বাবার সঙ্গে শৈশবের ঘোরাঘুরির স্মৃতিই বেশি মজার

বাবাকে নিয়ে লেখার শুরুতেই একটা সুন্দর বিষয় শেয়ার করতে মন চাইল। আমি পড়াশোনা করেছি সিলেটের স্বনামধন্য ব্লু বার্ড উচ্চ বিদ্যালয়ে। একই স্কুলে শিক্ষকতা করতেন আমার বাবা নিকুঞ্জ বিহারী দাস। শিক্ষার্থী ও অভিভাবক ছাড়াও সিলেটে বাবা পরিচিত ছিলেন 'নিকুঞ্জ স্যার' নামে। বাবা মূলত ছিলেন গণিতের শিক্ষক, বিজ্ঞান বিষয়টিও পড়াতেন। এই স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষকদের সম্মাননা দিলেন ২৫ এপ্রিল, ২০২৫ তারিখে। বাবা-মা বেঁচে নেই, তাই জন্ম শহর সিলেট আমার যাওয়া হয় না ইদানীং। তাই উক্ত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারি নি। বাবার সম্মাননা স্মারকটিও আনা হয়নি। আমার স্কুলের এক ব্যাচ সিনিয়র ভাই আসিফ খান গত ২৩ মে সম্মাননা স্মারক ও মগ পৌঁছে দিয়ে গেলেন। আসিফ ভাইয়ের সাথে অনেক আড্ডা হল। সেদিন উপলব্ধি করলাম, জীবন আসলেই সুন্দর। অনেক গর্ব হয় বাবাকে নিয়ে। ভালো থাকুক বাবার সব শিক্ষার্থীরা।

বাবার মাধ্যমেই জীবনে অনেক ভালো ভালো অভ্যাস আয়ত্ত করতে পেরেছি। এর মধ্যে আছে পত্রিকা, বই ও ম্যাগাজিন পড়া। ছোটবেলা থেকেই একাডেমিক বইয়ের বাইরে অন্যকিছু পড়েছি বলেই না দুই-এক লাইন লিখতে পারি। আমার মুক্তমনা হওয়ার পেছনে বেড়ে ওঠার অবদান তো আছেই।

শৈশব-কৈশরে বাবা নিয়ে যেতেন নতুন কুঁড়ি, জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন সংগীত প্রতিযোগিতায়। পুরস্কার পেলে বাবার আগ্রহ আরও বেড়ে যেত। ছোটবেলাতেই গান শেখা হয়েছে বাবার কারণেই। আজকেও তাই গানই আমার প্রথম ভালোবাসা।

১৯৯৪ সালে বাবা ঠিক করলেন ভারতে যাবেন চোখের চিকিৎসা করাতে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে চোখে ইন্টারনাল ব্লিডিং হয়। সানন্দায় চোখের চিকিৎসা বিষয়ক ফিচার পড়ে উনি মাদ্রাজের (বর্তমান চেন্নাই) শঙ্কর নেত্রালয়ে চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ করেন। যেহেতু তখন মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ছিল না। কিছুদিনের ভেতরেই চিঠির উত্তর পান ও  সেখানে চিকিৎসা নিতে যান। হলুদাভ গায়ের রঙ আর টিকোলো নাকের আমার বাবা দেখতে কোন প্রিন্সের চেয়ে কম সুন্দর ছিলেন না। সিলেটের বাইরে কোথাও গেলেই বাবা আমার জন্য নতুন কোন পোশাক নিয়ে আসতেন।

বাবা বাজার করতে খুব পছন্দ করতেন। দামের তোয়াক্কা করতেন না। বাবার কারণেই আমি বিভিন্ন ধরণের মাছ খেয়েছি, শাক-সবজি খেয়েছি। বয়স ধরে রাখার জন্য দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাস একটা মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রায় প্রতিদিনই আমি মাছ খাই। এখন চলছে ফলের মৌসুম। আমাদের ছেলেবেলায় ঝুড়ি (টুকড়ি) ভর্তি করে আম আসতো বাসায়।

বাবা ছিলেন সৎ। খুব সহজ-সরল ভালো মানুষ। বৈষয়িক চিন্তা বাবার মধ্যে ছিলনা। সাধারণ জীবন যাপন করতেন। ছিলেন শান্ত স্বভাবের। আমার সহজ-সরল মানসিকতা ও সাধারণ জীবন যাপন বাবার কাছ থেকেই পেয়েছি।

বাবার সাথে কত শত স্মৃতি। একসাথে স্কুলে যাওয়া, বইমেলা, বৈশাখী মেলা ও শহীদ মিনারে যাওয়া। প্রথম কলকাতা গিয়েছি বাবার সাথে ২০০১ সালে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য সফর ছিল ২০০২ সালে বাবা-মার সাথে মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরে যাওয়া। ত্রিপুরা আর আসাম তো কয়েকবার গিয়েছি। ঘোরাঘুরি টা আমার শখ। নিত্য-নতুন জায়গায় ঘুরে বেড়াই। কিন্তু শৈশবের ঘোরাঘুরির স্মৃতিই বেশি মজার।

বাবা দিবসে বেশি বেশি মনে পড়ছে বাবাকে। সব বাবারা ভালো থাকুক। আর যেসব বাবারা বেঁচে নেই, তারা পরপারে শান্তিতে থাকুক। ২০ সালের অক্টোবরে করোনায় বাবা-মাকে হারিয়েছি। করোনার প্রকোপ আবার বাড়ছে। সবাই সাবধানে থাকুক, বিশেষ করে বয়স্ক ব্যক্তিরা।

'সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে,   

শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, 

শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।'

*লেখক: অদিতি দাস, সংস্কৃতিকর্মী