সিনাকি হৈ ভাল লাগিল: দ্বিতীয় পর্ব
কোর্টের কাজ শুরু হল। বেশ একটা উত্তেজনা ভাব। মাঝবয়সি দুজন ভদ্রলোক বসেছেন একেবারে সামনের সারিতে। শ্রাবণী তাঁদের প্রায় সব কথাই শুনতে পাচ্ছে। তাঁরা বলাবলি করতে লাগল—
‘আচ্ছা, এ তো নতুন উকিল। বয়স কম। পারবে তো। আগে তো তেমন কেস লড়েনি শুনলাম।’
‘আরে পারবে কি বলছ, রীতিমতো দৌড়াবে। দেখই না কি হয়। যেভাবে সওয়াল করছে। আমার পূর্ণ আত্মবিশ্বাস আছে এ ছেলের ওপর।’
কোর্টের কারবারি বাংলাতেই হচ্ছে। জজ সাহেব নিজেও বাঙালি। ভারি সৌম্য চেহারা। বেশ মনোযোগ দিয়ে সওয়াল-জবাব শুনছেন।
মৃণ্ময় সেন বলতে আরম্ভ করলেন, ‘মাই লর্ড, আমি বুঝতে পারছি না এই কেস নিয়ে এতো সময় দেওয়ার কি আছে। ১২ বছর আগে এ আদালতে দাঁড়িয়ে আমি যা বলেছিলাম, আজও আমি তা–ই বলছি। এই প্রশান্ত চ্যাটার্জি একজন ঠান্ডা মাথার খুনি। তিনিই দেবলীনা দেবীকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন। ইটস জাস্ট অ্যা সিম্পল কেস অব মার্ডার। কেন এটা নিয়ে এতো জলঘোলা হচ্ছে, তা আমার বোধগম্য নয়।’
‘মাই ডিয়ার লার্নেড ফ্রেন্ড সবকিছুতেই বেশ তাড়াহুড়া করেন। এত জলদি কি কিছু হয়। ধৈর্য রাখুন, সবুরে সবকিছুর উত্তর মিলবে।’ মর্তুজা পাল্টা জবাব দিল।
‘অবজেকশন, মাই লর্ড। আদালত কোনও ঠাট্টা-মশকরা করবার জায়গা নয় যে উনি যা খুশি তাই বলবেন। উনি মহামান্য আদালতের মূল্যবান সময় বরবাদ করছেন।’ মৃণ্ময় সেন আচমকা ক্ষেপে উঠলেন।
‘অবজেকশন সাসটেইন্ড। মিস্টার মর্তুজা, আপনি এভাবে আদালতের সময় নষ্ট করতে পারেন না। আপনার কি কিছু বলবার আছে?’ মহামান্য বিচারক কড়া হুঁশিয়ারি দিলেন।
‘ইয়েস, ধর্মাবতার। আমি সাক্ষী বীণা রায়কে একবার উইটনেস বক্সে আসবার জন্য অনুরোধ করছি।’ মর্তুজা আদালতের কাছে অনুমতি চাইল।
জজ সাহেব মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন।
এখানে বীণা রায়ের পরিচয়টা দিয়ে রাখা ভাল। এই বীণা রায় ১২ বছর আগে প্রশান্তর সঙ্গে দেবলীনার পরিচয় করান। সে-ই প্রথম প্রশান্তকে দেবলীনা দেবীর বাড়িতে নিয়ে আসে।
‘সাক্ষী বীণা রায় হাজির। গীতা ছুঁয়ে বলুন, যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য বই মিথ্যা বলিব না।’ বীণা রায় গীতা ছুঁয়ে শপথ করলেন।
মর্তুজা সওয়াল শুরু করলো। ‘বীণা দেবী, ১২ বছর আগে এ আদালতে আপনি আমার মক্কেল প্রশান্ত চ্যাটার্জির বিরুদ্ধে জবানবন্দি দিয়েছিলেন।’
মর্তুজা বীণা রায়ের ব্যাপারে স্টাডি করেছে। সে জানতে পারে, এ বীণা হল দেবলীনার স্বামী কৌশিকের অফিস সহকর্মী। তাঁরা একই জায়গায় একসময় কাজ করত। যদিও লোকে বলে তাঁদের সম্পর্কটা নাকি অনেক দূর পর্যন্ত গড়িয়েছিল। দেবলীনা অবশ্য শুরু থেকেই বীণাকে বিশেষ পছন্দ করত না। এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে কৌশিকের বেশ কয়েকবার রেষারেষিও হয়েছে।
মর্তুজা আবার বলতে আরম্ভ করল, ‘মাই লর্ড, দেবলীনা দেবীর পোস্টমর্টেম রিপোর্টে স্পষ্ট বলা আছে, মৃত্যুর সময় তিনি ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। আচ্ছা বীণা দেবী, আপনি যেদিন প্রথম প্রশান্ত বাবুকে দেবলীনা দত্তের বাড়ি নিয়ে যান, সেদিন তারিখটা ঠিক কি ছিল আপনার মনে আছে নিশ্চয়।’
‘একদম মনে আছে। সেদিন ছিল ফেব্রুয়ারি মাসের পাঁচ তারিখ, ২০০১ সাল। সেদিনই আমি প্রথম প্রশান্ত চ্যাটার্জির সঙ্গে দেবলীনার সাক্ষাৎ করাই এবং এর আগ পর্যন্ত এদের দুজনের মধ্যে কোনো চেনা-জানা ছিল না। আচ্ছা, কেন বলুন তো?’ বীণা রায় সাত-পাঁচ না ভেবেই গড়গড় করে সব বলে দিল।
‘ধর্মাবতার, আমরা জানি অঙ্কশাস্ত্র নির্ভুল শাস্ত্র। আর এ শাস্ত্র কখনো ভুল বলে না। দেবলীনা দেবীকে যেদিন খুন করা হয়, সেদিন ছিল ২০০১ সালের জুন মাসের সাত তারিখ। তাহলে, প্রশান্ত বাবুর সঙ্গে দেবলীনা দেবীর পরিচয়টা দাঁড়ালো কেবল চার মাসের। তাহলে আলাপ যেখানে মাত্র চার মাস, মানে ১২০ দিনের, সেখানে দেবলীনা দেবীর ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বার জন্য আমার মক্কেল প্রশান্ত চ্যাটার্জি কোনোভাবেই দায়ী হতে পারেন না।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে মর্তুজা থামল।
প্রতিপক্ষের উকিল মৃণ্ময় বাবু চেঁচিয়ে উঠলেন। ‘অবজেকশন, মাই লর্ড। বিবাদী পক্ষ আদালতের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরাতে চাইছে। এসব বাকোয়াজ।’
‘অবজেকশন ওভাররুলড। মৃণ্ময় বাবু আপনি চুপ করে বসুন। আদালতের কাজে বাধা দেবেন না।’ জজ সাহেব মৃণ্ময় সেনকে থামিয়ে দিলেন।
‘স্যরি, মাই লর্ড। ড্যাম ইট।’ মৃণ্ময় সেন বসে পড়লেন। অস্ফুট স্বরে বললেন, ‘হিসাবের কড়ি বাঘে খায় না।’
মর্তুজা মৃণ্ময় বাবুর কথা শুনে ফেলল। ‘কিন্তু হিসাবের কড়ি আপনি আজ থেকে ১২ বছর আগে গলাবাজি করে এই মহামান্য আদালতের সামনে বাঘ দিয়েই খাইয়েছিলেন, মৃণ্ময় সেন।’ মর্তুজা কেসের মোড় ঘুরিয়ে দিলো।
কোর্ট রুমে শোরগোল পড়ে গেল। সবাই বলাবলি করতে লাগলো—
‘কি ছেলে রে বাবা! এমন একজন ঘাগু লইয়ারকে ঘোল খাইয়ে দিল।’
‘হ্যাঁ, যা বলেছ। ছেলে বটে একখানা।’
‘অর্ডার, অর্ডার। সাইলেন্স ইন দ্য কোর্ট প্লিজ। অ্যাডভোকেট সেন, এটা আমি আপনার কাছ থেকে আশা করিনি। আপনি মিথ্যা সাক্ষীর বয়ান দিয়ে আদালতকে বিভ্রান্ত করেছিলেন। ইটস নাথিং বাট অ্যা ক্রাইম। আপনি যদি ভবিষ্যতে আবার কোনো ছলনার আশ্রয় নেন, এই আদালত আপনার বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিয়ে বাধ্য হবে।’ কথাগুলো শেষ করেই মহামান্য বিচারক রায় শোনালেন। অবশেষে সত্যের জয় হল। শ্রাবণী আনন্দে তাঁর বাবা প্রশান্তকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। প্রশান্ত বাবু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন তাঁর মেয়ের দিকে। গোটা কোর্ট সাক্ষী হয়ে রইলো বাবা-মেয়ের এই দুর্লভ আবেগঘন মুহূর্তের! চলবে...
লেখক: আসিফ আল মাহমুদ, স্নাতকোত্তর, শিক্ষার্থী
নাগরিক সংবাদ-এ ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]