নারী ও শিশু নির্যাতন: মানবাধিকারের সুরক্ষায় রাষ্ট্রের দৃঢ় অঙ্গীকার
বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন একটি গভীর সামাজিক সংকট, যা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এবং সমাজের সুস্থ বিকাশের পথে বড় বাধা। ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন, পারিবারিক সহিংসতা, শিশুশ্রম, পাচার, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মতো অপরাধ প্রতিনিয়ত আমাদের নৈতিকতা ও সভ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এই বাস্তবতায়, রাষ্ট্রের দায়িত্ব একমাত্র কঠোর আইন প্রণয়ন নয়, বরং তা কার্যকরভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাও জরুরি।
বাস্তব চিত্র ও চ্যালেঞ্জ
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের মাত্রা ক্রমে উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩ সালে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন, পারিবারিক সহিংসতা, শিশু নির্যাতন ও শিশুশ্রমের হার ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
শিশুদের ক্ষেত্রে নির্যাতন আরও জটিল রূপ নিচ্ছে। অপহরণ, পাচার, দেহব্যবসায় বাধ্য করা এবং শিশুশ্রম তাদের শৈশবের নিরাপত্তা কেড়ে নিচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত শিশুরা ভবিষ্যতে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠার ঝুঁকিতে রয়েছে, যা সামগ্রিকভাবে সমাজের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি।
রাষ্ট্রের আইন ও বিচারব্যবস্থা
নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকার বেশ কিছু কঠোর আইন প্রণয়ন করেছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩): নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধে এ আইন কার্যকর ভূমিকা রাখছে। তবে বাস্তব প্রয়োগে নানা চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে, যা আরও আধুনিক করার প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করেছে।
সাম্প্রতিক সংশোধনী (২০২৫): ২০২৫ সালের ১৭ মার্চ সরকার নতুন সংশোধনীতে ধর্ষণ মামলার তদন্তের সময়সীমা ৩০ দিন থেকে কমিয়ে ১৫ দিন এবং বিচারপ্রক্রিয়া ১৮০ দিনের পরিবর্তে ৯০ দিনে সম্পন্ন করার প্রস্তাব দিয়েছে। বিচারক প্রয়োজন মনে করলে ডিএনএ রিপোর্ট ছাড়াই মেডিকেল রিপোর্টের ভিত্তিতে রায় দিতে পারবেন।
শিশু আইন, ২০১৩: শিশুদের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিতের লক্ষ্যে এই আইন প্রণীত হলেও বাস্তবে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাব একে অনেকাংশে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২: এই আইন মানব পাচার প্রতিরোধ ও শাস্তির জন্য কার্যকর হলেও এর বাস্তবায়নে এখনো চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩: নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যুর বিরুদ্ধে এই আইন প্রণীত হলেও অনেক ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
সাইবার অপরাধ দমন আইন, ২০১৮: নারীদের বিরুদ্ধে অনলাইন সহিংসতা, ব্ল্যাকমেল ও সাইবার অপরাধ রোধে এই আইন কার্যকর করা হয়েছে।
পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০: পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধে এই আইন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড–সংক্রান্ত সংশোধনী (২০২০): ২০২০ সালে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নির্ধারণ করে আইন সংশোধন করা হয়, যা নারী নির্যাতন প্রতিরোধে একটি কঠোর পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়।
যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮: এই আইনের মাধ্যমে যৌতুক গ্রহণ, প্রদান এবং এর প্রচারণাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী, যৌতুক গ্রহণ বা প্রদান করলে সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।
আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতা
বাংলাদেশ জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ (UDHR), শিশু অধিকার সনদ (CRC) এবং নারী নির্যাতন প্রতিরোধবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি (CEDAW)-তে স্বাক্ষরকারী দেশ। ফলে নারী ও শিশুদের সুরক্ষায় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া কেবল অভ্যন্তরীণ প্রয়োজন নয়, বরং বৈশ্বিক দায়বদ্ধতারও অংশ। তবে এখনো দারিদ্র্য, সামাজিক কুসংস্কার ও আইনি দুর্বলতার কারণে বহু নারী ও শিশু তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব
নারী ও শিশু নির্যাতনের প্রভাব শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং এটি একটি জাতির সার্বিক বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। নির্যাতনের শিকার নারীরা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন, যা তাঁদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে স্থবির করে দেয়। শিশুদের ক্ষেত্রে এই নির্যাতন তাদের মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা ভবিষ্যতে তাদের সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে।
করণীয় ও নাগরিক দায়িত্ব
আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ করা সম্ভব।
শিক্ষা ও গণসচেতনতা বৃদ্ধি: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে নির্যাতন প্রতিরোধে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।
পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব: পরিবারের মধ্যে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও সহমর্মিতার মানসিকতা তৈরি করা অপরিহার্য।
কমিউনিটি পুলিশিং ও স্থানীয় উদ্যোগ: নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কমিউনিটি পর্যায়ে শক্তিশালী নজরদারি গড়ে তুলতে হবে।
মিডিয়ার দায়িত্ব: সংবাদমাধ্যমকে আরও দায়িত্বশীল হয়ে অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচনে কাজ করতে হবে, যাতে নির্যাতিত ব্যক্তি আরও অপমানিত না হন।
ভবিষ্যতের জন্য রাষ্ট্রের করণীয়
নারী ও শিশু নির্যাতন রোধে রাষ্ট্রকে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে-
১. আইনের কঠোর বাস্তবায়ন: দীর্ঘসূত্রতা পরিহার করে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা।
২. ভুক্তভোগীদের জন্য নিরাপদ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা: নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় ও মানসিক পুনর্বাসনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা।
৩. নারী ও শিশুবান্ধব পুলিশিব্যবস্থা: থানায় আলাদা সেবাকেন্দ্র স্থাপন করে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের দ্রুত সহায়তা দেওয়া।
৪. বিনা মূল্যে আইনি সহায়তা: দরিদ্র নারীরা যাতে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত না হন, তা নিশ্চিত করা।
নারী ও শিশু নির্যাতন রোধ কেবল রাষ্ট্রের একার দায়িত্ব নয়, বরং প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব। শুধু আইনের কঠোর প্রয়োগ নয়, বরং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং নৈতিক মূল্যবোধের পুনর্গঠনই পারে একটি নিরাপদ, সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে। এখন সময় দায়িত্ব গ্রহণের, সোচ্চার হওয়ার এবং নারীর প্রতি সম্মান ও শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার।
লেখক
মো. জাহাঙ্গীর আলম
সহকারী শিক্ষক, কোন্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উপজেলা- সাভার, জেলা- ঢাকা
‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]