জৈব সার সম্প্রসারণের মাধ্যমে রাসায়নিক সারের ব্যবহার অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব
রাশেদ একজন স্বপ্নবাজ তরুণ উদ্যোক্তা। স্বপ্ন বাস্তবায়নের সারথি হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন ও বিপণনের ব্যবসা। বাড়ির পাশে গড়ে তুলেছেন রাশেদ স্মার্ট অ্যাগ্রো ফার্ম। চলতি বছরের এপ্রিলে ঘুরে এলাম সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার শিয়ালকোল ইউনিয়নের বড় হামকুড়িয়া গ্রামে অবস্থিত তাঁর অ্যাগ্রো ফার্ম। আলাপকালে তিনি জানান, ২০২১ সালের জুনে মাত্র ৫০–৬০ হাজার টাকা পুঁজি দিয়ে মাসিক চার থেকে পাঁচ টন ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বেড–পদ্ধতিতে একটি শেডে ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন শুরু করেন। গত দুই বছরের ব্যবধানে বর্তমানে তাঁর খামার থেকে প্রতি মাসে ৩৫ থেকে ৪০ টন ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন হচ্ছে। খামারে এ সার উৎপাদনে প্রতি মাসে ১০০ থেকে ১২০ টন গোবরের প্রয়োজন হয়ে থাকে, যা তিনি স্থানীয় শতাধিক খামার থেকে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সংগ্রহ করছেন। এই ব্যবসা পরিচালনার জন্য বর্তমানে তাঁর খামারে তিনিসহ আরও পাঁচজন কর্মরত রয়েছেন। তাঁর খামারে উৎপাদিত ভার্মি কম্পোস্ট ডিলারদের মাধ্যমে স্থানীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি অনলাইনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে ১০ থেকে ১৫ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন। এ ছাড়া তিনি কন্ট্যাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে এসিআই ও দারাজের মতো বিভিন্ন বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলোয় সার বিক্রি করছেন।
স্বপ্নবাজ তরুণ উদ্যোক্তা আরও জানান, এ ব্যবসা পরিচালনার মাধ্যমে বর্তমানে তাঁর সব খরচ বাদে প্রতি মাসে গড়ে এক লাখ টাকার মতো আয় হচ্ছে। শুরুর দিকে তাঁর এ কাজে প্রশিক্ষণ, কারিগরি ও প্রযুক্তি সহায়তা প্রদান করে পিকেএসএফের আরএমটিপি প্রকল্পের আওতায় স্থানীয় এনজিও এনডিপি। পরবর্তী সময়ে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় তাঁর বিপণন কাজে ব্যাপক গতি সঞ্চারিত হয়। বর্তমানে তিনি একাই অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে এ ব্যবসা পরিচালনা করছেন। রাশেদের মতো হাজারো তরুণ ও নারী উদ্যোক্তা বর্তমানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বাণিজ্যিকভাবে ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন করছেন এবং দিন দিন এ সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব উদ্যোক্তা একদিকে যেমন নিজেদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ স্থানীয় অনেক লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অবদান রাখছেন, তেমনি দেশে কৃষিজমিতে নির্বিচার রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
দেশে ভার্মি কম্পোস্ট সারের বাজারের আকার কত বড়, সে সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য জানা সম্ভব হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশে ভার্মি কম্পোস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. বদরুল হায়দার ব্যাপারীর সঙ্গে কথা বলে বর্তমানে দেশে রাশেদের মতো শুধু তাঁদের অ্যাসোসিয়েশনেই সদস্য রয়েছেন ২৫৬ জন। যাঁদের মাধ্যমে দেশব্যাপী বাণিজ্যিকভাবে প্রতি মাসে প্রায় চার হাজার টন ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন হচ্ছে। ২০১৬ সালে শুরুর দিকে মাত্র সাত সদস্য নিয়ে তাঁদের অ্যাসোসিয়েশন শুরু হয়েছিল এবং তখন তাঁদের মাধ্যমে মাত্র ৯ থেকে ১০ টন এই সার উৎপাদন হতো। তিনি আরও বলেন, তাঁর জানামতে বর্তমানে দেশে ছোট–বড় কমবেশি প্রায় ২৭ হাজার ভার্মি ও ট্রাইকো কম্পোস্ট সার উৎপাদনকারী রয়েছেন। এর মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে কম্পোস্ট সার উৎপাদন করছেন ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ জন। তাঁদের মধ্যে মাসিক পাঁচ টনের ওপর কম্পোস্ট সার উৎপাদন করছেন ২৫০ থেকে ২৭০ জন। বর্তমানে তাঁদের মাধ্যমে দেশব্যাপী ভার্মি ও ট্রাইকো কম্পোস্ট সার উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ মেট্রিক টন। দিন দিন এ সারের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সঙ্গে উৎপাদনও বাড়ছে। গ্রামীণ পর্যায়ের অনেক শিক্ষিত নারী ও তরুণ উদ্যোক্তা জৈব সার উৎপাদনে যুক্ত হচ্ছেন। তবে বর্তমানে কৃষকদের মধ্যে সচেতনতার অভাব, এ সারের গুণাগুণ ও সুফল সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাব, সব জায়গায় সহজলভ্য না হওয়া, প্রচার–প্রসারের অভাবে আশাতীত হারে দেশব্যাপী এ সারের ব্যবহার বাড়ছে না। এ ছাড়া সার উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত উদ্যোক্তাদের জন্য প্রয়োজনীয় বাজারজাতকরণ সহযোগিতা, নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান ও দেশব্যাপী তাঁদের উৎপাদিত সারের প্রচার–প্রসারের অভাব রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরও বলেন, এ ব্যবসা চালুর জন্য শুরুর দিকে জড়িত উদ্যোক্তাদের প্রয়োজন হয়ে থাকে স্টার্টআপ মূলধনের এবং ব্যবসা শুরু হওয়ার পর প্রয়োজন হয়ে থাকে ওয়ার্কিং মূলধনের, যা তুলনামূলক কম সুদের উদ্যোক্তা পর্যায়ে সহজলভ্য করা প্রয়োজন। কিন্তু এসবের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে, যা এই ব্যবসা সম্প্রসারণের একটি অন্যতম প্রধান অন্তরায় বলে তিনি মনে করেন।
বর্তমানে দেশের এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ছাড়াও অনেক সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ভার্মি কম্পোস্ট সারসহ জৈব সার উৎপাদনে এগিয়ে এসেছে। এর মধ্যে সরকারি পর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, আরডিএ ও পিকেএসএফ অন্যতম। পিকেএসএফের উপমহাব্যবস্থাপক ও আরএমটিপি প্রকল্পের সমন্বয়ক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, পিকেএসএফ এক দশক ধরে বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় দেশব্যাপী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ক্যাপাসিটি বিল্ডিংয়ের মাধ্যমে ভার্মি কম্পোস্ট সারসহ সব ধরনের জৈব সার উৎপাদনে বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে দেশব্যাপী কাজ করে যাচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় ইউনিয়নভিত্তিক বাণিজ্যিকভাবে জৈব সার উৎপাদন ও বিপণন সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বর্তমানে আরএমটিপি প্রকল্পের আওতায় দেশব্যাপী বিস্তৃত সহযোগী সংস্থাদের নেটওয়ার্ক ব্যবহারের মাধ্যমে চার শতাধিক উদ্যোক্তা সরাসরি বিভিন্ন আর্থিক ও অ–আর্থিক সহযোগিতায় বাণিজ্যিকভাবে জৈব সার উৎপাদন করছেন। বাণিজ্যিকভাবে এসব উদ্যোক্তা মাসে প্রায় পাঁচ হাজার টন ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন করছেন, যা একদিকে যেমন স্থানীয় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখছেন, তেমনি মাটির জৈব পদার্থ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে বলেও তিনি জানান।
বেসরকারি পর্যায়ে বর্তমান দেশে এসিআই, মডার্ন হারবাল, পারটেক্স, শাপলা অ্যাগ্রিকালচার করপোরেশন, কাজী গ্রুপ ও ইয়ন গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব ও সাব–কন্ট্রাক্টিংয়ের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে কম্পোস্ট সার উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। বেসরকারিভাবে কম্পোস্ট সার উৎপাদন সেক্টরে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান এসিআই ফার্টিলাইজারের মার্কেটিং ম্যানেজার শাহ মোহাম্মাদ আরেফিন বলেন, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অত্যধিক ও নির্বিচার ব্যবহার, একই জমিতে বারবার একই ফসল জন্মানো, ফসলের ধরন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের মাটির উর্বরতা ও মাটির স্বাস্থ্য দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। মাটির স্বাস্থ্য ভালো করতে ও ফসলের ফলন বাড়াতে ২০২৩ সালে এসিআই সার বাজারে প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিক ট্রন জৈব সার (কম্পোস্ট, ট্রাইকো–কম্পোস্ট ও ভার্মি কম্পোস্ট) সরবরাহ করেছে। এই সার প্রধানত আলু, তরমুজ, আম, পেয়ারা, পেঁয়াজ, বোরো ধান, ভুট্টা ও বিভিন্ন সবজি চাষ ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয়। দিন দিন এর প্রয়োজন প্রায় ৪০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে এসিআই সার দেশের প্রাতিষ্ঠানিক জৈব সার উৎপাদনের প্রায় ৪৫ শতাংশ সরবরাহ করে বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে। চলতি বছরে এসিআই কোম্পানি বাজারে ৪০ হাজার মেট্রিক টন জৈব সার সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কাজ করছে।
দেশব্যাপী জৈব সার উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত এসব উদ্যোক্তা, এই সেক্টরে বিনিয়োগকৃত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সরকারিভাবে সহযোগিতা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোই পারে দেশের কৃষি ক্ষেত্রে রাসায়নিক সারের ব্যবহার অনেকাংশে হ্রাস করতে, সার আমদানি বাবদ প্রতিবছর সরকারের ব্যয়কৃত বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় বাঁচাতে এবং প্রতিবছর সরকারের এ খাতে ভর্তুকি প্রদানকৃত বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করতে।
উল্লেখ্য, কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী চলতি অর্থবছরে দেশে রাসায়নিক সারের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৬৯ লাখ টন, যার প্রায় ৮০ শতাংশই দেশের বাইরে থেকে আমদানি করতে হবে। দেশে এই রাসায়নিক সারের উৎপাদন হয় মাত্র ২০ শতাংশ। বর্তমানে দেশে সরকারি গুদামগুলোয় সারের মজুত আছে প্রায় ১৮ লাখ টন। সারের এ মজুত দেশের আসন্ন প্রয়োজনও তাৎক্ষণিকভাবে মেটাতে পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করছেন কৃষিবিদেরা। প্রতিবছর সরকারকে সার আমদানিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিতে হয়। ২০২০–২১ অর্থবছরে সারের ভর্তুকিতে ৭ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা লেগেছিল; সেখানে ২০২১–২২ অর্থবছরে লেগেছে ২৮ হাজার কোটি টাকা। বরাবরের মতো চলতি অর্থবছরেও সারের ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। এভাবে প্রতিবছর সরকারকে বিপুল পরিমাণে অর্থ সার আমদানিতে ভর্তুকি দিতে হয়।
কৃষি গবেষকদের মতে, কৃষিজমিতে রাসায়নিক সারে সঙ্গে সমন্বিতভাবে ভার্মি কম্পোস্ট সারসহ অন্য জৈব সারের ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে ৩০ শতাংশ রাসায়নিক সারের ব্যবহার হ্রাস সম্ভব। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিম্যাল সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক ও গবাদিপশুর বর্জ্য থেকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে গুণগত মানসম্পন্ন বিভিন্ন জৈব সার তৈরির উদ্ভাবক অধ্যাপক এ কে এম আহসান কবীর বলেন, সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও শস্য উৎপাদনে রাসায়নিক সার অতিমাত্রায় ব্যবহৃত হচ্ছে। শস্য উৎপাদনে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে একদিকে যেমন মাটির সুস্বাস্থ্য হ্রাস পাচ্ছে, অন্যদিকে বিদেশ থেকে রাসায়নিক সার আমদানিতে বাংলাদেশ সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থের ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, অতিমাত্রায় বা নির্দিষ্ট মাত্রায় শুধু রাসায়নিক সার ব্যবহারের চেয়ে কম মাত্রায় রাসায়নিক সার ও জৈব সারের সমন্বিত ব্যবহারের ফলে মাটির স্বাস্থ্য ভালো ও গাছের বৃদ্ধি বেশি হয়, এমনকি শস্য উৎপাদনও বেড়ে যায়।
বাংলাদেশে শস্য উৎপাদনে কম মাত্রায় রাসায়নিক সার ও জৈব সারের সমন্বিত ব্যবহারের মাধ্যমে রাসায়নিক সারের ব্যবহার মোট প্রয়োজনের কমপক্ষে ৩০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে গবাদিপশু ও গৃহস্থালির বর্জ্য থেকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে গুণগত মানসম্পন্ন জৈব সার তৈরির সহজ কৌশলগুলো কৃষক পর্যায়ে কার্যকরীভাবে পৌঁছে দেওয়া, বাণিজ্যিকভাবে জৈব সার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ও সরকারের যৌথ উদ্যোগে ন্যায্যমূল্যে কৃষক পর্যায়ে বিজ্ঞানসম্মতভাবে উৎপাদিত গুণগত মানসম্পন্ন জৈব সার বছরব্যাপী প্রাপ্তির ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। তবে এর জন্য দরকার সরকারি–বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও ব্যাপক প্রচার–প্রসার। তিনি আরও বলেন, এই সার ধান, গম, পাট সব ধরনের শস্য উৎপাদনের জন্য জমিতে ব্যবহার করা যায়, তবে সবজি উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে এবং বেশি কার্যকরী। তবে এ ব্যাপারে আরও বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন।
ভার্মি কম্পোস্ট সারের ব্যবহার সম্পর্কে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার গাড়িদহ ইউনিয়নের কৃষক শাহাদত হোসেন বলেন, ‘আমি ২০২২ সালে এক বিঘা জমিতে ৩৫ কেজি রাসায়নিক সার ব্যবহারের মাধ্যমে ধান চাষ করে ১৫ মণ ধান পেয়েছিলাম। একই জমিতে ২০২৩ সালে ৫০ কেজি ভার্মি কম্পোস্ট ও ২০ কেজি রাসায়নিক সার ব্যবহারে ১৭ মণ ধান পেয়েছি।’ এক বিঘা জমিতে তাঁর ইউরিয়া সারের ব্যবহার কমেছে ১৫ কেজি এবং নতুন করে ভার্মি কম্পোস্ট সারের ব্যবহার বেড়েছে ২০ কেজি, তবে তাঁর ধান উৎপাদন না কমে বরং দুই মণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার বাজারমূল্য ছিল ২ হাজার ৫০০ টাকা। এভাবে খরচ বাদে তাঁর আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ২ হাজার ৩০০ টাকা। একই ধরনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন শেরপুর উপজেলার গাড়িদহ ইউনিয়নের সবজিচাষি আবদুল মালেক। তিনি বলেন, ‘আমি ২০২২ সালে প্রতি শতাংশ জমিতে গড়ে ছয় কেজি রাসায়নিক সার ব্যবহার করে আলুর ফলন পেয়েছিলাম দুই মণ। একই জমিতে ২০২৩ সালে শতাংশপ্রতি গড়ে তিন কেজি রাসায়নিক সার ও চার কেজি জৈব সার ব্যবহার করে আলুর ফলন পেয়েছি ২ দশমিক ৫ মণ।’ তিনি জানান, জৈব সারের ব্যবহার বাবদ শতাংশপ্রতি তাঁর অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে ৪০ টাকা, কিন্তু রাসায়নিক সারের ব্যবহার হ্রাস বাবদ খরচ কমেছে ৬০ টাকা। আগে শতাংশপ্রতি রাসায়নিক সার ব্যবহারে খরচ হতো ১২০ টাকা। গত বছর রাসায়নিক সার ও জৈব সার উভয় সারের ব্যবহার বাবদ ব্যয় হয়েছে ১০০ টাকা। কিন্তু আলুর ফলন বেশি হয়েছে ২০ কেজি। এভাবে সমন্বিত রাসায়নিক ও জৈব সারের ব্যবহার বাবদ ব্যয় কমেছে, কিন্তু আগের তুলনায় আয় বেড়েছে ২৪০ টাকা। তিনি আরও জানান, ‘জৈব সারের ব্যবহারে শুধু আয় বাড়েনি, আমার জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সবজির মানও বৃদ্ধি পেয়েছে।’
জৈব সারের ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে রাসায়নিক সারের ব্যবহার যেমন কমানো সম্ভব, তেমনি মাটির জৈব পদার্থ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে বলে কৃষিবিজ্ঞানীরা মনে করেন। এ বিষয়ে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণত ৪৫ শতাংশ খনিজ বা মাটির কণা, ৫ শতাংশ জৈব ও ২৫ শতাংশ করে পানি ও বাতাস থাকা মাটিকে সুষম মাটি বলা হয়। একটি আদর্শ জমিতে জৈব পদার্থের মাত্রা ৩ দশমিক ৫ শতাংশ থাকা অতি প্রয়োজনীয় হলেও দেশের বেশির ভাগ জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ১ দশমিক ১৭ শতাংশ। কিছু কিছু জমিতে এর পরিমাণ ১ শতাংশের চেয়ে কম। এর মধ্যে ৫৪ লাখ হেক্টর জমিতে ফসফরাস, ২৬ দশমিক ৩০ লাখ হেক্টর জমিতে পটাশিয়াম, //////////৩৩ দশমিক ৩০ লাখ ৮ হাজার হেক্টর জমিতে গন্ধক,////////// ২৭ দশমিক ৭ লাখ হেক্টর জমিতে দস্তা সার, ////////////২৩ দশমিক ৯ লাখ হেক্টর জমিতে সারের অভাব রয়েছে।//////// এ ছাড়া অনেক জমিতে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়ামের অভাব রয়েছে। মৃত্তিকাবিজ্ঞানীদের মতে, এই জৈব পদার্থ হচ্ছে মাটির প্রাণ, যে মাটিতে যত বেশি জৈব পদার্থ থাকে, সে মাটি ততই সমৃদ্ধ। গাছের জন্য যত ধরনের খাদ্য উপাদান প্রয়োজন, প্রায় সবই কমবেশি থাকে এ জৈব পদার্থে। তা ছাড়া মাটির ভৌত রাসায়নিক ও অণুজৈবিক প্রক্রিয়া জৈব পদার্থের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং জৈব পদার্থের ব্যবহার বাড়ানো খুবই জরুরি।
এ প্রসঙ্গে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আমীর মোহাম্মদ জাহিদ বলেন, ‘মাটিতে সাধারণত ৫ শতাংশ জৈব পদার্থ থাকা দরকার। আমাদের দেশে উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে জৈব পদার্থ বেশি বিয়োজন হয়। তাই আমাদের সাড়ে ৩ শতাংশ থাকলেও হয়। আমরা দেখেছি, জমিতে এ পরিমাণ জৈব পদার্থ ২ শতাংশের নিচে, এমনকি কোথাও কোথাও ১ শতাংশের নিচে রয়েছে।’ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত চাষাবাদ, মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহার, ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ, শিল্পায়ন, দূষণ, ব্যাপক হারে বনভূমি ধ্বংস, অপরিকল্পিতভাবে সারের ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ইটভাটার জন্য মাটির উপরিভাগের অংশ তুলে নেওয়ার কারণে মাটিতে প্রয়োজনীয় পরিমাণে এই জৈব পদার্থ নেই।
মাটিতে এ জৈব পদার্থ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেইরিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আশিকুল ইসলাম বলেন, দেশে বর্তমানে ২৫ দশমিক শূন্য মিলিয়ন গরু–মহিষ রয়েছে। এ বিপুলসংখ্যক গরু–মহিষ থেকে বাৎসরিক ১৫ কোটি ১৩ লাখ টন গোবর উৎপাদন হয়ে থাকে। এ পরিমাণ গোবর থেকে বছরে ৬ লাখ ৫৭ হাজার ৫৮৫ টন ইউরিয়া সমতুল্য সার ও ১ লাখ ৯৭ হাজার ৩২৭ টন টিএসপি সমতুল্য সার পাওয়া সম্ভব (ILMMP-2019)। কেননা, গরুর গোবরে ৩ শতাংশ নাইট্রোজেন, ২ শতাংশ ফসফরাস ও ১ শতাংশ পটাশিয়াম থাকে। গোবর একটি উৎকৃষ্ট যৌগ, যাতে কৃষিকাজের উপযোগী ও ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি কেজি গোবর থেকে ৫০–৫২ শতাংশ কেঁচো সার উৎপাদন করা যায়। সে মোতাবেক বাৎসরিক প্রায় ৭ কোটি ৫৬ লাখ ৫০ হাজার টন কেঁচো সার পাওয়া সম্ভব। সুতরাং গোবরের সুষ্ঠু ব্যবহারে জৈব সারের চাহিদা পূরণের মাধ্যমে রাসায়নিক সারের চাহিদা অনেকাংশে পূরণের সুযোগ রয়েছে। তিনি আরও বলেন, গবাদিপশু থেকে পাওয়া গোবরকে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করে দেশব্যাপী ব্যাপকভাবে কেঁচো সারের মতো অন্যান্য জৈব সার উৎপাদন করতে পারলে, তা একদিকে কৃষিজমিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমাতে সহায়তা করবে, অন্যদিকে মাটিতে জৈব পদার্থ বৃদ্ধিসহ মাটির বিভিন্ন অণুজীব বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে ফসলি জমি প্রায় ৭ দশমিক ২৯ মিলিয়ন হেক্টর। পৃথিবীর মোট ভূখণ্ডের প্রায় ১০ শতাংশ জায়গায় ফসল আবাদ হলেও বাংলাদেশের মোট আয়তনের প্রায় ৬০ শতাংশ জমিতে চাষাবাদ করা হচ্ছে। আয়তনের বিচারে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৪তম হলেও আবাদি জমির হিসাবে ২৯তম। চাষাবাদের হিসাবে বিশ্বে প্রথম তিনটি দেশের একটি বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহারের দক্ষতা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। নিবিড় চাষাবাদের হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বে একেবারে প্রথম সারিতে। জমি ব্যবহারের দক্ষতায় কৃষকেরা পৃথিবীর সেরা হলেও জমির গুণগত মান রক্ষা অর্থাৎ জমিতে জৈব পদার্থের উপস্থিতির দিক থেকে তলানির দিকে। এ তলানি থেকে ওঠানোর জন্য দরকার জমিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা এবং জমিতে ভার্মি কম্পোস্টসহ অন্য জৈব সারের ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে রাসায়নিক সারের ব্যবহার হ্রাস করা। এ ক্ষেত্রে দরকার হবে বিস্তর গবেষণার মাধ্যমে মাটির স্বাস্থ্য উপযোগী করে একটি কম্পোজিট জৈব সার উৎপাদন করা, যে সারে মাটির উপযোগী সব পুষ্টি উপাদান থাকে এবং ফসলের সব চাহিদা পূরণ করতে পারে। শুধু জৈব সার উৎপাদন বৃদ্ধি করলেই হবে না, দেশব্যাপী এ সারের ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য ব্যাপকভাবে প্রচার–প্রসারের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। পাশাপাশি দেশব্যাপী সার উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত উদ্যোক্তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সহজ শর্তে ঋণের সুবিধা, প্রশিক্ষণ ও বাজারজাতকরণের সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে সরকারি–বেসরকারিভাবে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, তবেই রাসায়নিক সারের ব্যবহারের ওপর চাপ কমবে এবং বাঁচবে আমাদের মৃত্তিকাকেন্দ্রিক বাংলার কৃষি অর্থনীতি, জীবন ও জীবিকা, নিশ্চিত হবে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা।
*লেখক: ব্যবস্থাপক, পল্লী কর্ম–সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)
‘নাগরিক সংবাদ’–এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই–মেইল: [email protected]