আমি শিক্ষক, শিক্ষাদানের উপযুক্ত পরিবেশ চাই
বর্তমানে যিনি শিক্ষকতা পেশায় আছেন, তিনিই জানেন যে শ্রেণিকক্ষে তিনি কতটা অসহায়। ক্লাসরুম নিয়ন্ত্রণ করা যেন রীতিমতো যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করার মতো অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্লাসের সামনের সারির কিছু শিক্ষার্থী শিক্ষকদের কথা শুনলেও পেছনের দিকের সবাই নিজেদের ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় ব্যস্ত থাকে। বারবার অনুরোধ করার পরও দুই থেকে এক মিনিটের জন্য শান্ত হলেও শিক্ষক যখন আবার পড়াতে শুরু করেন তারাও আবার আগের মতো নিজেদের ইচ্ছেমতো আলাপচারিতায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
আমরাও তো একদিন ছাত্র ছিলাম। শিক্ষকেরা ক্লাসে এলে সবাই শান্ত হয়ে যেতাম। স্যার যা ক্লাসে বলতেন, তা–ই করতাম। আজকের এ উল্টো চিত্রের জন্য দায়ী কে?
ক্লাসে পড়া না পারা, অনিবার্য কোনো কারণে দেরিতে স্কুলে পৌঁছানো বা ছোট ভুলের জন্য জীবনে অসংখ্যবার শিক্ষকের ধমক বা বকা খেয়েছি, জোড়া বেতের ঘা খেয়েছি, সবার সামনে কান ধরে বেঞ্চের ওপর দাঁড়াতে হয়েছে, দুই আঙুলের মধ্যে পেনসিল ঢুকিয়ে চাপ দিয়ে হাতের আঙুল ব্যথা করে দিয়েছেন, কান টেনে লাল করে দিয়েছেন, চুলের কলি ওপরের দিকে টেনে ধরে পুরো কান ও মাথা ব্যথা করে দিয়েছেন। তারপরও শিক্ষকের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস করিনি কখনো। এমনকি বাড়িতে গিয়ে মা–বাবাকেও শাস্তির কথা ভয়ে এবং লজ্জায় বলতে পারিনি। আমাদের শিক্ষকদের দেখলে এখনো শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হয়ে আসে। যে শিক্ষা মানুষের আচরণের পরিবর্তন এনে দেয়, সে শিক্ষা আমরা প্রতিষ্ঠান থেকেই অর্জন করেছিলাম।
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা এমন হয়েছে যে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসতে চায় না। এলেও ক্লাসরুমে যেতে চায় না। ক্লাসরুমে যারা যায়, তারাও ক্লাস লেকচার শোনার প্রতি মনোযোগী না। লেকচার শোনার পরিবর্তে স্মার্টফোন ও ফেসবুক চ্যাটিংয়ে তারা অনেক বেশি মনোযোগী। বাড়ির কাজ দিলে সেগুলো তারা করবে না, প্রতিষ্ঠানের নিয়মকানুন মানতে চায় না, প্রতিষ্ঠানের সময় মেনে ক্লাসে আসবে না, শৃঙ্খলা মানবে না। এসব নিয়ে প্রশ্ন করলে দেখায় নানা অজুহাত। এমনকি এমন কিছু অভিভাবক আছেন, যাঁরা তাঁদের সন্তানদের পক্ষে নিজেরাই নানা অজুহাত দেখান। ব্যতিক্রম কিছু শিক্ষার্থী বাদে নিয়মিত লেখাপড়ার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহের জায়গা প্রায় শূন্যের কোটায়। অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানের রেজাল্ট নিয়ে ব্যস্ত; সন্তানের আচরণিক পরিবর্তনের চেষ্টা নেই বললেই চলে। শিক্ষার্থীদের শাসনব্যবস্থা তুলে নিয়ে আজ সব শিক্ষককে কাঠের পুতুল বানিয়ে রাখা হয়েছে। আজ আমরা শিক্ষার্থীদের ধমকের সুরে কথা বলতে পারি না। অনুরোধ করে বললেও তারা আমাদের পাত্তা দেয় না।
এ কী হলো? …আমরা কী করব? কীই–বা আমাদের শিক্ষকদের করার আছে? অন্তত শাসন করলেও কত ধরনের অপমান, অপদস্থ হওয়ার আশঙ্কা। আর কত দিন এভাবে চলবে...?
*লেখক: এম আরিফুজ্জামান, সিনিয়র শিক্ষক, ইন্দুরকানি মেহেউদ্দিন মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ইন্দুরকানি, পিরোজপুর।