পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে শিক্ষকদের অনীহা নিয়ে দুটি কথা!
গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে শিক্ষকদের অনীহা নিয়ে বিভিন্ন লেখালেখি দৃষ্টিগোচর হওয়ায় দুটি কথা বলার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি।
খাতা মূল্যায়নে অনিহার কারণসমূহ :
প্রথমত, শিক্ষাবোর্ডগুলো খাতা মূল্যায়নের সম্মানীসহ যাবতীয় খরচাদি শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে আদায় করে পাবলিক পরীক্ষা আরম্ভ হওয়ার কমপক্ষে তিন মাস আগে। পরবর্তী মাসখানেকের মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের পরীক্ষা শেষে শিক্ষকেরা খাতা মূল্যায়নের কাজ করেন। খাতা মূল্যায়ন পরবর্তী দুই মাসের মধ্যে ফলাফল প্রকাশিত হয়। এরপর প্রায় এক মাসের মধ্যে শিক্ষার্থীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে খাতা পুনর্মূল্যায়ন করে ফলাফলের যাবতীয় কার্যক্রম শেষ হয়।
অর্থাৎ শিক্ষকদের খাতা মূল্যায়নের তিন মাসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার যাবতীয় কার্যক্রম শেষ হয়। ততক্ষণে বোর্ডের কাছে সম্মানীর টাকাগুলো জমা থাকে প্রায় সাত মাস। কিন্তু খাতা মূল্যায়নের সম্মানী দেওয়া হয় পরবর্তী বছর পরীক্ষা আরম্ভ হওয়ার পর! ততক্ষণে শিক্ষকদের খাতা মূল্যায়নের বয়স হয় এক বছর এবং বোর্ডের কাছে জমা থাকে বাড়তি আরও আট মাসসহ সর্বমোট ১৫ মাস!
জানতে খুব ইচ্ছে হয়, সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার যাবতীয় কার্যক্রম শেষ করার সাথে সাথে সম্মানী বণ্টন করা হয় না কেন? বাড়তি আট মাস কী জন্য বোর্ডের কাছে থাকতেই হবে?
দ্বিতীয়ত, প্রতি বছর শিক্ষাবোর্ডগুলো শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে ফরম পূরণের সময় টাকা বাড়িয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। কিন্তু শিক্ষকদের খাতা মূল্যায়নের সম্মানী প্রতি বছর বাড়ানো হয় না। বাড়াতে যেয়ে অনেকসময় পাঁচ সাত বছর লেগে যায়। কারণ কী? বোর্ডগুলো শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে যদি ফি বাড়িয়ে আদায় করে তাহলে এর ভাগ অবশ্যই খাতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে থাকা উচিৎ নয় কি?
তৃতীয়ত, প্রায় ১৫ মাস ধরে যে টাকাগুলো শিক্ষাবোর্ড জমা থাকে তা নিশ্চয়ই কোনো ব্যাংকেই থাকে। সেখান থেকে অবশ্যই একটি লভ্যাংশ আসে। শিক্ষকেরা কি সে লভ্যাংশ ভোগ করেন? করতে পারেন? পারেন না! তাহলে সেগুলো কোথায় যায়! মূলত লভ্যাংশ ভোগ করার জন্যই শিক্ষকদের সম্মানীর টাকা আটকে রাখা হয় সেটা কি বলা যায় না? বললে কি অবান্তর হবে? যদি অবান্তরই হয় তাহলে যথাসময়ে শিক্ষকগণ সম্মানী পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কোন কারণে?
চতুর্থত, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বা আঞ্চলিক অফিস থেকে খাতা আনতে গেলে তারা আগে থেকেই তাদের নির্ধারিত বস্তায় সুন্দর করে গুছিয়ে রাখেন। গাড়ি নিয়ে যাওয়া মাত্রই তাদের নির্ধারিত শ্রমিক দিয়ে গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়। এর বিনিময়ে শিক্ষকেরা তাদের কিছু বকশিসও দিয়ে থাকেন। কিন্তু শিক্ষাবোর্ডে খাতা বিলি করার সময় আমি অনেকবার দেখেছি শ্রমিকেরা খাতা দেওয়ার সময় শিক্ষকেরা নিজেদের বাসা থেকে বস্তা নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। খাতা পাওয়ার পর অনেকেই সেগুলো টানাহেঁচড়া করে রাস্তা পর্যন্ত নেন। এক-দুজন শ্রমিক থাকলেও তাদের দ্বারা সবার কাজ করানো সম্ভব হয় না। শ্রমিকদের সামনে দিয়ে বস্তা টানাটানির ব্যাপারটি একজন শিক্ষক হিসেবে আমি মেনে নিতে পারি না। এটা রীতিমতো অসম্মানজনকও বটে! পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন অনেক অনেক সম্মানের। তাই বলে শিক্ষকের দ্বারা বস্তা টানাটানি কি শোভন দেখায়?
এখানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বোর্ড কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের কাছ থেকে দাম কেটে রাখা সাপেক্ষেও একটি বস্তার ব্যবস্থা করতে পারতেন! করলে ভালো হতো। শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়ানোর মাধ্যমে গাড়িতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থাটা রাখলেও খারাপ হতো না। আমি বুঝিনা এত বড় বড় মাপের শিক্ষকগণ শিক্ষাবোর্ডগুলোতে চাকরি করছেন অথচ এ বিষয়টি কারও নজরেই পড়ে না! বিশেষ করে সিলেট শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে উদাসীনই মনে হয়।
সমস্যা সমাধানে করণীয় :
বর্তমান বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশের চর্চায় সবকিছুতেই ইতিবাচক পরিবর্তন দরকার। আমার মনে হয় শিক্ষাবোর্ডগুলো পরীক্ষার যাবতীয় কার্যক্রম শেষে সম্মানী পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে। এ বিষয়টি নিশ্চিত করলে আশা করা যায় খাতা মূল্যায়নে শিক্ষকদের অনিহা অনেকটাই কমে আসবে। পাবলিক পরীক্ষা খাতা মূল্যায়ন একটি জাতীয় দায়িত্ব। সবাইকে তা প্রতিপালন করা অত্যন্ত জরুরি এতে কোনো সন্দেহ নেই। শিক্ষকগণের কর্মের যথাযথ মূল্যায়নের মাধ্যমেই সেটা শতভাগ বাস্তবায়ন সম্ভব।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষকগণের মাধ্যমেও যে ব্যত্যয় ঘটে তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। শিক্ষকগণকেও সে বিষয়টিও মাথায় রাখা প্রয়োজন। সবার সম্মিলিত প্রয়াসে শিক্ষাক্ষেত্র এগিয়ে যাক সে প্রত্যাশা রাখছি।
*লেখক: মো. শরীফ উদ্দিন আহমেদ, প্রভাষক, বিশ্বনাথ সরকারি কলেজ