সমন্বিত বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা কেন প্রয়োজন

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষাফাইল ছবি

মানবসভ্যতার বিকাশের ফলে মানুষের জ্ঞান ও বিজ্ঞান চর্চার জন্য নানা রকম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। যুগের চাহিদা অনুযায়ী মানুষের উচ্চশিক্ষা ও উচ্চতর গবেষণার প্রয়োজন হলে নানা দেশে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন চলাকালে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তৎকালীন পূর্ববাংলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা হয়। পূর্ববর্তী ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশে গুটিকয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলেও তা ছিল চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হলে নির্মিত হয় বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা ছিল না কিন্তু শিক্ষার হার ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ৫৫টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে সাধারণ, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, চিকিৎসা, কৃষি ও বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।

২০২০ সালে কোভিডের আগে সব বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষা নিয়েছিল। কিন্তু কোভিডের পর ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষা নিলেও গুচ্ছপদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া শুরু করে দেশের অন্য নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এতে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছপদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং তা কার্যকর করে। বর্তমানে বেশ কয়েকটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় ও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছপদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসায় তা ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। যেখানে দেশের মেডিকেল কলেজ, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুচ্ছপদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেবে, সেখানে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় ও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে গড়ে ওঠা জিএসটি ভর্তি পরীক্ষা ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হওয়ায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে চরম হতাশার সৃষ্টি করেছে। আমেরিকায় ‘স্যাট’ (SAT)’ ও এসিটি (ACT) নামক সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়। অস্ট্রেলিয়ায় ‘অস্ট্রেলিয়ান টারশিয়ারি অ্যাডমিশন র‍্যাঙ্ক’ (ATAR) নামক একটি সমন্বিত স্কোরিং সিস্টেম রয়েছে, যা উচ্চশিক্ষায় ভর্তির জন্য ব্যবহৃত হয়। রাশিয়ায় ‘ইউনিফায়েড স্টেট এক্সামিনেশন’ (Unified State Examination) নামক একটি সমন্বিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, যা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ব্যবহৃত হয়। যুক্তরাজ্যে কিছু বিষয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়, যেমন মেডিকেল কোর্সের জন্য ‘ইউনাইটেড কিংডম ক্লিনিক্যাল অ্যাপটিটিউড টেস্ট’ (UKCAT)। ইরানে ‘কোনকুর’ (Konkur) নামক একটি জাতীয় স্তরের সমন্বিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ফ্রান্সে উচ্চশিক্ষায় ভর্তির জন্য ‘ব্যাচেলর’ (Baccalauréat) নামক সমন্বিত পরীক্ষা নেওয়া হয়। জাপানে ‘ন্যাশনাল সেন্টার টেস্ট ফর ইউনিভার্সিটি অ্যাডমিশন’ (National Center Test for University Admissions) নামক সমন্বিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় ‘সুনুং’ (Suneung) বা ‘কোলেজ স্কলাস্টিক অ্যাবিলিটি টেস্ট’ (CSAT) নামক একটি সমন্বিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। চীনে ‘গাওকাও’ (Gaokao) নামক একটি জাতীয় স্তরের সমন্বিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিবেশী দেশ ভারতে কিছু ক্ষেত্রে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়, যেমন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জন্য ‘জয়েন্ট এনট্রান্স এক্সামিনেশন’ (JEE) এবং মেডিকেলের জন্য ‘ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি কাম এনট্রান্স টেস্ট’ (NEET)। এ ছাড়া বিশ্বের আরও অনেক নামীদামি দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি রয়েছে। তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে তাদের আন্তর্জাতিক অবস্থান অনেক ওপরে এবং গবেষণার দিক থেকে বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের ধারেকাছেও নেই। বিশ্বের সব দেশে শিক্ষা সেবা খাত হিসেবে বিবেচিত হয়, আর বাংলাদেশে কেবল কাগজে–কলমে শিক্ষা খাতে তা সীমাবদ্ধ রেখে এর অন্তরালে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায় খাতে পরিণত হয়েছে। সংবিধানের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে ‘সবার জন্য শিক্ষা’ কথাটি লিপিবদ্ধ থাকলেও গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষার জন্য ফরম ক্রয় করা কষ্ট হওয়ায়, সেটির বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। যদি ‘সবার জন্য শিক্ষা’ কথাটি বাস্তবায়ন করতে হয়, তাহলে শিক্ষাকে ব্যবসা হিসেবে গণ্য না করে, সেবা হিসেবে গণ্য করতে হবে।

২০২০-২১ সেশন থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে ভর্তি পরীক্ষা দিতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের জন্য তৎকালীন সরকার গুচ্ছপদ্ধতি চালু করায় আর্থিক ব্যয় ও হয়রানি কম হওয়ায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জন্য সন্তোষজনক ছিল। গুচ্ছপদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ায় শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের ভোগান্তি, থাকা–খাওয়ার সমস্যা হতো না। এটি বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য বেশ সুবিধাজনক ছিল। আবার একই দিনে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার ঝামেলা ছিল না। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতিতে কিছু অসুবিধা থাকলেও তার চেয়ে বেশি গুণ সুবিধা ছিল। এতে একটি ফরমে সব কটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ায় শিক্ষার্থীদের কম অর্থ খরচ হতো। কিন্তু তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদন ফি শিক্ষার্থীবান্ধব হওয়ায় তুলনামূলক কম মুনাফা পেয়েছিল গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।

আরও পড়ুন

বর্তমানে গুচ্ছপদ্ধতি থেকে বেরিয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ২০২৪-২০২৫ সেশনের ভর্তি পরীক্ষার আবেদন ফি Unit A1 বিজ্ঞান ১ হাজার ২৫০ টাকা, Unit A2 বিজ্ঞান+আর্কিটেকচার ১ হাজার ৪০০ টাকা ও Unit B বিজ্ঞান+মানবিক+বাণিজ্য ১ হাজার ২০০ টাকা। অথচ গুচ্ছপদ্ধতি পরীক্ষার আবেদন ফি ২০২৩-২০২৪ শিক্ষাবর্ষে গুচ্ছভুক্ত ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে ভর্তির জন্য আবেদন ফি ছিল ১ হাজার ৫০০ টাকা। এদিকে বাংলাদেশের প্রধান চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে ভর্তির জন্য আবেদন ফি প্রতিবছর নির্ধারিত হয়।

২০২৩-২০২৪ শিক্ষাবর্ষের জন্য এ ফিগুলো ছিল নিম্নরূপ—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: আবেদন ফি ১ হাজার ৫০ টাকা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি): আবেদন ফি প্রতি ইউনিটের জন্য ৯০০ টাকা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: আবেদন ফি প্রতি ইউনিটের জন্য ৯০০ টাকা, সঙ্গে অনলাইন ফি ১০০ টাকা; মোট এক হাজার টাকা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়: প্রাথমিক আবেদন ফি ৫৫ টাকা। চূড়ান্ত আবেদন ফি এ ও সি ইউনিটের জন্য ১ হাজার ৩২০ টাকা এবং বি ইউনিটের জন্য ১ হাজার ১০০ টাকা। অপর দিকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দেশের সব চাকরি পরীক্ষার আবেদন ফি সর্বোচ্চ ২০০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। যেখানে চাকরির আবেদন ফি ২০০ টাকা, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার আবেদন ফি অগ্রহণযোগ্য ও লজ্জাজনক।

মূলত অধিক মুনাফা লাভের আশায় গুচ্ছপদ্ধতি ভেঙে যাচ্ছে। এর ফলে গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি ফরম ক্রয় করা অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুচ্ছপদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তাদের যুক্তি হলো, সময় বেশি লাগে, মেরিট দিতে সমস্যা, মাইগ্রেশনের সমস্যা ইত্যাদি, যা একটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কাম্য নয়। বৃহৎ একটি পদ্ধতিতে কিছু সমস্যা থাকবে, সে জন্য সেই পদ্ধতি থেকে কেন বেরিয়ে আসতে হবে? তারা যদি প্রয়োজনবোধ করে, তাহলে সমন্বিত মেডিকেল কলেজ ভর্তি পরীক্ষা কমিটি, সমন্বিত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা কমিটি কিংবা সমন্বিত প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা কমিটির কাছে পরামর্শ গ্রহণ করতে পারে। যদি সেটি করতেও ব্যর্থ হয়, তাহলে প্রয়োজনে বিদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে পরামর্শ গ্রহণ করতে পারে। তারা চাইলে ভর্তি পরীক্ষা দ্রুত নিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে ফলাফল প্রকাশিত করে এক দিন অথবা দুই দিন পরপর নতুন মেরিট প্রদান করে অনলাইনে ভর্তি ফি জমা নিতে পারে। যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কেউ ভর্তি না হন, তাহলে তাঁকে মেরিট থেকে বাতিল ঘোষণা করা যেতে পারে। পাশাপাশি ফলাফল অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় সিলেকশন করে দিলেও সময়সীমা কম লাগবে। বিশ্বায়নের যুগে পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ শিক্ষায় ও জ্ঞানে বিপ্লব ঘটিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত, ছাড়িয়ে যাচ্ছে একের পর এক রেকর্ড। আর বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে আগের চেয়ে বেশি মুনাফা লাভ করে শিক্ষাকে ব্যবসায় পরিণত করা যায়, সেই চিন্তায় মগ্ন রয়েছে; তাহলে দেশে শিক্ষা ও গবেষণার বিপ্লব কীভাবে হবে? বৈষম্যবিরোধীর চেতনাকে ধারণ করে বাংলাদেশ নির্মাণ করতে হলে অযৌক্তিক ভর্তির আবেদন ফি যেমন বাতিল করতে হবে, ঠিক তেমনি যোগ্য ব্যক্তিদের যোগ্য স্থানে নিয়োগদান করতে হবে। তাহলেই সংবিধানের ১৭তম অনুচ্ছেদ ‘সবার জন্য শিক্ষা’ বাস্তবায়ন হবে।

লেখক: মো. হেলাল মিয়া, শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর