মায়ের মুখটা মনে নেই আবিরের
গতকাল রাতে পরপর কয়েকটা ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখে বেশ কয়েকবার লাফিয়ে উঠেছি মাঝরাতেই বিছানা থেকে। শেষ রাতে আর ঘুম হলো না, মাথার একপাশে টনটনে ব্যথা নিয়ে সকালটা শুরু হলো বলতে গেলে মোটামুটি আমার। আমার গ্রাম থেকে জেলা শহরের দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। বাইকে চড়ে অফিসের দিকে রওনা হলাম, তবে যাওবার আগে আমার বরাবর যা হয় গ্রামের মধ্যে দিয়ে ময়ার স্মৃতি নিয়ে বয়ে চলা কলমদড়িয়া নদীর পাশে আকবরের টংয়ে চা খেয়ে নিয়ে তবেই রওনা হলাম।
বাইক চালাতে চালাতে অনেক চিন্তাই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। মাস শেষ, আম্মার অসুখ, এ মাসে পাওনা দারের ঋণ পরিশোধের তাগাদা, আর কত কী। স্বপ্নগুলোর কথাও ভাবছিলাম, কি অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন আমায় গত রাতে গ্রাস করেছিল। এসব ভাবতে ভাবতে বাক্তা বাজারের পর কালি ঘরের কাছে আসতেই পিচগলা সড়কটা ধরে সোজা উপজেলার দিকে হেঁটে যাচ্ছিল ১২ কী ১৩ বছরের একটা ছেলে। আমাকে দেখেই হঠাৎ পেছন থেকে ডাকল ‘আমারে লইয়া যাবা...?’ ডাকটা শুনে ব্রেক করে থেমে গেলাম। ঘেমে কপালটা টইটম্বুর, বোঝা যায় অনেকটা পথ হেঁটে এসেছে এতক্ষণ সে, আর পারছে না, হাতে সারি সারি প্যাকেটে সাজানো আমড়ার ফালি, হয়তো উপজেলায় নিয়ে ঘুরে ঘুরে বেঁচবে। এত কিছু না ভেবেই বলে বসলাম ওঠ, কোনো কথা না বলেই ছেলেটা উঠে গেল আমার বাইকের পেছনে। আমি আর ছেলেটা চলতে শুরু করলাম। দুজনেরই চুপচাপ অবশ্য আমি আগেই বিমূঢ়তা ভাঙলাম।
কিরে তোর নাম কি?
আবির..
বাড়ি কই?
শ্রীপুর।
কই যাস?
ফুলবাড়িয়া..
কী কস, এতখানি রাস্তা হাঁইটা যেতে পারবি?
ভাবছিলাম রাস্তায় কয়েক প্যাকেট আমড়া বিক্রি করতে পারমু কিন্তু কেউ নিল না, হেই লাইগাই হাঁইটা হাঁইটা যাইতাছিলাম।
সংসারে কেডা আছে?
ছেলেটা চুপচাপ কিছুই বলছে না।
কিরে তোর আব্বা–আম্মা আছে না? স্কুলে যাস না?
আমার কেউ নাই, বড় আম্মা (আব্বার নানি) আছে।
কেন তোর আব্বা–আম্মা?
আব্বা আরেকটা বিয়া করছিল দেইখা আম্মা আমারে ফালাইয়া চইলা গেছে গা। মায়ের মুখ মনে নাই। আমার অহন আব্বাও নাই, আম্মাও নাই। আম্মারে তো দেহিই নাই, বড় আম্মায় কইছে আমি যখন আম্মুক পারি, তহনি আমারে ফালাইয়া চইলা গেছে, আর আহে নাই। মাদ্রাসায় ভর্তি হইছিলাম টেহার লাইগা বন্ধ হইয়া গেছে, পড়তে পারি নাই। বড় আব্বা আর বড় আম্মার অসুখ। বড় আম্মা মাইনসের বাড়িত কাম করে। অসুখের লাইগা কয় দিন ধইরা কামে যাইতে পারে না। ঘরে খাওন নাই, আমড়া বেঁচতে বাইড় হইছি, সারাদিনে যা বেচমু, চাইল–ডাইল কিনা নিয়া যাওন লাগবো....
একদমে কথাগুলো বলে শেষ করল ছোট্ট ছেলেটা, আমি অনেকক্ষণ চুপচাপ। কেমন যেন অসাড়তা ভর করছিল আমার দুই হাতে। মনে হচ্ছিল একটা কষ্ট নামক পাহাড় আমি আমার মোটরসাইকেলের পেছনে করে বয়ে চলেছি, যার অর্ধেক ভার আমার কাঁধে।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার শ্রীপুর গ্রামের সেলিম মিয়া আর রেনুয়ারা দম্পতির একমাত্র সন্তান আবির। আবিরের জন্মের পর আরেকটি বিয়ে করেন সেলিম, সেই ক্ষোভে অন্যত্র বিয়ে করেন মা রেনুয়ারা।
সেলিম মিয়াও নতুন সংসার নিয়ে পারি জমান ঢাকায়।
পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের ভিড়ে একজন নিঃসঙ্গ একা আবির এখনো মায়ের মুখটা মনে করবার চেষ্টা করে। কোলে–পিঠে করে মানুষ করা বৃদ্ধা ছফুরা বেগম এখন অসুস্থ, সংসারের সব খরচের ভার এসে পড়েছে আবিরের কাঁধে। তাই এক কেজি আমড়া কিনে ফুলবাড়িয়ার পথে পথে বিক্রি করতে বেরিয়েছে সে। অভাবের তাড়নায় লেখাপড়াটাও হয়নি তার।
শ্রীপুর গ্রামের আবদুস সালাম, বারেক, লতিফ মিয়া জানান, ছেলেটা খুব অসহায়, দুটো খাবারের জন্য এর ওর বাড়িতে যায়। মা–বাবা থেকেও নাই। এখন আমড়া বিক্রি করে।
ফুলবাড়িয়ায় আবিরকে নামিয়ে আসার পর বাকিটা পথ ওর কথাগুলো শুধু পেছনে পড়ে রইল। মানুষ মানুষের জন্য... এ কথাটি বেঁচে থাক।