পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী উৎসব যে শিক্ষা দেয়

পশ্চিম আকাশে সূর্যাস্তের সময়ও আকাশে থাকে নানা নকশার ঘুড়িছবি: দীপু মালাকার

বাংলায় একটি প্রবাদ আছে—‘বারো মাসে তেরো পার্বণ।’ এই তেরো পার্বণের সবই ধর্মীয় এবং প্রতিটি উপলক্ষেই আয়োজন করা হয় নানা উৎসবের। আসলে উৎসব একটি প্রথা। আর প্রথামাত্রই সামাজিক পরিবেশের ফল। বাংলাদেশের প্রাচীন উৎসবগুলোর মধ্যে পুরান ঢাকার সাকরাইন উৎসব অন্যতম। জানা যায়, সংস্কৃত শব্দ ‘সংক্রান্তি’ ঢাকাইয়া অপভ্রংশে সাকরাইন রূপ নিয়েছে। পৌষ ও মাঘ মাসের সন্ধিক্ষণে, পৌষ মাসের শেষ দিন সমগ্র ভারতবর্ষে সংক্রান্তি হিসেবে উদ্‌যাপিত হয়। তবে পুরান ঢাকায় পৌষসংক্রান্তি বা সাকরাইন সর্বজনীন ঢাকাইয়া উৎসবে রূপ নিয়েছে। এ উৎসবের মূল আকর্ষণ ঘুড়ি ওড়ানো। তাই এটি ঘুড়ি উৎসব নামেও পরিচিত। ঐতিহ্যবাহী এ উৎসব পৌষসংক্রান্তি ও মাঘ মাসের শুরুর প্রথম প্রহরে উদ্‌যাপিত হয়। সেই হিসাবে প্রতিবছর ১৪ জানুয়ারি নানা আয়োজনের মাধ্যমে উদ্‌যাপিত হয় উৎসবটি।

ছাদে ছাদে চলে আলোর খেলা
ছবি: দীপু মালাকার

সাকরাইন উৎসবটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের হলেও বহু বছর ধরে পুরান ঢাকায় সাড়ম্বরে পালিত হয়ে আসছে। একসময় পুরান ঢাকা ছিল বাঙালি সংস্কৃতির একটা কেন্দ্রবিন্দু। সেখানকার জমিদারবাড়িগুলোয় ঘুড়ি উৎসব করা হতো। প্রায় ২০০ বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে বয়ে চলছে পুরান ঢাকার সাকরাইন উৎসব। এ উৎসব উপলক্ষে সাজানো হয় পুরান ঢাকার সূত্রাপুর, নবাবপুর, শ্যামবাজার, ধূপখোলা, শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, লক্ষীবাজার, ফরাশগঞ্জ, সদরঘাট, গেন্ডারিয়া, নারিন্দা, লালবাগ, চকবাজার, মুরগিটোলা, ধোলাইখালসহ বিভিন্ন এলাকা। দিনটিতে পুরান ঢাকার আকাশে শোভা পায় নানা রং আর বাহারি আকৃতির ঘুড়ি। সাকরাইনের ঘুড়ি তৈরিতে রয়েছে শৈল্পিক নিদর্শন। সঠিক মাপে ঘুড়ি তৈরি করতে না পারলে ঘুড়ি আকাশের নীল রং ধরতে পারবে না। এ জন্য বাহারি রঙের ঘুড়ি তৈরি করা হয় এ উৎসবে। তার মধ্যে গোয়াদার, চোকদার, মাসদার, গরুদান, লেজলম্বা, চারভুয়াদার, পানদার, লেনঠনদার, গায়েল, ভোমাদার, কাউঠাদার, মাছলেঞ্জা, ফিতালেঞ্জা, একরঙা, চানতারা, সাপঘুড়ি, প্রজাপতি, প্যাঁচা, বাক্স ঘুড়িগুলো অন্যতম।

সাকরাইনে ঘুড়ি ওড়ানোর পাশাপাশি সন্ধ্যায় বর্ণিল আতশবাজি ও রংবেরঙের ফানুসে ছেয়ে যায় বুড়িগঙ্গাতীরবর্তী শহরের আকাশ। সাধারণত ভবনের ছাদে করা হয়ে থাকে নানা আয়োজন। ছাদের ওপর চলে গানবাজনা আর খাওয়াদাওয়া। ঘুড়ি ওড়ানোর পাশাপাশি পৌষসংক্রান্তির পিঠা উৎসব করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া ঘরে ঘরে চলে মুড়ির মোয়া, বাখরখানি আর পিঠা বানানোর ধুম। নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, সবার অংশগ্রহণে মুখর হয় প্রতিটি বাড়ির ছাদ, চলে ঘুড়ির সাম্যবাদ। ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে এ উৎসব। তবে সকালের তুলনায় বিকেলে এ উৎসব বেশি মুখর হয়। আগুন নিয়ে খেলা, আতশবাজি ফোটানো এবং ফানুস ওড়ানোর মধ্য দিয়ে শেষ হয় দিনটি।

সাকরাইন উৎসবে আতশবাজি ও লেজার শোতে জাঁকজমক উদ্‌যাপন
ছবি: দীপু মালাকার

যদিও এটা সমগ্র বাংলাদেশে উদ্‌যাপিত হয় না; কিন্তু এটি খুব জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশি সংস্কৃতি। সারা দেশে এই সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে থাকলেও সাকরাইন কিছুটা ধরে রেখেছেন পুরান ঢাকার বাসিন্দারা। এটিকে ঐক্য ও বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। এ উৎসবে সব ধর্ম-পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশ নেন। উৎসবে স্থানীয় মানুষ আত্মীয়স্বজনকে নিমন্ত্রণ করেন। এ উপলক্ষে ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন পুরান ঢাকায় এসে ভিড় জমান। মেয়েরা তাঁদের শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসেন। শ্বশুরবাড়ি থেকে জামাইদের নাটাই, বাহারি ঘুড়ি উপহার দেওয়া এবং পিঠার ডালা পাঠানো একটি অবশ্যপালনীয় রীতি। ডালা হিসেবে আসা ঘুড়ি, পিঠা আর অন্যান্য খাবার বিলি করা হয় আত্মীয়স্বজন এবং পাড়াপ্রতিবেশীদের মধ্যে।

বর্তমানে এ উৎসবে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। অর্থাৎ সন্ধ্যার পর থেকেই শুরু হয় আতশবাজি ও ফানুস ওড়ানো এবং তা মধ্যরাত পর্যন্ত চলে। এ উৎসবকে ঘিরে সন্ধ্যার পর পুরান ঢাকার অলিগলিতে এবং অনেক ভবনের ছাদে দেখা মেলে ডিজে পার্টি। উচ্চ শব্দে গানের তালে তালে নাচে তরুণ-তরুণীরা। কালের ধারাবাহিকতায় সাকরাইন উৎসবে অনুষঙ্গের পরিবর্তন এলেও আমেজ ও আবেগটা কিন্তু এখনো প্রজন্মান্তরে রয়ে গেছে ঠিক আগের মতোই।

*লেখক: খ ম রেজাউল করিম, সহযোগী অধাপক, সমাজবিজ্ঞান, সরকারি মাইকেল মধুসুদন কলেজ, যশোর।