আমার বর্ণমালা আমার শহীদ মিনার
শৈশবে যে বাবার কাছে বন্ধুদের ‘তদবির’ করতে হতো আমাকে কাব-স্কাউট জাম্বুরিতে নেওয়ার জন্য; কারণ, শীতের রাতে গায়ের কম্বল পড়ে গেলে তুলে দেবে কে; সেই বাবাই অমর একুশের প্রভাতফেরিতে যাওয়ার জন্য আমাকে উৎসাহিত করতেন। বায়ান্নর শহীদদের স্মরণ করতে ষাটের দশকে নগ্ন পায়ে প্রভাতফেরিতে যোগ দিয়ে যখন বাসায় ফিরতাম, আব্বাকে বলতে হতো কী কী করেছি, কারা কারা মিছিলে ছিলেন।
এগুলো যে তখন বুঝে করতাম, তা নয়। তবে স্কুলের বড় ভাইয়েরা যাঁরা মেধাবী ছাত্র ছিলেন, তাঁরাই এগুলোর আয়োজক ছিলেন বলে একধরনের গর্বও অনুভব করতাম। মাও সে–তুংয়ের লাল বইয়ে কী লেখা ছিল, বুঝতাম না। তবে সিনিয়র ভাইয়েরা যাঁরা ভালো ছাত্র, তাঁরা এটি সঙ্গে নিয়ে ঘুরতেন দেখে আমিও মাও সে–তুংয়ের ছোট্ট বইটি স্কুলের সাদা জামার পকেটে রেখে ভালো ছাত্র সাজার চেষ্টা করতাম। পাবলিক লাইব্রেরি ব্যবহার, টাউন হলে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা উদ্যাপন, ফয়জুল্লাহ সাহেবদের মতো সাব–ডিভিশনাল অফিসারের উদ্যোগে স্টেডিয়ামে ভোরে শরীরচর্চা, এগুলোর মতো প্রভাতফেরিও আমার শৈশব ও কৈশোর জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে।
যে বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিতে হয়েছে, যে ভাষার লড়াই একদিন স্বাধীনতাসংগ্রামে রূপ নিল, যে স্বাধীনতা আমাদের একটি ভূখণ্ড দিল, পতাকা দিল; সেই বাংলা ভাষা আমরা যখন আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহার করি, তখন অনেকেই সতর্ক থাকি না। সামজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক সময় যখন লেখালেখি দেখি, তখন নিজের ভেতর একধরনের দারিদ্র্য লক্ষ করি। ছোটবেলায় শিখেছি, আমি একটি লাল জামা পরেছি, আপনার পছন্দ হয়নি, কিন্তু কিছু যদি বলতেই হয়, বলুন, ‘আমি আপনার জায়গায় হলে একটি সাদা জামা কিনতাম।’ স্কুলের হেডস্যার আবু বকর ইংরেজি ট্রান্সলেশনে শিক্ষণীয় বাক্য নিয়ে আসতেন। বলতেন, বাসে বসে সহযাত্রীকে কোথায় যাবেন জিজ্ঞাসা না করে জিজ্ঞাসা করো, ‘অধিক দূর যাইবেন কি?’ ইত্তেফাক বাসায় পৌঁছাতে সন্ধ্যা গড়িয়ে যেত, ওটাই ছিল বানান শেখার অবলম্বনগুলোর একটি। হেডস্যার (প্রধান শিক্ষক) বলতেন, বয়সে বড়দের মুরব্বি হিসেবে মানতে হবে। কারণ, তাঁদের অভিজ্ঞতার ঝুলিও অমূল্য সম্পদ। বলতেন, শব্দের মৃত্যু হয় না, তাই চিন্তায় ও উচ্চারণে শুদ্ধতা অপরিহার্য। শুদ্ধ বর্ণমালা, শুদ্ধ বাক্য নির্মল বাতাসের মতো, এটি চর্চা করলে জীবন পরিশীলিত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হলের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব নেওয়ার পর জানতে পারলাম, পদাধিকারবলে আমাকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত ঘোষণা মঞ্চ কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করতে হবে। মাস তিনেকের মধ্যে ফেব্রুয়ারি মাস আসতেই উপাচার্য (তৎকালীন) আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক সিনেট ভবনে শিক্ষা ও প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সভায় এই গুরুত্বপূর্ণ দিনটিকে যথাযথ মর্যাদায় পালনের লক্ষ্যে করণীয় নির্ধারণের সভা ডাকলেন। ঘোষণা মঞ্চের এজেন্ডা আসার সঙ্গে সঙ্গে একজন সহকর্মী দায়িত্বটি অমর একুশে হলের প্রাধ্যক্ষের পরিবর্তে বাংলার একজন অধ্যাপককে দেওয়া যায় কি না, এমন একটি প্রস্তাব উত্থাপন করলেন। আজও জানি না, কেন?
কিন্তু মাইক্রোফোনে হঠাৎ বলে ফেললাম, ‘মাননীয় উপাচার্য, অমর একুশে হলের প্রাধ্যক্ষও বাংলায় কথা বলেন।’ আমার মনে আছে, পুরো হল ঘর কয়েক সেকেন্ডের জন্য নীরব হয়ে গেল। নীরবতা ভেঙে উপাচার্য পরের এজেন্ডায় গেলেন এবং আমি পাঁচ বছর ঘোষণা মঞ্চ কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেছি। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরের হিমশীতল নীরবতা ভাঙার উত্তেজনা এখনো আমাকে শিহরিত করে, আমি আবেগতাড়িত হই। ঘড়িতে রাত ১২টা বাজার পর কোন কণ্ঠটি উচ্চারিত হবে, কোন সুর ও সংগীত বাজানো হবে, কীভাবে সব কার্যক্রম পরিচালিত হবে, এর প্রায় সবকিছুই উপাচার্যের অনুমোদনক্রমে পরিচালিত হতো।
যখন প্রথম প্রহরে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি’ সুরের মূর্ছনায় সবাই শহীদ মিনারের দিকে এগিয়ে আসত, দুচোখ জলে ভিজে যেত। এ এক মহাযাত্রা। এ যাত্রায় শরিক হয়ে শৈশব, কৈশোর, যৌবন পেরিয়ে আজ প্রৌঢ়ত্বে উপনীত হয়েছি। একদিন চলে যাব, কিন্তু এ যাত্রা কখনো থেমে যাবে না—একুশ আমাদের বাতিঘর, আমাদের স্থায়ী ঠিকানা।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ের অনিবার্য পরিণতি আমাদের স্বাধিকার অর্জন। একুশের শহীদ মিনার তাই হোক আমাদের জাতীয় সংহতির প্রতীক। একুশ আমাদের মহান শহীদদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া অবিনাশী বর্ণমালা। আমরা কি এই বর্ণমালার ব্যবহারে যত্নবান হতে পারি না?
লেখক: মো. আনোয়ারুল ইসলাম, সাবেক অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, সাবেক প্রাধ্যক্ষ, অমর একুশে হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়