সুন্দরবনবিষয়ক দপ্তর গঠন কেন জরুরি

সুন্দরবন
প্রথম আলো ফাইল ছবি

সুন্দরবন আমাদের অগাধ সম্পদের আধার। এটি বিশ্বেরও অনন্য সম্পদ। সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সুন্দরবন অতুলনীয়। জীববৈচিত্র্যে অসাধারণ এ বন। বাংলাদেশের মানুষের পাশাপাশি বিশ্বের প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে একটি আকর্ষণীয় স্থান। বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলা এবং পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় সুন্দরবনের অবস্থান। সুন্দরবনের ৬২ ভাগ বাংলাদেশের।

এটি বিশ্ব ঐতিহ্যের একটি স্থান। এখানে প্রাকৃতিক বিভিন্ন সম্পদ রয়েছে। একেক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর। আন্তদপ্তরের সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সুন্দরবনের জন্য আলাদা দপ্তর ও মন্ত্রী রয়েছে। অথচ ৬২ শতাংশ সুন্দরবন বাংলাদেশের হয়েও আলাদা কোনো দপ্তর নেই।

সুন্দরবনে আপন আস্তানায় রয়েল বেঙ্গল টাইগার
ফাইল ছবি

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব ও দক্ষিণ প্রান্ত বরাবর ১৯টি পঞ্চায়েত সমিতি এলাকা নিয়ে সুন্দরবন অঞ্চল। ভৌগোলিক আয়তন ৯ হাজার ৬৩০ বর্গকিলোমিটার। ৪ হাজার ২৬৫ বর্গকিলোমিটার সংরক্ষিত বনাঞ্চল। বাকি অংশে মনুষ্য বসতি। সুন্দরবন বলতে একসময় অনুন্নত অভাবী মানুষের দেশের ছবি ভেসে উঠত। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ঘটেছে অনেক পরিবর্তন। উন্নয়ন ও প্রগতির পথে শামিল হয়েছে সুন্দরবনের মূল ভূখণ্ড ও দ্বীপাঞ্চল। গণমুখী উন্নয়নের জোয়ার এনেছে সুন্দরবনবিষয়ক দপ্তর।

উন্নয়নমূলক কর্মসূচিগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য রাজ্য সরকার উন্নয়ন ও পরিকল্পনা বিভাগ সুন্দরবন উন্নয়ন পর্ষদ গঠন করে ১৯৭৩ সাল। সুন্দরবনবিষয়ক বিভাগ নামে পুরোদস্তুর বিভাগ গঠন করা হয় ১৯৯৪ সালের জানুয়ারি মাসে। সুন্দরবনের পরিকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক পরিকল্পনা ও কার্যক্রম হাতে নিয়েছে সুন্দরবন উন্নয়ন দপ্তর। বিদ্যুৎ সম্প্রসারণ, সৌরপ্যানেল স্থাপন, পানীয় জলের ব্যবস্থা (নলকূপ স্থাপন ইত্যাদি), কৃষি সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে সেচ ও বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে সেতু নির্মাণ, গুরুত্বপূর্ণ বাজার স্থাপন ইত্যাদি করেছে। পানি সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প (খাল সম্প্রসারণ, স্লুইসগেট, ক্ষুদ্র সেচ উন্নয়ন ইত্যাদি) গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে থাকে।

এ ছাড়া পশ্চাৎপদ এ এলাকায় কৃষিপ্রযুক্তির উন্নয়নে ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে বা বাস্তবায়ন করেছে।

ফাইল ছবি

সুন্দরবনে স্তন্যপায়ী প্রাণী, সরীসৃপ, পাখি, উভচর প্রাণী ও মাছ আছে। এ ছাড়া আছে সুন্দরবনের বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা ও মায়া হরিণ, বানর, বনবিড়াল, শজারু ও বন্য শূকর, কুমির, সাপ, বিভিন্ন প্রজাতির সরীসৃপ ও পাখি। সুন্দরবনের কাঠ, ফল, গোলপাতা, শামুক-ঝিনুক ইত্যাদির ওপর অনেকের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। সুন্দরবনের মধু বিখ্যাত। দেশে বিক্রির পাশাপাশি সুন্দরবনের মধু বিদেশেও রপ্তানি হয়। জৈবিক উপাদানগুলো এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সৈকত, মোহনা, স্থায়ী ও ক্ষণস্থায়ী জলাভূমি, কাদাচর, খাঁড়ি, বালিয়াড়ি, মাটির স্তূপের মতো বৈচিত্র্যময় অংশ গঠিত হয়েছে।

স্রোতের গতি, ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক স্রোতচক্র, সমুদ্র উপকূলবর্তী দীর্ঘ সমুদ্রতটের স্রোত ইত্যাদি উপকূল বরাবর সুন্দরবনের গঠন প্রকৃতি বহুমাত্রিক উপাদান দ্বারা প্রভাবিত। বিভিন্ন মৌসুমে সমুদ্রতটের স্রোত যথেষ্ট পরিবর্তনশীল। এগুলো অনেক সময় ঘূর্ণিঝড়ের কারণেও পরিবর্তিত হয়। এসব বিষয় আলাদাভাবে নজর দেওয়ার জন্য আলাদা দপ্তর দরকার।

১৯৯২ সালের ২১ মে সুন্দরবন ‘রামসার স্থান’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখণ্ড ম্যানগ্রোভ বনভূমি। ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার সুন্দরবনের মধ্যে ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশ অংশে। বাকি অংশ রয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। সুন্দরবন এলাকায় বিশ্ববিখ্যাত বেঙ্গল টাইগার ও চিত্রা হরিণ রয়েছে।

কত যে বিচিত্র গাছ সুন্দরবনে
ফাইল ছবি: রাজীব সরকার

প্রকৃতি ও প্রাণীর বিশাল আবাসস্থল দেখতে প্রতিবছর হাজারো পর্যটক ঘুরতে আসেন এবং সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যান। সুন্দরবনের নদী ও সৈকত পর্যটনে নতুন মাত্রা দেবে। এ জন্য দরকার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা। সুন্দরবনকে ঘিরে বিভিন্ন প্রকল্প সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে কৃষির পাশাপাশি পর্যটন সেক্টরে দারুণ উন্নয়ন হবে। ভারত, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের মতো আমাদের আশপাশের অনেক দেশ পর্যটনে অনেক আয় করছে, যা অনেকাংশ বনভূমিকেন্দ্রিক। এটা আমাদের জন্য অণুপ্রেরণামূলক উদাহরণ হতে পারে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরের তুলনায় সুন্দরবনের মাটি ও আবহাওয়া আলাদা ধরনের। জোয়ার-ভাটার কারণে এখানকার পানিতে জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততা বেশি। এখানকার মাটি পলিযুক্ত দোআঁশ। তাই এ অঞ্চলের কৃষির জন্য আলাদা পরিকল্পনা দরকার। সুন্দরবনবিষয়ক দপ্তর গঠন করা গেলে কৃষি, প্রাণী ও বনসম্পদের ব্যাপক উন্নয়ন হবে। পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা হবে। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হবে।

গ্রীষ্মে সুন্দরবনে নাটা গুলিন্দার দল
ফাইল ছবি: সায়েম ইউ চৌধুরী

ফলে, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন হবে। মৎস্য, কৃষি, প্রাণিসম্পদ, পানি, বন প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে বিভিন্ন দপ্তর। বিভিন্ন দপ্তর আবার ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এতে সুন্দরবন অঞ্চলে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে দীর্ঘসূত্রতা দেখা যায়। সুন্দরবন দপ্তর গঠন করা গেলে সুন্দরবন এলাকার সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণসহ সামগ্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রভৃতির ক্ষমতা সুন্দরবন দপ্তরের থাকবে।

এতে আন্তদপ্তরের মধ্যের ঝামেলা বা নথিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার মধ্যে সমন্বয়হীনতা কমে যাবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা সহজতর হবে। কৃষি, বন ও প্রাণিসম্পদের উন্নয়ন করা সহজ হবে। পশ্চিমবঙ্গে সুন্দরবনবিষয়ক দপ্তরের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। তাদের কার্যক্রম আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা যায়।

লেখক: কবি