শৈশবের সোনালি অতীত
গ্রামের অপরূপ সৌন্দর্য সবারই মনে টানে। শৈশব, কৈশোর, যৌবনে গ্রামে অতিবাহিত করা প্রতিটি মুহূর্ত অতি গুরুত্বপূর্ণ সময়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু যেমন বিলীন হয়ে যায়, ঠিক তেমনি গ্রামে ফেলে আসা শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতিগুলো অনেক বেশি কাঁদায়। তাইতো সময়ের আবর্তনে গ্রামের প্রতি, গ্রামের মানুষের গায়ে মাটির গন্ধের প্রতি মোহ ক্রমান্বয়ে বেড়ে যায়। ছোট থেকেই দেখে এসেছি, গ্রামের সবুজে–শ্যামলে ঘেরা, সুজলা–সুফলা মনোমুগ্ধকর প্রকৃতি। সেই সময়ে ধানের খেতের ভিতর দিয় এঁকেবেঁকে চলা মেঠো পথ, বন্ধুদের সঙ্গে দলবদ্ধভাবে নদীতে ঝাঁপ দেওয়া থেকে শুরু বাবা মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে দুপুরের রোদে মাঠে গিয়ে ঘুড়ি ওড়ানো, বাড়ির কাজের লোকের সঙ্গে মহিষ চরানোর স্মৃতি এখনো সুস্পষ্টভাবে মনের মণিকোঠায় ভেসে ওঠে।
ছোট থাকতে দেখেছি অনেক ধান উঠত আমাদের বাড়িতে। ঠেলা গাড়িতে করে ধান কেটে বাড়ি তুলত, তারপরে সেগুলোর গাদা (এক জায়গায় জমিয়ে উঁচু করে রাখা) দিয়ে রাখত কয়েক দিন। সময়–সুযোগ এবং আবহাওয়া বুঝে সেগুলো নিজেদের মহিষ দিয়ে মলন (মাড়াই) দিত। অনেক ধুমধাম চলত ওই সময়, ধান মাড়াই করে গোলায় (ধান রাখার ঘর) তুলতে পারাটা ছিল যেন বাড়ির সবারই সবচেয়ে বড় একটা স্বস্তির কাজ। মা-কাকিমা, ঠাকুরমা-ঠাকুরদাদা, বাবা-কাকা কারও যেন দম ফেলার সময় থাকত না। চারিদিকে পাকা ধানের গন্ধে মুখরিত থাকত। ধান মাড়াইয়ের পরে সেগুলো থেকে ভুসি (ধানের চিটা/অপরিপক্ক ধান) ঝেড়ে ওই দিনের ভিতরে গোলায় তোলা হতো। সবকিছু নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর শেষ করতে হবে, সেই অনুযায়ী কাজের লোক নেওয়া হতো। যে দিন ধান মলনের কাজ চলত, সেদিন সকাল থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত সবাই ব্যস্ত থাকত। কোনো কোনো সময় ধান মাড়াইয়ের রাতে বাবাকে হ্যাজাকের (আগেকার দিনে ব্যবহৃত কেরোসিনের সাহায্যে জ্বালানো বিশেষ আলো) ব্যবস্থা করতেও দেখেছি। আমরা ছোট থাকলেও মনের ভিতর ওই দিন একটা উৎসব মুখর পরিবেশ কাজ করত। তাই ওই দিন পড়ালেখা, স্কুল যাওয়া থেকে অঘোষিত ছুটি ভোগ করতাম।
ধানের ভুসি ঝেড়ে ফেলে দেওয়ার পরে সেগুলো ঠাকুরমা জমিয়ে রাখত এবং সুবিধামত সময়ে রাস্তার পাশে যেখানে বেশি বাতাস বয়ে যাচ্ছে সেখানে পাটি (ধান বিছানোর মাদুর) বিছিয়ে ওই ভুসি থেকে দ্বিতীয় বারের মতো আরও কিছু ধান সংগ্রহ করত। নিজেদের চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি ধান হতো আমাদের, তাই ধানের গোলা ভরার পরে উদ্বৃত্ত ধান বিক্রি করে দেওয়া হতো। নৌকায় করে অনেক পাটের বস্তাসহ ধান কিনতে ব্যাপারী আসতেন। বেতের ঝুড়ির তৈরি পাঁচ সেরের পাল্লা ছিল। ধান বিক্রির সময় বাবা ধান মাপত, ধান মাপার সময় বাবার বাম হাতে পাল্লার মোটা দড়িটা ধরে ডান হাতে পাল্লায় ধান কাটাতে কাটাতে ১/২/৩ গোনার সুরটা এখনো মনে পড়ে। নতুন ধান ওঠার পরপরই শুরু হয়ে যেত পিঠা–পুলি তৈরির ধুম। আমাদের এলাকায় বেশি প্রচলিত ছিল চিতই পিঠা, তেলের পিঠা, পুলি পিঠা, রসের পিঠা এবং পাটিসাপটা পিঠা। এগুলোর ভিতর আমার খুবই প্রিয় ছিল চিতই পিঠা। সঙ্গে থাকত চালের গুঁড়া, দুধ এবং খেজুরের গুড় দিয়ে বানানো ক্ষীর। সারা রাত খেজুরের রসে ভেজার পরে সকালে উঠে টসটসে পিঠাগুলো থালায় করে খেতে দিতেন মা। অনেক তৃপ্তি নিয়ে আমরা ভাইবোনেরা একসঙ্গে শীতের সকালে রোদে গিয়ে সারিবদ্ধ ভাবে বসতাম পিঠা খেতে।
বাড়িতে ঢেঁকি ছিল, তালে তালে পা ফেলিয়ে ঢেঁকিতে ধান ভানা চলত, চলত পিঠা বানানো ও চাল গুঁড়া করার কাজও। শীতের সকালে ফ্যানে ভাত (জাও ভাত) রান্না করত মা। আগে থেকে তৈরি করে জমিয়ে রাখা তালের গুড় দিয়ে বাড়ির সবাই মিলে সেই ভাত খেতাম। সন্ধ্যায় পাড়ায় আলাদা করে বসানো হতো চিড়ে বানানোর ঢেঁকি। ঢেঁকির পাশেই রাখা চুলোয় ধান অল্প সেদ্ধ করে ঢেঁকির নির্দিষ্ট স্থানে দিয়ে ঢেঁকিতে চার–পাঁচ বার ‘পাড়া’ দিতেই তৈরি হয়ে যেত চিড়া। আমরা গোল হয়ে অধীর আগ্রহে বসে থাকতাম কখন সেটা খাওয়ার উপযোগী হবে তার জন্য। চিড়া তৈরি হওয়ার পরে সেগুলোকে কুলোয় ঝেড়ে গরম গরম খাওয়ার যে মজা, সেটা এখনো ভুলতে পারি নাই। শীতের ভোরে গায়ে চাদর জড়িয়ে সব বন্ধু বান্ধব একসঙ্গে বের হতাম আগুন পোহাতে। সবাই মিলে আগের দিন জমিয়ে রাখা খড়, লতাপাতা, কাগজের টুকরা দিয়ে ‘সাজাল’ (আগুন পোহানোর জন্য সবাই গোল হয়ে আগুনের চারপাশে বসা) পোহানোর কাজ চলত সূর্যের আলো দেখার আগ পর্যন্ত।
ছোট থাকতে দেখেছি, তখনো আমাদের ১৫টার মতো মহিষ ছিল। এ সবের বেশীর ভাগই ধান বপনের জন্য জমি চাষ এবং দুধ উৎপাদনের জন্য পালা হতো। সারা বছরই তিন থেকে চারটা মহিষ দুধ দেওয়ার উপযোগী থাকত, সে জন্য প্রচুর দুধ হতে দেখেছি। সকালে গোয়ালা আসত দুধ কিনতে, আর বাড়িতে খাওয়ার জন্য রেখে দেওয়া হতো ছোট্ট একটা কলসের (প্রায় ৫ লিটার) এক কলসের মতো দুধ। কোনো কোনো দিন গোয়ালা আসত না, সেদিন বাড়িতে ঘি, মাখন বানানোর জন্য দুধের ঘোল টানা হতো। একটা হাঁড়ির ভেতর দুধ রেখে সেটাতে বাঁশের একটা লাঠির মাথায় বিশেষ ব্যবস্থা করে কপিকল তৈরি করে দড়ি দিয়ে দুধের ভেতর কিছুক্ষণ ঘোরাতেই দুধ থেকে মাখন ভেসে উঠত। পরে সেই মাখন আগুনে জ্বালিয়ে ঘি বানানো হতো। ঘি বানানোর পরে যে ছিটেটা (মাখনের ভাজা অবশিষ্ট অংশ) থাকত, ওটা আমার খুব প্রিয় ছিল, তাই কেউ জানার আগেই লুকিয়ে ওটাকে কুড়মুড় করে সবার আগেই খেয়ে নিতাম। মাখন ওঠানোর পরে হালকা লবণ মিশিয়ে ঘোলের স্বাদ ও মুখে লেগে থাকার মতো ছিল।
গরমের দিনে আমাদের অনেক তালের রস হতে দেখেছি। দিনে প্রায় সাত-আট কেজি মতো গুড় হতো। মেজ কাকা ছিল রস থেকে গুড় তৈরিতে সবচেয়ে বেশি পারদর্শী ছিল। আমরা বাচ্চারা সবাই বসে থাকতাম রস জ্বালিয়ে কখন গুড় হবে সে প্রতীক্ষায়। কারণ, গুড় ঢালার পরে পাত্রের অবশিষ্ট গুড় চেটেপুটে খাওয়ার জন্য তখন জড়ো হয়ে যেত সমবয়সী পাড়ার অনেকেই। ঠাকুরমা বিকেলে ব্যস্ত হয়ে পড়ত লবণ বানানোর কাজে। মাঠের ওপরে জমা হওয়া লবণযুক্ত মাটির আস্তরণ ঠাকুরমা আগে থেকে জড়ো করে রাখত। এরপর আমি সেগুলো বস্তা ভরে সাইকেলে করে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতাম। পরে সেগুলো থেকে ছাঁকন প্রক্রিয়ায় বিশেষ কায়দায় লবণজল বের করে নিয়ে বাড়িতেই লবণ বানাত আমাদের। এইসব প্রক্রিয়াগুলো ছিল যেন অশিক্ষিত মানুষের বিজ্ঞানের যথাযথ ব্যবহারের বাস্তব উদাহরণ। উঠানে বড় বড় চুলা তৈরি হতো, তালের রস আর লবণের জল জ্বালানোর জন্য। আমরা খেত থেকে নতুন লাগানো গাছের গোড়া থেকে মাটি খুঁড়ে ছোট ছোট নতুন আলু বের করে সেই লবণ জলের ভেতর দিতাম, পরে সেদ্ধ হলে সেই লবণের স্বাদ যুক্ত আলু খুবই তৃপ্তি সহকারে খেতাম। খড় দিয়ে জ্বালানো হতো ওই বড় বড় চুলাগুলো।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে না হতেই বড়দের চোখ ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে পড়তাম মাঠে ঘুড়ি উড়াতে। মেজ কাকা অনেক বড় বড় ঘুড়ি বানিয়ে দিত আমাকে। বড় ঘুড়ির টানে শক্ত নাইলনের সুতা নাটাইসহ নিজ হাতে ধরে রাখাটা মাঝেমাধ্যে দুষ্কর হয়ে পড়ত। প্রায়ই ছেলেমেয়ে সবাই একসঙ্গে খেলতে বের হতাম। লুকোচুরি, বউচি, কানামাছি, বেগুন ঢিবঢিবি, ডাংগুলিসহ আরও হরেক রকমের আঞ্চলিক খেলা প্রচলিত ছিল আমাদের ওখানে। এছাড়া মার্বেল খেলায়ও বেশ মেতে উঠতাম আমরা সবাই। মাঝেমধ্যেই সব বন্ধুরা মিলে চড়ুইভাতি খেলার ফন্দি আঁটতাম। সবার বাড়ি থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল, ডিম, তরকারিসহ হাজির হতাম, সঙ্গে মাথাপিছু তিন–চার টাকা করে উঠাতাম রান্নার বাকি মসলাপাতি কেনার জন্য। সবাই সামনে কলাপাতা বিছিয়ে অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে থাকতাম, কখন রান্না শেষ হয়ে সেই লোভনীয় অর্ধসেদ্ধ খাবার পাতে আসবে, তার জন্য।
বর্ষার সময় সকালে বাড়ির সবাই পান্তা খেতাম। সারা রাত জলে ভিজিয়ে রাখা ভাত সকালে পান্তা হয়ে যেত, সেটা ঘোল বা দুধ দিয়ে খাওয়ার স্বাদটা ছিল অসাধারণ। বাড়ির সবাই তালের গুড় দিয়ে পান্তা খেলেও আমার খুব প্রিয় ছিল নারকেল কোরানো দিয়ে পান্তা খাওয়া। এ জন্য বাড়ির গাছ থেকে নারকেল পেড়ে আগে থেকে জমিয়ে রাখতাম সেগুলো পান্তা ভাতের সঙ্গে খাব বলে। আমাদের অনেক বড় কলাগাছের বাগান ছিল এবং ঠাকুরদাদা এ বাগানের দেখাশোনা করত। অপেক্ষায় থাকতাম, কখন ঠাকুরদাদা গাছ থেকে কলা কেটে নেওয়ার পরে গাছগুলো ফেলে দেবে। ফেলে দিলে সেই কলাগাছ দিয়ে ভেলা বানিয়ে পুকুরে নৌকার মতো ভেসে ভেসে সারা দুপুর মাতিয়ে বেড়াতাম। বিকেলে ঠাকুরমার সঙ্গে বের হতাম ছিপ নিয়ে খালে বিলে কই, শোল, পুঁটিসহ টেংরা মাছ ধরতে। এছাড়া দিঘি, বড় জলাশয়, খাল–বিল থেকে গলাজলে নেমে নিজেদের বহনযোগ্য শাপলা–শালুক তুলে আনতাম। শাপলা ফুলের গাছের লম্বা ডাঁটা দিয়ে মালা করে সেগুলো গলায় পরে সবাই ঘুরে বেড়াতাম।
প্রায়ই বাড়ির কাজের ছেলের সঙ্গে যুক্তি করে কাউকে না জানিয়ে মহিষ চরাতে বের হতাম। বাড়ির কাছ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীতে জোয়ার হলে সে মহিষগুলোকে চরাতে নিয়ে যেত। আমি মহিষের পিঠে বসে মহিষের কান দুটো শক্ত করে ধরে রাখতাম। মহিষ ছুটে চলত ভরা নদীতে স্রোতের অভিমুখে। কিছুক্ষণ পরে পরে জলে মুখ ডুবিয়ে ডুবিয়ে মাটির গায়ে বেড়ে ওঠা ছোট ছোট ঘাস খেত। নদী দিয়ে স্পিড বোট বা লঞ্চ গেলেই নদীর পাড়ে অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে দলবেঁধে ছুটে যেতাম পায়ে ঢেউ লাগাতে। তখন নদীতে বাতাসের গতিকে কাজে লাগিয়ে নৌকায় বেগ দেওয়ার জন্য পালতোলা ছোট–বড় বিভিন্ন আকারের নৌকা দেখা যেত। মাঝেমধ্যে দেখতাম, যখন স্রোত এবং বাতাস কোনটাই অনুকূলে থাকত না, তখন নৌকায় গুন টেনে মাঝিরা তাদের গন্তব্যে পাড়ি দিত। নাব্যতা সংকটের কারণে তখন নদীতে মাঝেমধ্যেই সারি সারি অনেক বড় বড় লঞ্চ, কারগো, ফেরি আটকে যেত। খুবই মজা পেতাম যখন, দেখতাম লঞ্চ আটকে আছে দিনের পর দিন, তখন আমরা সবাই লঞ্চে গিয়ে উঠতাম। হঠাৎ একদিন দেখতাম নতুন জোয়ারের জল পেয়ে রাতের অন্ধকারে সব লঞ্চগুলো উধাও হয়ে গেছে।
তখনকার দিনে ইন্টারনেট তো দূরের কথা, মোবাইল ফোন কি জিনিস, সেটা ছিল না। সারা গ্রাম ঘুরেও হয়ত একটা টেলিভিশন খুঁজে পাওয়া মুশকিল ছিল। নব্বইয়ের দশকে আমাদের বাড়িতে সাদাকালো একটা টেলিভিশন এলে সেটা দেখার জন্য গ্রামের সবার লাইন পড়ে যেত। বিশেষ করে শুক্রবার রাতে তখনকার জনপ্রিয় মেগা সিরিয়াল ‘আলিফ লায়লা’ দেখার জন্য উপচে পড়া ভিড় হতো। ভিড়কে সামাল দিতে ওই দিন টেলিভিশন উঠানে বের করে দিতাম। আরব্য উপন্যাসের কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত আলাদিন, আলিবাবা, মর্জিনা, সিন্দাবাদ, কেয়ারম্যানসহ আরও অনেক দুঃসাহসিক চরিত্রের কথা এখনো মনে ভেসে ওঠে। লম্বা বাঁশের মাথায় অ্যান্টেনা লাগিয়ে বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে বিটিভির (বাংলাদেশের সরকারি টেলিভিশন চ্যানেল) এর চ্যানেলের নিখুঁত ছবি দেখার জন্য সবাই অনেক উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষায় থাকত। শুক্রবার দুপুর থেকে বিটিভিতে প্রচারিত বাংলা ছায়াছবি দেখার জন্যও যথেষ্ট মানুষের উপস্থিতি লক্ষণীয় ছিল। বিদ্যুতের ব্যবস্থা না থাকায় ১২ ভোল্টের বড় ব্যাটারি দিয়ে টেলিভিশন চালানো হতো। সে জন্য ছায়াছবি চলাকালীন যখনই বিজ্ঞাপন বা সংবাদের সময় হতো তখন ব্যাটারির চার্জকে যথাসম্ভব বাঁচানোর জন্য টেলিভিশন বন্ধ করে রাখতাম।
সপ্তাহে শনি আর মঙ্গলবার—এ দুই দিন বাড়ি থেকে মাইলখানিক দূরে হাট বসত। ঠাকুরদাদার কাঁধে বসে হাটে যেতাম, বেশি মজা হতো যখন দেখতাম ঠাকুরদাদা বৃষ্টিতে কাদায় আঙুল টিপে টিপে আমাকে কাঁধে নিয়ে হাটে চলে গেছে। আমি কাঠের বাঁটওয়ালা পুরু কালো কাপড়ের ছাতাটা শক্ত হাতে ধরে ঠাকুরাদাদার কাঁধে বসে থাকতাম। হাটে গিয়ে অনেক কষ্টে ঠাকুরদাদার থেকে দুই–এক টাকা ম্যানেজ করতে পারতাম, পরে সেটা দিয়ে গুড়ের গজা (আখের গুড় এবং ময়দা দিয়ে বানানো বিশেষ মিষ্টিজাতীয় খাদ্যদ্রব্য), চিট কটমা (চিনি দিয়ে বানানো অনেক শক্ত একটা খাবার), পিঁয়াজু, শিঙাড়া কিনে খেতাম। তখনকার দিনে পঞ্চাশ পয়সা দিয়ে বাঁশের চিকন কাঠিতে ধরার বিশেষ ব্যবস্থায় মালাই (আইসক্রিম) পাওয়া যেত, গরমের দিনে ওটা আমাদের মতো বাচ্চাদের খুবই লোভনীয় একটা খাবার ছিল।
খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে সবকিছুই আজ বিলীন। গ্রামের সেই হাট এখন আর বসে না, হাটকে সবাই এখন বাজার বলে, সপ্তাহের প্রতিদিনই বাজার বসে। চাইলেও এখন আর কেউ বাড়িতে ঘি–মাখন বানাতে পারে না। পাশের নদীতে এখন আর জল নেই, জোয়ারের পানিতে ও পায়ের পাতা ডোবে না। সেই লবণজল জ্বালানো, গুড়ের পাটালি বানানো সত্যিই এখন খুবই বেমানান। এখন পয়লা বৈশাখে গরম ভাতে জল ঢেলে দিয়ে সেটাকে পান্তা বলা হয়। লুকোচুরি, কানামাছি বাদ দিয়ে বাচ্চারা এখন স্মার্ট ফোনে সারাক্ষণ টম–জেরি, ডোরেমন দেখায় ব্যস্ত। চড়ুইভাতি ভুলে গিয়ে বাচ্চাদের আমরা এখন নামীদামি রেস্তোরায় ফ্রাইড রাইস, পিজ্জা, বার্গার খাওয়াতেই অভ্যস্ত। মানুষ এখন অনেক আধুনিক, আমরাও এর ব্যতিক্রম নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হয়তো আরও আধুনিক হব। কিন্তু ছেলেবেলার এই স্মৃতিগুলো সত্যিই খুব কাঁদায়। সম্প্রতি মা গত হয়েছে, ঠাকুরদাদা মারা গেছে বছর ১৫ আগেই, ঠাকুরমা ও বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছে, মেজ কাকা সপরিবার ভারতে। আমরাও পরিবার, ভাই-বোনসহ অন্যান্য স্বজন ছেড়ে নিজের কর্মস্থলে। দূরে আছি, বহু দূরে তবুও মাটির টানে ফিরে ফিরে দেখি আমার রূপসী বাংলা, আমার কাদামাটিতে মাখা সোনালি শৈশবকে। স্মৃতির পাতায় অক্ষরগুলো অস্পষ্ট হয়ে গেলেও একেবারে মুছে যায়নি আর তাইতো সেই ছেলেবেলার মতো করে সবার কাছে ফিরে যেতে খুবই ইচ্ছে হয়। মনে বার বার উঁকি দেয় সেই সোনামাখা শৈশব। সব শেষে নিজের স্বরচিত ছন্দে মিলিয়ে শেষ করতে চাই—
কোথায় হারিয়ে গেল সবুজে ঘেরা গ্রাম্য সে বসবাস
কোথায় গেলে পাব আজ সেই বুক ভরা বিশুদ্ধ নিশ্বাস
ইট পাথরের কৃত্রিম শহরে প্রাণ খুঁজে না পাই
সবই আছে প্রয়োজনের অধিক তবুও মন ভরানো দায়
মনে পড়ে সেই মায়ের সাথে, ছনের ছাউনির টাবুরি নৌকায় বসে
মামার বাড়ি গিয়েছিনু খেতে, কত পিঠা পুলি আর পায়েসে
দেখেছি নদীর বুকচিরে চলা, পাল তোলা নৌকার মাঝিমল্লার ভিড়
দখলদারদের ক্ষমতার জোরে আজি সেসব নদীপথ বিলীন
হারিয়েছে বনবাদাড়ঘেরা সর্পিল মেঠো পথ
কোথাও নেই যেন প্রাণের স্পন্দন, আছে শুধু হাহাকারের আর্তনাদ
প্রকৃতি আজ বিরূপ বেজায় মানুষেরই কৃত কাজে
আপন দোষে মানবসভ্যতার আজ হুমকির ঘণ্টা বাজে
শৈশবের সোনাঝরা দিনে, মন খুব করে ফিরে যেতে চায়
অসম্ভব জেনেও সে স্মৃতি আজ মনের মণিকোঠায় অমলিন জেগে রয়।
লেখক: অজয় কান্তি মণ্ডল, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ।