আমরা শুধু দেখছি, কিছু করছি না
আপনি কি জানেন দিনে ৩ ঘণ্টা ১৫ মিনিট কেবল ফোনই চালান? প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন প্রতিদিন সাড়ে চার ঘণ্টা স্মার্টফোন চালিয়ে থাকে। এমনি করে মাসের ৫২ শতাংশ সময় ব্যয় করা হয় ফোন চালিয়েই। তথ্য অনুযায়ী একজন মানুষ ফোন রেখে দেওয়ার তিন মিনিটের মাথায় আবারও ফোন নিয়ে বসে। আন্তর্জাতিক সংস্থা জিএসএমের ‘দ্য মোবাইল ইকোনমি ২০২০’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
বিস্ময়কর প্রযুক্তির বিশ্বে যেখানে কিনা আমাদের আঙুলের ডগায় রয়েছে অসংখ্য সম্ভবনা, সেখানে আমরা কেবল আমাদের পকেটের বন্ধু স্মার্টফোনের নীলাভ আলো চোখে মেখে দিনের অনেকটা সময় কাটিয়ে দিই। এককালে মানুষ ভোরে উঠে পত্রিকা নিয়ে বসত। আর আমরা বসি স্মার্টফোন নিয়ে। দিনের শুরুতেই একগাদা মিম-ভাইরাল ভিডিও না দেখলে আর অন্যের স্ট্যাটাস না পড়লে যেন দিনটা শুরু হয় না। আর শুরুটা করি আলতো করে স্ক্রিনে স্ক্রল করে। এরপর আমাদের বুড়ো আঙুল কীভাবে যেন আপনা থেকেই ফোনের স্ক্রিন ঘষতে থাকে।
১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে যে প্রজন্মের জন্ম হয়েছে, তাকে বলা হয় জেনারেশন-জি বা জেন-জি (Gen-Z)। বিশেষ করে এই জেন-জির অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজন ফোন নিয়ে অনেক বেশি সময় কাটায়। বৈশ্বিক ডিজিটাল প্রতিবেদন লেখক এবং ডেটা রিপোর্টারের প্রধান বিশ্লেষক সাইমন কেম্পের মতে, জেন-জির ব্যক্তিরা আসলে অনলাইনে কী করে তা বোঝা বেশ মুশকিল। এক গবেষণায় জেন-জির অংশগ্রহণকারীদের ২৪ শতাংশই স্বীকার করেছে যে অতিরিক্ত ফোন ব্যবহার করা তাদের জীবনের একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষদের তুলনায় নারীরা বেশি সময় ধরে ফোন চালিয়ে থাকেন। জানা গেছে, গবেষণায় অংশগ্রহণকারী নারীরা ২ ঘণ্টা ৪৭ মিনিট ফোন চালান। আর পুরুষেরা নারীদের তুলনায় মাত্র ১৩ মিনিট কম সময় ফোন চালান। এ ছাড়া আরেক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে যে নারীরা তাঁদের সঙ্গীদের তুলনায় ৭৮ শতাংশ বেশি সময় ধরে ফোন চালিয়ে থাকেন। পুরুষদের ক্ষেত্রে এ পরিমাণ ৬৮ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে।
আজ একটা খুব মজার ঘটনা ঘটেছে। এটা যে একটু ফেসবুকে পোস্ট করতেই হয়। ক্যামেরায় একটি সুন্দর ছবি উঠেছে। এটা তো ইনস্টাগ্রামে পোস্ট না করে থাকাই যায় না। ভিউ কমে যাচ্ছে। আজ টিকটকে একটা ভিডিও পোস্ট করতেই হবে। আপনার মাথায়ও কি এমন চিন্তা আসে?
সে ঘষাঘষি যেন থামেই না। সেকেন্ড গড়িয়ে মিনিট হয়, মিনিট গড়িয়ে ঘণ্টা। আর আমরা কাজকর্ম ফেলে স্মার্টফোনের দিকে তাকিয়ে থাকি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে অপরিচিত মানুষের পোস্ট করা আকর্ষণীয় কনটেন্ট লুফে নিতে আমরা ভুল করি না। কখন একটা নোটিফিকেশন বেজে উঠল, কখন একটা মেসেজ এল, কখন ফোনের ব্যাটারি অ্যালার্ট জারি করল এগুলো ভেবেই দিব্যি জীবন কাটাচ্ছি। এভাবে কি আমরা আমাদের কর্মহীনতার জেলে বন্দী করে ফেলছি না?
গবেষণা মতে, একজন মানুষ দিনে ৫৮ বার তার ফোন দেখে থাকে। এ গণনায় শীর্ষে রয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ফিলিপাইন। ফিলিপিনোরা গড়ে প্রতিদিন সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে ফোন চালিয়ে থাকে। অন্যদিকে বিশ্বের যত মানুষ ফোন নিয়ে সময় কাটায়, তার প্রায় অর্ধেকের কম সময় কাটায় জাপানিরা। তারা প্রতিদিন গড়ে মাত্র ১ ঘণ্টা ৩৯ মিনিট ফোন চালিয়ে থাকে।
এখন আমাদের আর এক থেকে দুই ঘণ্টা কোনো চলচ্চিত্র বা নাটক দেখতে ইচ্ছা করে না। এক মিনিটের বেশ কিছু শর্ট ভিডিও দেখে ফেলি। ড্যান্স চ্যালেঞ্জ, কমেডি স্কিটস এবং ভাইরাল ট্রেন্ডসের ভিডিওগুলো দেখতে দেখতে সময়টা বেশ ভালোভাবেই কাটে। কিন্তু কোনো সতর্কীকরণ ছাড়াই এসব ভিডিও দেখার সময়সীমা ঘণ্টা ছাড়িয়ে যায়। সত্যি বলতে আমরা নিজেদের যতটা না চিনি, আমাদের তার চেয়ে বেশি চেনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যালগরিদম।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুল তথ্য ছড়ানোর পরও এর ব্যবহার কিন্তু কমছে না। আমরা সবাই স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে মোটামুটি একই ধরনের অভিজ্ঞতা লাভ করছি। ২০১২ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত স্মার্টফোন ব্যবহার করে ইন্টারনেট চালানোর সময় তুলনামূলকভাবে ১২ মিনিট বেড়েছে। স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে সময় কাটানোর একটা বড় অংশ জুড়ে আছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। গবেষণা মতে, অধিক পরিমাণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করার প্রধান কারণ হচ্ছে একঘেয়েমি। তবে কৌতূহল, তথ্য জানার ইচ্ছা, একাকিত্ব, নিত্যপ্রয়োজনীয়তা বা কাজের প্রয়োজনীয়তা এবং মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার কারণেও অনেকে অধিক পরিমাণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে।
অন্যের সঙ্গে তুলনা করে আমরা আমাদের জীবন, অর্জন এবং চেহারা সাজিয়ে নিয়েছি নিখুঁত সময়ে ফ্রেমবন্দী করা ও ফিল্টার করা ছবিতে। পাশাপাশি লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার পাওয়ার লোভ তো রয়েছেই। একটা নিখুঁত পোস্ট লিখতে, সবার চোখে পড়ার মতো একটা ছবি বাছাই করতে এবং একটা মসলাদার ক্যাপশন লিখতে গিয়ে জীবন থেকে যে কত ঘণ্টা চলে গেছে তার হিসাব কি আমরা রাখি?
*তথ্যসূত্র: DATAREPORTAL, Exploding Topics, GSMA।
*লেখক: নাইমুর রহমান ইমন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস: [email protected]