তবে কি টমাস মুলারের নীরব বিদায়

বিশ্বকাপ হাতে টমাস মুলারফাইল ছবি

ফুটবল বিশ্বে টমাস মুলার এক লিজেন্ডারি নাম। যদিও তাঁকে এ প্রজন্মের ‘আন্ডাররেটেড’ খেলোয়াড় হিসেবে অভিহিত করা হয়। এরপরও তাঁর সুনাম কম নয় কোনো অংশেই। বিশেষ করে তাঁর ‘রাউমডায়টার’ উপাধি এখনো ইউরোপীয় ফুটবলে বেশ জোরালোভাবে বিদ্যমান। গত ৫ জুলাই পিএসজির বিপক্ষে ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচই ছিল তাঁর বায়ার্ন মিউনিখ অধ্যায়ের শেষ ম্যাচ। এরই মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে একজন কিংবদন্তি ও তাঁর ক্লাবের এক বিখ্যাত অধ্যায়। ২০০০ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে বায়ার্ন মিউনিখকে নিজের শৈশবের ক্লাব হিসেবে বেছে নেন টমাস মুলার। ২০০৯ সালে বায়ার্ন মিউনিখের সিনিয়র দলে অভিষেক। এরপরই শুরু তাঁর বিখ্যাত এক অধ্যায় বায়ার্নের সঙ্গে। তিনি বায়ার্ন মিউনিখ ক্যারিয়ারের শেষ সময় পর্যন্ত জিতেছেন ১৩টি বুন্দেসলিগা ট্রফি, ৬টি জার্মান ডিএফবি পোকাল ট্রফি এবং ২টি চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফি। ২০১৯-২০ মৌসুমে ২১টি লিগ অ্যাসিস্ট করে লিওনেল মেসির রেকর্ডে ভাগ বসিয়ে হয়েছেন ইউরোপের শীর্ষ পাঁচটি লীগের মধ্যে সেরা অ্যাসিস্টদাতা। রেকর্ড ১৭৫টি অ্যাসিস্ট করে মুলারই হয়েছেন জার্মান লিগের ইতিহাসে সর্বোচ্চ অ্যাসিস্টদাতা। পাশাপাশি ১৭৮টি গোলও রয়েছে তাঁর বুন্দেসলিগা ক্যারিয়ারে। আর ইউসিএলের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, টমাস মুলার চ্যাম্পিয়নস লিগ ইতিহাসের শীর্ষ গোলদাতাদের মধ্যে ষষ্ঠ অবস্থানে আছেন (৫৭টি গোল)। আবার চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে টপ অ্যাসিস্টদাতাদের মধ্যেও মুলার রয়েছেন ষষ্ঠ অবস্থানে (৩০টি অ্যাসিস্ট)। তা ছাড়া মুলারের রয়েছে ব্যক্তিগত আরও অনেক অর্জন বায়ার্ন অধ্যায়ে।

মুলার বায়ার্নকে বিদায় বলার পর তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে এখনো কিছু পরিষ্কার করেননি। তাঁর সম্ভাবনা আছে ফুটবল খেলা চালিয়ে যাওয়ার, আবার ইঙ্গিত রয়েছে পেশাদার ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার। এদিকে জার্মান জাতীয় ফুটবল দল থেকে তিনি অবসর নিয়েছেন গত বছর ইউরো শেষ হওয়ার পরপরই। এখন যদি তিনি পেশাদার ফুটবল থেকে বিদায় জানান তাহলে একজন ফুটবল কিংবদন্তির ফুটবল ক্যারিয়ারের বিদায়ের সাক্ষী হতে যাচ্ছেন ফুটবলপ্রেমীরা।

বিপক্ষ সব দলের জন্য সব সময় টমাস মুলার ছিলেন এক আতঙ্কের নাম। জার্মানি ও বায়ার্ন মিউনিখ জার্সিতে তাঁর ভয়ংকর কিছু পারফরম্যান্স তাঁকে ‘বিগ ম্যাচ প্লেয়ার’ খেতাবও প্রদান করেছে। জার্মানির হয়ে তিনি হয়েছিলেন ২০১৪ বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক। সেই বিশ্বকাপে তাঁর ৫টি গোল ও ৩টি অ্যাসিস্ট জার্মানির বিশ্বকাপ মিশন সফল হতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছিল। চারটি বিশ্বকাপ খেলে তাঁর রয়েছে ১০টি গোল ও ৬টি অ্যাসিস্ট। পাশাপাশি বিশ্বকাপে তাঁর রয়েছে গোল্ডেন বুট, সিলভার বল, সিলভার বুট ও সেরা তরুণ উদীয়মান খেলোয়াড়ের খেতাবসহ আরও কয়েকটি ব্যক্তিগত অর্জন। তা ছাড়া মেসুত ওজিলের পাশাপাশি মুলার হয়েছেন জার্মানি জাতীয় দলের হয়ে সর্বোচ্চ অ্যাসিস্টদাতা (৪০টি)। জার্মান জাতীয় দলের জার্সিতে তাঁর গোলও রয়েছে ৪৫টি। এমনকি ২০১০ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার মুলারকে কটাক্ষ করে বল বয় অপমানের জবাব দিয়েছিলেন তিনি আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে জার্মানির ৪-০ গোলের জয়ে প্রথম গোল করে। তাইতো টমাস মুলারের ফুটবল ইতিহাস যে রাজকীয়, সে সম্পর্কে আর কোনো বাগ্‌বিতণ্ডা নেই।

বিভিন্ন দলের হয়ে নানা ট্রফি জিতেছেন টমাস মুলার
ছবি: সংগৃহীত

বিশ্ব ফুটবল ইতিহাসে ৩০০ গোল ও ৩০০ অ্যাসিস্ট করা কোনো খেলোয়াড় যদি লিওনেল মেসির পরে থেকে থাকেন, তাহলে তিনি একমাত্র টমাস মুলারই। টমাস মুলারের রেকর্ড ও গোল-অ্যাসিস্টের পরিসংখ্যান জিদান, জেরার্ড, ডি ব্রুইনে, ইনিয়েস্তা, জাভি, মদরিচ, গ্রিজমানদের মতো কিংবদন্তিদেরও ছাড়িয়ে গেছে অনেক দূরে। তিনি দলের প্রয়োজনে মিডফিল্ডার থেকে স্ট্রাইকার, এমনকি উইংগার হিসেবে খেলতেও দ্বিধা করেন না। দলের অ্যাটাকিংয়ে তিনি যেকোনো পজিশনেই স্পেস ক্রিয়েটরের মতো খেলে গেছেন স্বাধীনভাবে। এ জন্য তাঁকে বলা হয় রাউমডায়টার।

‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

মুলারের গোল-অ্যাসিস্টের পরিসংখ্যান ছাড়াও তাঁর এমন লিজেন্ডারি ক্যারিয়ার দেখলে তাঁকে একজন কমপ্লিট ফুটবল লিজেন্ড বলতে কেউই দ্বিধা করবেন না। তাইতো অনেক জার্মান ভক্তই তাঁকে এ প্রজন্মের ‘জার্মান ফুটবল রাজা’ বলে থাকেন। অনেকে বলেন ‘রেডিও মুলার’, আবার কেউ কেউ বলেন ‘মি. বায়ার্ন’। মুলারের ‘জার্মান মেশিন’ উপাধিও অবশ্য কয়েকবারই দেখা গেছে। তবে আগের প্রজন্মের জার্মান ফুটবল লিজেন্ড গার্ড মুলারের পর টমাস মুলারই এ প্রজন্মে তাঁর ‘মুলার’ নামটার খ্যাতি বজায় রেখেছেন বলা যায়। হয়তো বায়ার্ন অধ্যায় শেষ মুলারের, কিন্তু তাঁর এমন বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার কখনোই ভুলবেন না ফুটবলপ্রেমীরা। তাঁকে নিয়ে শুধু জার্মান ও স্প্যানিশ মিডিয়া ছাড়া ইংলিশ-ফ্রেঞ্চসহ নামীদামি মিডিয়াগুলোতে হাইপ তেমন বেশি ছিল না বলেই তাঁকে ‘Underrated Legend’ বলে থাকেন অনেক ফুটবলপ্রেমী। হয়তো কখনো ব্যালন ডি’অর নমিনেশন পাননি, কিন্তু বিশ্ব ফুটবলের লিজেন্ড হিসেবে তাঁর খ্যাতি একটুও কমেনি। তাইতো বিদায়ী ম্যাচের পর তাঁর ভক্ত-রাইভাল সবাই হয়েছেন আবেগাপ্লুত। কারণ একটাই, এ প্রজন্মের অনেকেই বায়ার্ন মিউনিখকে চিনেছেন মুলারের ফুটবল খেলা দেখে। কোনো কোনো ফুটবল পণ্ডিত এক বিখ্যাত উক্তি করেছেন, ‘যদি তুমি মেসি-রোনালদো না–ও হতে পারো, তবু তুমি একজন টমাস মুলার হতে পারবে।’

সব সময় হাস্যমুখ থাকা মুলার ব্যক্তিগত জীবনেও বেশ হাসিখুশি একজন মানুষ। বিশেষ করে রাইভাল দলের বিপক্ষে ম্যাচের আগে তাঁর মজার ভিডিও পোস্ট করাটা প্রায় সব ফুটবল ভক্তেরই নজর করেছে। কিছুদিন আগে ফুটবল বিশ্লেষক থিয়েরি হেনরিও টমাস মুলারকে এ প্রজন্মের সেরা একজন ফুটবলার বলেছিলেন। তবে মেসি-রোনালদো ডিবেটের পর এ প্রজন্মের তৃতীয় সেরা ফুটবলার হিসেবে টমাস মুলারকে মনোনীত করতে সমস্যা হবে অনেক ফুটবলপ্রেমীর, সেটা আশা করাই যায়।

*লেখক: তাওহীদ জানান অভিক, শিক্ষার্থী, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়