়ে চা খাচ্ছিলেন একটি দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক টুটুল। জপের তীব্রতা কানে এলে, খানিকটা না এগিয়ে আর থাকতে পারলেন না। এক আধপাগলা বুড়ি বারবার এই দুটো লাইন জপ করছে। সাংবাদিক মানুষ বড় কৌতূহল নিয়ে বুড়ির কাছে এসে দাঁড়ালেন।
-কি গো চাচি, কী বলছেন?
-যুদ্ধ লাগছে বাপ, আবার একাত্তরের যুদ্ধ লাগছে। শহরে মানুষ মরছে, হানাদার আইছে।
-কী কও? কিসের যুদ্ধ? ’৭১ আবার কই থেকে আইলো? চাচি তুমি তাইলে জানো না গো, এ ’৭১ না,এ ’২৪–এর যুদ্ধ।
আর তাছাড়া যুদ্ধ তো শেষ। শাসক কবে পালায়ছে। এখন আমরা স্বাধীন, এই যে দেখো শহরের দেয়ালে কত গ্রাফিতি। কত শহীদদের কথা, ছাত্রদের কথা, আন্দোলনের কথা, কত ছবি আঁকা।
-কারা বাপ এরা?
-এরা? এই যে দেয়ালে পানি হাতে যারে দেখছ এ ছেলেটা আমাদের মুগ্ধ গো। আর ওই যে বুক টান করে আঁকানো ছেলেটা ও আবু সাঈদ। আমাদের শহীদ ছাত্ররা। এরাই তো দেশ নতুন করে স্বাধীন করল।
-বাপ, ছাত্ররাই শুধু শহীদ হয়? যদি ছাত্র না হয়? জোগালের কাজ, গ্যারেজের কাজ করে তাঁরা শহীদ হয় না? বড় কলেজে না পড়লে দেয়ালে আঁকানো শহীদ হওয়া যায় না, তাই না বাপ?
বুড়ির এমন প্রশ্নে টুটুল খানিকটা নিশ্চুপ হয়ে যায়। কী বলবে, বুঝতে পারে না। আসলেই তো, এই আগস্টে কত জোগালে, কত গার্মেন্টস কর্মী, কত রিকশাওয়ালা, কত শ্রমিক মরেছে। সত্যিই তো, এদের তেমন কোনো গ্রাফিতি নেই, এদের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় নেই। এমনকি এদের নিয়ে সে নিজেও কোনো দিন তার কাগজে লেখেনি। বুড়ি তো ঠিক বলেছে। হাজারখানেক মানুষ মরল, আর দেয়ালজুড়ে দু–চারটে নাম!!
টুটুলের ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই বুড়ি যেন শূন্য মিলিয়ে যায়।
চা’র বিল মিটিয়ে ফিরে আসার সময় কী ভেবে টুটুল আবার দোকানে ফিরে যায়। দোকানিকে ডেকে বলে—
ভাই, কড়ই গাছের নিচের ওই পাগলা বুড়িটা কোথায় থাকে জানেন?
কে, শান্তনুর মা? ওর তো কোনো জায়গা নেই, ভিটেমাটি সব লোকে কেড়ে নিল, থাকে এ গাছ তলায়।
পাগল মানুষ টাকে বাড়ির লোকজন এভাবে ছেড়ে দিল?
আগে পাগল আছিল না। কয় মাস আগে শান্তনু মরল। ব্যাস বুড়ি পাগল হয়ে গেল। ওই একটাই ছেলে বুড়ির। স্বামী মরেছে বহু আগে। তিনকুলে আর কেউ নেই।
আহা! কী করে মরল?
অভাবের সংসারে মাস কতক আগে ছেলেটা ঢাকা গেছিল জোগালের কাজ করতে। এরপর দেশে গণ্ডগোল লাগল, সেই থেকে আর খোঁজ পাওয়া গেল নাহ। এরে ওরে দিয়ে বুড়ি কত খুঁজল, পাইল না। পরে আমাদের চেয়ারম্যান ঢাকা গিয়ে জানছে, ছেলে গুলি লেগে মরছে। লাশের হদিস নাই। আর কোনো খবর জানিনে ভাই। বড় ভালো ছেলে ছিলো।
ছেলের লাশটা না পাক, অন্তত কবরটা কোথায় জানতে পারলে বুড়িও শান্তিতে মরত। তই, তা তো আর সম্ভব নয়। কে কার জন্যি দৌড়াবে বলেন? কত মানুষ মরছে। তিনকুল হারা মানুষের কবর কে খুঁজবে!
টুটুল আর কথা বাড়াল না। মোটরসাইকেলে করে রওনা দিল প্রেসের দিকে। শহরের রাস্তার দুই ধারের দেয়ালজুড়ে কত শত গ্রাফিতি।
‘পানি লাগবে পানি’, ‘চির উন্নত মম শির’ কত কিছু লেখা!!! অথচ কোথাও জোগালে শ্রমিক শান্তনুর কথা নেই। কোথাও তার পাগলা মার আহাজারির কথা নেই। কোথাও শহীদ শান্তনুর রেখে যাওয়া মাকে দেখার কেউ নেই। একদম অচেনা হয়ে হারিয়ে গেল এক বীর। অথচ এ শহর শান্তনুর, এ গ্রাফিতির আসল ভাগিদার সে।
মনে শুধু ঘুরপাক খাচ্ছিল বুড়ির একটা কথা—তাহলে চেনা–জানা শহীদ হতে হলে ছাত্র হতে হয়? বড় কলেজের ছাত্র?
টুটুলদের পত্রিকায় কাল শান্তনুর গল্প ছাপা হবে, দেশের মানুষ জানবে। কিন্তু কয়জন মনে রাখবে?
না রাখুক। অন্তত এই খবর যদি মানুষের মনে সাড়া দেয়, যদি শান্তনুর কবরের হদিস মেলে। বুড়িটার জন্য টুটুলের বড্ড মায়া হচ্ছে।
ছেলেটার একটা ছবি পেলে ভালো হতো, কিন্তু ছবি তো নাই। ছবি ছাড়া কীভাবে সে খুঁজবে! আচ্ছা না থাক, তা–ও চেষ্টা সে করবে। এই শহীদ শান্তনুদের জন্যই তো তারা আজ নতুন স্বপ্ন দেখছে।
পরের দিন দৈনিক পত্রিকায় বিরাট বিরাট অক্ষরে খবর ছাপা হলো, দেশের কথা, মানুষের কথা, খেলার কথা, নানান কথা। ১০ পাতার পত্রিকার একদম শেষ পাতার ছোট্ট এক কর্নারে ঠাঁই পেল একটা শিরোনাম—
‘শান্তনুর কবর কোথায়!’
অচেনা সংবাদ–এর চেয়ে বেশি হয় না। টুটুল প্রেসের সামান্য কর্মচারী। মালিকের মতোই তার গতি, যা দিয়েছে তা–ও অনেক। কিছু করতে পারল না ভেবে অন্তত নিজের কাছে ঠুকরে ঠুকরে মরবে না।
এতকিছুর পরেও টুটুলের দুই চোখজুড়ে আশঙ্কা
‘কার কবর খুঁজছে সে? আদেও কবর আছে তো? নাকি জালিম তাকে পুড়িয়ে ভস্ম করে দেছে!’
আর ওদিকে কড়ই গাছের নিচে বসে পাগলা বুড়ি ভিজে মাটিতে দাগ কেটে নিজেই ছেলের গ্রাফিতি আঁকছে।
মাটি ভিজছে এক জননীর বারিধারায়.....
লেখক: মারুফা ইয়াসমিন বৃষ্টি, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ (চতুর্থ বর্ষ)