জিমির পুতুলের সংসার
খুব ছোট্ট একটা মেয়ে, নাম জিমি। এখন বয়স তার মাত্র চার বছর, কিন্তু বয়স তার কম আর সে দেখতে ছোট হলে কী হবে, তার ছোট মুখে টরটর করে পাকা পাকা কথা বলা শুনলে মনে হবে, পুরো আস্ত একটা পাকা বুড়ি। জিমি দেখতে যেমন মিষ্টি কিউটের ডিব্বার মতো, তেমনি তার তোতা পাখির মতো শুনতে লাগে ছোট কচি মুখের প্রাণজুড়ানো মিষ্টি মধুর নৈপুণ্য অঙ্গভঙ্গিময় মিশ্রণ কথা। তার কচি মুখের সে কথা শুনলে যে গোমড়া মুখী, সে-ও না হেসে থাকতে পারবে না। ভোর থেকে শুরু করে রাতে ঘুমানোর আগপর্যন্ত তার মুখে যেন মিষ্টি কথার খই ফুটতেই থাকে। সারা দিনভর হাসি-আনন্দ, লাফঝাঁপ, দৌড়াদৌড়ি, ছোটাছুটি আর হইহুল্লোড় করে সে একাই যেন পুরো বাড়িটা মাতিয়ে রাখে।
তার মুখে যে শুধু কথার ফুলঝুরি ফোটে তা-নয়। জিমির আছে ছোট্ট একটা সংসার। ‘রাজা আর রানি’ নামের দুটি পুতুল নিয়ে তার সেই ছোট্ট সংসারটার নাম পুতুলের সংসার। সে সারা দিনভর তার সেই পুতুল দুটিকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে। কখনো তাদের মিছামিছি গোসল করাই। গা মুছে তাদের মাথায় গায়ে তেল মাখায়। মাথার চুল আঁচড়ায় দিয়ে সাজিয়ে দেয়। আদর করে ঘুম পড়ায়। আবার কখনো পুতুল দুটিকে তার কোলে দুই পাশে দুটি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
আর তার সেই সংসারে পুতুলের পাশাপাশি আছে জিমির বড় ভাইয়া মুরসালিনের দেওয়া রান্নাবান্না করার জন্য নানা রকমের ছোট ছোট খেলনাসামগ্রী। যেমন গ্যাসের চুলা, হাঁড়িপাতিল, কলস, গ্লাস, থালাবাসন, ঘর সাজানোর শোকেস, ফ্রিজ, সোফাসহ আরও নানা রকমের আসবাব। আর চার বছরের সেই ছোট্ট মেয়ে জিমি তার সেই সংসার রীতিমতো একজন দক্ষ সাংসারিক রমণীর মতো সারা দিন দুই হাতে সামলায়। দিনভর সে মেতে থাকে তার সেই খেলনা সংসারের কাজকর্ম রান্নাবান্না, এটা-ওটা নিয়ে। কখনোবা সে তার সাংসারিক জিনিসপত্র নিয়ে সংসারটা সাজায় সিঁড়ির ঘরে। ছাদে ওঠা-নামার নিচের সিঁড়িতে। আবার কখনো বাইরে থেকে ঘরে ওঠা-নামার পাটনির ওপর। আবার কখনো উঠান-আঙিনার এক কোণে লিচুগাছের তলায়।
সকাল হতেই জিমি প্রতিটা দিন রান্না করার জন্য বাড়ির আঙিনার পেয়ারাগাছের তলায় ঘুরে ঘুরে গাছ থেকে ঝরে পড়া ছোট ছোট পেয়ারার গুটি খুঁটে খুঁটে একটি পাত্রে রাখে। ইটের কুচিগুলো কুড়িয়ে রাখে অন্য পাত্রে। আর ধুলাবালু, জল রাখে আরেক পাত্রে। তারপর দুপুর হলে তার মা সুলতানা বেগম যখন রান্নাঘরে রান্না করে। তখন সে তার খেলনা রান্নাঘরে বসে সেগুলো তার গ্যাসের চুলার ওপর রেখে বসে চামচ দিয়ে নেড়ে নেড়ে রান্না করতে থাকে।
আবার কখনোবা জিমি রান্নার ফাঁকে তার পুতুল দুটিকে সোফায় পাশাপাশি বসিয়ে রাখে। আবার কখনো শুইয়ে রাখে। আর মাঝেমধ্যে তাদের সঙ্গে আপনমনে কথা বলে। কিরে, তোদের খিদে লাগছে? চুপ কর, কান্দিসনে, এই রান্না হয়ে গেছে, এক্ষুনি ভাত দিচ্ছি। আবার কখনো কখনো পুতুল দুটির বুকের ওপর আলতো হাত রেখে চুপ করতে বলে আদর করে।
জিমির আব্বু জীবন আহমেদ এদিক-সেদিক থেকে কাজকর্ম করে বাড়িতে এসে যখন ডাক দেয়, ও মা জিমি...আমার মা কই? জিমি সঙ্গে সঙ্গে তার জায়গা থেকে সাড়া দেয় কি...এই যে আমি। জীবন আহমেদ আবার বলে, মাগো কী করছ তুমি? জিমি উত্তর দেয়, দেখতে পাচ্ছো না...আমি রান্না করছি। জীবন আহমেদ বলে, ও তাই...তা বেশ, আমার মা জননী কি রান্না করছে শুনি? জিমি হেসে বলে, ভাত, গোশত আর ডাল রান্না করছি। তুমি খাবা আব্বু?
জমির আম্মু সুলতানা বেগম রান্নাঘর থেকে শুনে হাসতে হাসতে বলে, নাও, তোমার মা জিমি গোশত রান্না করেছে খেয়ে নাও। আজ আর তোমার আমার রান্না না খেলেও চলবে। জীবন আহমেদ বলে, বা-রে আমার জিমি মা রান্না করেছে আর আমি খাব না, তা-ই কি হয়?
নিয়ে এসো মা জিমি আমার খুব খিদে লেগেছে।
জীবন আহমেদের কথা শেষ হতেই অমনি জিমি বলে, খিদে লেগেছে...ভাত খাবা? বসো, আমি তোমার জন্য ভাত নিয়ে আসছি। তারপর মিচমিচ করে হাসে আর তড়িঘড়ি করে ধুলাবালু জলের তৈরি ডাল। আর ইটের কুচির তৈরি ভাত। পেয়ারার গোটার তৈরি মাংস প্লেটে নিয়ে হাজির হয়। তারপর বলে, এই নাও খেয়ে দেখো আব্বু, কী মজা। জীবন আহমেদ হাসিমুখে দুহাত বাড়িয়ে সেগুলো নেয়।
তারপর মিছামিছি মুখের কাছে নিয়ে খায়। জীবন আহমেদ বলে হুম....তাই তো, ভীষণ মজা লাগছে, মা। শুনে জিমি তো খুব খুশি হয়। বলে, আমি রান্না করেছি। মজা লাগছে, তাই না, আব্বু? জীবন বলে হুম...খুব মজা লাগছে, মা। জিমি বলে, আরেকটু এনে দেব আব্বু? জীবন আহমেদ বলে দাও...জিমি আবার দৌড়ে গিয়ে এনে দেয়। জীবন আহমেদ মিছিমিছি খাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে। জিমি বলে পেট ভরে গেছে আব্বু?
জীবন আহমেদের মিছে সে খেলনা খাবার খেয়ে পেট না ভরলেও মেয়ে জিমির নিষ্পাপ মুখের স্বর্গীয় সেই বিশ্বজয়ী পরিতৃপ্তির উচ্ছ্বাসে ভরা হাসি দেখে অন্তরটা যেন সেই মুহূর্তে ভরে যায়। জীবন সে তার পেট দেখিয়ে বলে হুম...পেট একেবারে ভরে গেছে, মা।
জিমি বলে, দাঁড়াও, তোমার জন্য পানি এনে দিচ্ছি আব্বু। এসব দেখে জিমির ছোট ভাইয়া মুত্তাকিন দূর থেকে মিচমিচ করে হাসতে থাকে। জিমি বলে, তুই হাসছিস কেন? তারপর জীবন আহমেদের কাছে নালিশ করে। বলে, আব্বু ওই দেখো, ভাইয়া হাসছে। জীবন আহমেদ বলে, এই মুত্তাকিন, তুই হাসছিস কেন? আর হাসিস না যেন। জিমি খুশি, সে দৌড়ে গিয়ে তার আব্বুর জন্য পানি এনে দেয়।
জীবন আহমেদ আবার তা মুখের কাছে নিয়ে মিছামিছি খায়। এভাবে প্রতিটা দিন জিমির বাবা-মা, ভাই আর তার খেলনা সংসারের সদস্য রাজা-রানি পুতুল দুটি আর হাঁড়িকুঁড়ি নিয়ে বেশ হাসিখুশির মধ্য দিয়েই চলতে থাকে ছোট্ট কচি মনের জিমির সাজানো-গোছানো খেলনা সেই ছোট্ট পুতুলের সংসারটি।
যদিও সবার কাছে সেটা খেলনা সংসার। তবু চার বছরের ছোট্ট মেয়ে জিমির সেই কচিমনের সাজানো সংসারটা যেন পৃথিবীর সব মানুষের দৈনন্দিন হাসি-আনন্দ ও কান্নার মিশ্রণ জীবনযাত্রার বাস্তবতারই এক প্রতিচ্ছবি।