ভূগর্ভস্থ পানিসংকট: সমন্বিত ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই
নাগরিক সংবাদ-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
বাংলাদেশের অর্থনীতি, জনস্বাস্থ্য এবং সার্বিক অগ্রগতির প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। এটিকে আমাদের উন্নয়নের ‘লাইফলাইন’ হিসেবে অভিহিত করলে অত্যুক্তি হবে না। দেশের প্রায় ৯৫ শতাংশের বেশি পানীয় জল এবং কৃষি খাতে প্রায় ৮০ শতাংশ সেচের জল এই ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে সরবরাহ করা হয়। খাদ্যনিরাপত্তা, শিল্পকারখানা এবং কোটি মানুষের জীবনধারণ সরাসরি এই সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই অমূল্য সম্পদ বর্তমানে বহুমুখী সংকটের সম্মুখীন।
প্রথমত, মাত্রাতিরিক্ত উত্তোলনের ফলে পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে, বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে এই পরিস্থিতি আরও প্রকট আকার ধারণ করে। এর প্রধান কারণগুলো অঞ্চলভেদে ভিন্ন। ঢাকা শহরে দ্রুত নগরায়ণ এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে নগর পাম্পিংয়ের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যাপক হারে উত্তোলন করা হচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় ৩০০ কোটি লিটার পানি গভীর নলকূপের সাহায্যে তুলে আবাসিক ও বাণিজ্যিক চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে, ফলে পানির স্তর দ্রুত নিম্নগামী। গাজীপুরে শিল্প পাম্পিংয়ের কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল। অসংখ্য শিল্পকারখানা উৎপাদন প্রক্রিয়ার জন্য বিপুল পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করছে। এই অনিয়ন্ত্রিত শিল্প পাম্পিং ভূগর্ভস্থ জলাধারগুলোকে শুষ্ক করে দিচ্ছে, যা পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করছে।
দেশের উত্তরাঞ্চলে, বিশেষ করে বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচ পাম্পিং ভূগর্ভস্থ পানি হ্রাসের অন্যতম প্রধান কারণ। শুষ্ক মৌসুমে, যখন বৃষ্টিপাত কম হয়, তখন কৃষকেরা বোরো ধানসহ অন্য ফসলের চাষাবাদের জন্য ব্যাপক হারে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করেন। এই সেচ পাম্পিংয়ের ফলে দেশের বিশাল একটি এলাকায় পানির স্তর এতটা নিচে নেমে যায় যে বহু হস্তচালিত নলকূপ অকার্যকর হয়ে পড়ে। ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী, যারা মূলত এই ধরনের নলকূপের ওপর নির্ভরশীল, তারা সুপেয় পানির তীব্র সংকটে ভোগে। এই পরিস্থিতি ক্রমে অবনতিশীল এবং যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয়, তবে ভবিষ্যতে এটি একটি ভয়াবহ মানবিক সংকটে রূপ নিতে পারে।
দ্বিতীয়ত, ভূগর্ভস্থ পানির মানও ক্রমে অবনতিশীল। দেশের বিশাল অংশে প্রাকৃতিক আর্সেনিক দূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য এক নীরব হুমকি হয়ে আছে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ২ কোটি মানুষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত মাত্রার চেয়ে পাঁচ গুণ বা তার বেশি মাত্রার আর্সেনিক দূষণযুক্ত পানি পান করছে (তথ্যসূত্র MICS ২০১৯)। এর ফলে আর্সেনিকোসিসসহ ত্বকের ক্ষত, অভ্যন্তরীণ অঙ্গের ক্ষতি এবং ক্যানসারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করছে।
তৃতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সুপেয় পানি ও কৃষিকে একযোগে বিপন্ন করে তুলেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে উপকূলীয় এলাকার ভূগর্ভস্থ ও ভূপৃষ্ঠ—উভয় প্রকার জলেই লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ ঘটছে। ফলে একদিকে যেমন সুপেয় পানির উৎসগুলো দূষিত হচ্ছে, তেমনি কৃষিকাজেও মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। এই পরিস্থিতি লাখ লাখ উপকূলবাসীর জীবনমানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ত পানি পানের ফলে ওইসব অঞ্চলে উচ্চ রক্তচাপের আধিক্য ও স্ট্রোকের প্রবণতা বেশি লক্ষ করা যায় (তথ্যসূত্র আইসিডিডিআরবি)।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে এই সংকটের গভীরতা উপলব্ধি করা সত্ত্বেও এর ব্যবস্থাপনায় আমাদের ঘাটতি বিদ্যমান। ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনায় সরকারি অবহেলা এবং সমন্বয়হীনতা প্রকটভাবে দৃশ্যমান। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ভূগর্ভস্থ পানি পর্যবেক্ষণ করে আসছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি), জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ একাধিক সংস্থা তাদের নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা স্থাপন করছে। এদের অনেক পর্যবেক্ষণ কূপে ব্যয়বহুল ডেটা লগার এবং টেলিমেট্রিক সিস্টেম স্থাপন করা হচ্ছে। যদিও একটি সমন্বিত কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা বিভিন্ন সংস্থার এই পুনরাবৃত্তিমূলক পর্যবেক্ষণগুলোর চেয়ে অনেক কম খরচে সম্পন্ন করা যেত। অনেকে দাবি করেন, পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্য ভিন্ন, কিন্তু এটি একটি সর্বৈব মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ, সব সংস্থাই মূলত একই ভৌত প্যারামিটার—ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এবং কিছু ক্ষেত্রে গুণমান—পর্যবেক্ষণ করে থাকে। সমন্বয়হীন এই প্রচেষ্টা যেমন ভূগর্ভস্থ পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় যথাযথ ভূমিকা পালনে অন্তরায়, তেমনি জনগণের অর্থের অপচয়ও বটে। উপরন্তু, সেই তথ্যের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়ার বা আইন প্রয়োগের বাধ্যতামূলক ম্যান্ডেট এই সংস্থাগুলোর কারও নেই।
যদিও বাংলাদেশের পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা দেশের সামগ্রিক পানিসম্পদ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার কেন্দ্রীয় দায়িত্বে নিযুক্ত, তবে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদনের জন্য তাদের কারিগরি বা প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাব রয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে সামগ্রিক পানি ব্যবস্থাপনার বড় অংশই যেখানে ভূগর্ভস্থ পানি, সেখানে তাদের সাংগঠনিক কাঠামোতে (অর্গানোগ্রাম), এমনকি একটি ‘হাইড্রোজিওলজিস্ট’ (ভূগর্ভস্থ পানি বিশেষজ্ঞ) পদও নেই। ফলে সংস্থাটি পরামর্শক-নির্ভর প্রকল্পভিত্তিক কাজে জড়িয়ে পড়েছে। তবে এই পরামর্শকদের সরবরাহ করা প্রতিবেদন বা গবেষণা মূল্যায়নের বিষয়ে সংস্থাটির সক্ষমতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে। তদুপরি, শোনা যাচ্ছে যে সংস্থাটি বিদ্যমান সিস্টেমগুলোকে একত্র ও কেন্দ্রীভূত না করে দেশব্যাপী তাদের নিজস্ব ভূগর্ভস্থ পানি পর্যবেক্ষণ নেটওয়ার্ক স্থাপন করছে, যা করদাতাদের অর্থের ব্যাপক অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়!
ঢাকা মহানগরের পানিসংকট ও কৃত্রিম রিচার্জের ভ্রান্তি
ভূগর্ভস্থ পানিসংকটের সবচেয়ে বড় উদাহরণ রাজধানী ঢাকা। এখানে পানির স্তর প্রতিবছর গড়ে ২-৩ মিটার নিচে নেমে যাচ্ছে। পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে। কারণ, গাজীপুরের শিল্পাঞ্চলে ব্যাপক হারে ভূগর্ভস্থ পানি তোলার ফলে ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানিতেও এর প্রভাব পড়ছে, যেহেতু উভয় এলাকার অ্যাকুইফার একই। এই সংকট মোকাবিলায় ঢাকা ওয়াসা সম্প্রতি ‘ম্যানেজড অ্যাকুইফার রিচার্জ’ (এমএআর) বা কৃত্রিমভাবে ভূগর্ভে পানি পুনর্ভরণের একটি প্রকল্পের কথা ভাবছে, যেখানে বৃষ্টির পানি, হ্রদের পানি এবং বর্জ্য পানি পরিশোধন করে তা মাটির নিচের জলাধারে (অ্যাকুইফার) প্রবেশ করানো হবে।
শুনতে ভালো মনে হলেও, ঢাকার পরিপ্রেক্ষিতে এই পরিকল্পনা নিয়ে কয়েকটি মৌলিক প্রশ্ন রয়েছে—
১.
যদি বর্জ্য পানিকে উচ্চমানের পরিশোধন করাই সম্ভব হয়, তবে তা সরাসরি পাইপলাইনে সরবরাহ না করে কেন ভূগর্ভে পুনরায় পাঠানো হবে? এই পানি পানের উপযোগী না হলেও অন্তত শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করা যেতে পারে। তা না করে এটিকে ভূগর্ভে প্রবেশ করিয়ে আবার পাম্প করে তুলে সরবরাহ করার চিন্তা কি অযৌক্তিক এবং দ্বিগুণ খরচের কারণ নয়?
২.
ভূগর্ভে পানি পুনঃপ্রবেশ করানোর সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো ভূগর্ভস্থ জলাধারের রাসায়নিক বা জীবাণুগত দূষণ। মাটির নিচের ভূতাত্ত্বিক গঠন অত্যন্ত জটিল এবং ভূ-রাসায়নিকভাবে পরিবর্তনশীল। একবার যদি ভূগর্ভস্থ জলাধার দূষিত হয়, তবে তা পরিষ্কার করা প্রায় অসম্ভব।
৩.
বিভিন্ন মডেলিং স্টাডিতে দেখা গেছে যে ঢাকার বিপুল পানি উত্তোলনের তুলনায় এই কৃত্রিম রিচার্জের পরিমাণ হবে খুবই নগণ্য (<৫%)। বর্তমানে ঢাকা ওয়াসা প্রতিদিন প্রায় ২৯০ কোটি লিটার পানি উত্তোলন করে, যার প্রায় ৭০ শতাংশ আসে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে (ঢাকা ওয়াসা বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২৩-২৪)। পাশাপাশি অবৈধ নলকূপের মাধ্যমে অতিরিক্ত আরও কমপক্ষে ১০০ কোটি লিটার পানি উত্তোলিত হয়। এই বিপুল পরিমাণ উত্তোলনের বিপরীতে কৃত্রিম রিচার্জের মাধ্যমে যে পরিমাণ পানি ভূগর্ভে ফেরত পাঠানো হবে, তা পানির স্তর নেমে যাওয়া থামাতে পারবে না। এটি অনেকটা বালির বাঁধ দিয়ে সমুদ্রকে আটকে রাখার চেষ্টার মতো।
বিশ্বে এমএআরের সফল উদাহরণও রয়েছে। যেমন ক্যালিফর্নিয়ার অরেঞ্জ কাউন্টিতে এটি মূলত সমুদ্রের লবণাক্ত পানির প্রবেশ ঠেকাতে সফলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ একটি বড় সমস্যা এবং সেখানে এমএআর এ সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। তবে এমন উদাহরণও আছে, যেখানে ভূতাত্ত্বিক গঠন ঠিকভাবে না বোঝার কারণে প্রকল্প ব্যর্থ হয়েছে। যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার ল্যাঞ্জবান রোডে ইনজেক্ট করা পানি মাটির নিচে হারিয়ে গেছে। কারণ সেখানকার ভূতাত্ত্বিক কাঠামো পানি ধরে রাখতে সক্ষম ছিল না। একইভাবে, ক্যালভিনিয়াতে মাটির নিচের খনিজের সঙ্গে বিক্রিয়ায় ইনজেক্ট করা পানিতে আর্সেনিক ছড়িয়ে পড়েছে, যা একটি ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে।
ঢাকার জন্য এমন ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্প নতুন করে অর্থ অপচয়ের কারণ হতে পারে। ঢাকার ভূতাত্ত্বিক গঠন, মাটির নিচে বিভিন্ন খনিজ পদার্থের উপস্থিতি এবং ভূগর্ভস্থ পানির গুণগত মান বিশ্লেষণ করে একটি টেকসই ও বাস্তবসম্মত সমাধান খুঁজে বের করা জরুরি।
সমাধানের পথ: ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনার সমন্বিত কৌশল
ভূগর্ভস্থ পানি কোনো অফুরন্ত ভান্ডার নয়। নির্বিচার ব্যবহার এবং অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার কারণে এর ওপর যে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে, তা এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই সংকট মোকাবিলায় বিচ্ছিন্ন প্রকল্প বা সাময়িক পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়; বরং প্রয়োজন একটি সমন্বিত, সুদূরপ্রসারী এবং শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, যা ভূগর্ভস্থ পানিসম্পদকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করতে সক্ষম।
১. জাতীয় ভূগর্ভস্থ পানি বোর্ড গঠন: একটি একক ও শক্তিশালী কর্তৃপক্ষ
প্রতিবেশী দেশ ভারতের ‘সেন্ট্রাল গ্রাউন্ড ওয়াটার বোর্ড’–এর (CGWB) সফল মডেলের আদলে বাংলাদেশে একটি একক, শক্তিশালী ও কারিগরিভাবে দক্ষ ‘জাতীয় ভূগর্ভস্থ পানি বোর্ড (NGWB)’ গঠন করা অপরিহার্য। এ বোর্ডের মূল উদ্দেশ্য হবে ভূগর্ভস্থ পানিসংক্রান্ত সব নীতিনির্ধারণ, তদারকি এবং বাস্তবায়নের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা ধারণ করা। এর মাধ্যমে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে বিদ্যমান সমন্বয়হীনতা দূর হবে এবং ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি অভিন্ন কৌশলগত দিকনির্দেশনা তৈরি হবে। বোর্ডের কারিগরি সক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্য পানিবিজ্ঞানী, ভূতত্ত্ববিদ, পরিবেশবিজ্ঞানী, প্রকৌশলীসহ বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী দল গঠন করতে হবে, যাঁরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভূগর্ভস্থ পানি সম্পদকে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হবেন। ইতিমধ্যে, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় একটি উদ্যোগ নিলেও অজানা কারণে এর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
২. বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা ও ম্যাপিং: সম্পদ মূল্যায়ন ও টেকসই ব্যবহার
নবগঠিত এ বোর্ডের প্রধান কাজ হবে দেশের ভূগর্ভস্থ পানির সম্পদ মূল্যায়ন (Aquifer Mapping)। অ্যাকুইফার ম্যাপিং অত্যাবশ্যকীয় প্রক্রিয়া, যা মাটির নিচে পানির স্তর, এর বিস্তৃতি, ধারণক্ষমতা, পুনর্ভরণের হার এবং প্রবাহের ধরণ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সরবরাহ করে। এই তথ্যের ভিত্তিতেই ব্যবহারযোগ্যতার মানচিত্র তৈরি করা সম্ভব হবে, যা বিভিন্ন অঞ্চলের পানির সহজলভ্যতা ও ব্যবহারযোগ্যতা নির্দেশ করবে। বিজ্ঞানভিত্তিক এই উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। পরিকল্পনার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের সীমা নির্ধারণ, বিভিন্ন সেক্টরে পানির অগ্রাধিকারমূলক ব্যবহার এবং ভূগর্ভস্থ পানির গুণগত মান পর্যবেক্ষণ। এই তথ্যগুলো একটি কেন্দ্রীয় ওয়েব পোর্টাল বা ড্যাশবোর্ডের মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। এই সমন্বিত ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই কেবল অঞ্চলভেদে পানির চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্য আনা সম্ভব হবে।
৩. নগরাঞ্চলে বিকল্প উৎস: ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা হ্রাস
ঢাকা ও অন্য বড় শহরে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর অত্যধিক নির্ভরতা দ্রুত কমাতে হবে। এর জন্য বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি:
পানির অপচয় রোধ ও পুনর্ব্যবহার (Reuse): শহুরে এলাকায় পানির অপচয় রোধে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। ব্যবহৃত পানি পরিশোধন করে বাগান সেচ, টয়লেট ফ্লাশিং এবং শিল্পকারখানায় পুনরায় ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে।
বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ: প্রতিটি নতুন ভবন নির্মাণে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করতে হবে। বড় বড় স্থাপনা, যেমন হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকারি ভবনগুলোতে বৃষ্টির পানি সংগ্রহের জন্য অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। এই সংরক্ষিত পানি বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে, যা ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাবে।
সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট: ভূপৃষ্ঠের পানির ব্যবহার বৃদ্ধি: নদী, খাল, বিল এবং অন্যান্য জলাশয় থেকে পানি সংগ্রহ করে পরিশোধন করে সরবরাহ করার জন্য বড় বড় সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট নির্মাণ এবং বিদ্যমান প্ল্যান্টগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা বাধ্যতামূলক করতে হবে। এটি ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে পানির উৎসে বৈচিত্র্য আনবে।
৪. সেচে দক্ষতা বৃদ্ধি: কৃষি খাতে মিতব্যয়ী ব্যবহার
কৃষি খাতে সেচের পানির মিতব্যয়ী ব্যবহার নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের মোট ভূগর্ভস্থ পানির প্রায় ৮০ শতাংশ কৃষিকাজে ব্যবহৃত হয়। এই বিশাল পরিমাণ পানির অপচয় রোধ করতে আধুনিক ও সাশ্রয়ী সেচপদ্ধতি গ্রহণে কৃষকদের উৎসাহিত ও বাধ্য করতে হবে।
আধুনিক সেচপদ্ধতি: ড্রিপ ইরিগেশন, স্প্রিংকলার ইরিগেশন এবং ফারো ইরিগেশনের মতো পদ্ধতিগুলো পানির অপচয় কমায় এবং ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করে।
সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ: কৃষকদের মধ্যে সেচের পানির গুরুত্ব এবং আধুনিক পদ্ধতির ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এ বিষয়ে সরকারি পর্যায়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
নীতিমালা ও প্রণোদনা: সেচের পানির অপচয় রোধে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে এবং যাঁরা আধুনিক পদ্ধতি গ্রহণ করবেন, তাঁদের জন্য আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে।
সমন্বিত পরিকল্পনা, কঠোর আইন প্রয়োগ এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা
শুধু পর্যবেক্ষণ নয়, এখন দরকার সমন্বিত পরিকল্পনা, কঠোর আইন প্রয়োগ এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা। ভূগর্ভস্থ পানিকে একটি জাতীয় সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করে এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য একটি সামগ্রিক রূপরেখা তৈরি করতে হবে। বিদ্যমান আইন ও নীতিমালার দুর্বলতা দূর করে কার্যকর আইন প্রণয়ন এবং তার কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনাকে একটি জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে দেখা এবং এই বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা পোষণ করা। তা না হলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের এই ‘লাইফলাইন’ শুকিয়ে যেতে বাধ্য, যা আমাদের অর্থনীতি, পরিবেশ এবং জীবনযাত্রার ওপর এক বিপর্যয়কর প্রভাব ফেলবে।
*মাহফুজুর রহমান খান, সহযোগী আধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়