বিবাহ বিভ্রাট
তুই তাহলে লক্ষ্মীকেই বিয়ে করবি?
শিশির মাথা নিচু করে রেখে বলল—হ্যাঁ বাবা।
শফিক সাহেব চূড়ান্ত বিরক্তি নিয়ে শিশিরের মাকে বললেন—তুমি কী তোমার এই গাধা ছেলেকে কিছু বলবে? বিদেশ থেকে তাকে এত টাকা খরচ করে পড়িয়ে এনেছি কী পাশের বাড়ি বিয়ে করবে বলে? মানসম্মান রাখবে কিছু?
শিশিরের মা বলল—তোকে যে পপি (লক্ষ্মীর বড় বোন) ডাইনোসরের ডিম বলে ডাকে, ঠিকই করে। তুই এমন উজবুক কবে হলি রে? এত বছর কানাডা থেকেও ব্রিটিশদের কূটনামি কিছু আয়ত্ত করতে পারলি না? আর ওর মা যে ছোটবেলায় তোকে দিয়ে দোকান থেকে তেল, নুন, মরিচ আনিয়ে নিত, তুই এখন সেগুলোর পারমানেন্ট সার্ভেন্ট হতে যাবি?
—কী আশ্চর্য কানাডায় ব্রিটিশ আসবে কোত্থেকে! মা, তুমি তো জানো ওদের ভাই নেই, তাই আন্টি আমাকে দিয়ে মাঝেমধ্যে এটা–ওটা করিয়ে নিত। এটা তো খারাপ কিছু নয়।
শফিক সাহেব অসহিষ্ণু হয়ে বললেন—আরে পাশের বাড়ি কেউ কোনো দিন বিয়ে করে নাকি? তুই জীবনে ওদের জামাই হতে পারবি? ওরা তোকে কলুর বলদ বানিয়ে রেখে দেবে গর্দভ কোথাকার।
শিশির তখন কিছুটা অবাক হয়ে বলল—তোমরা এভাবে বলছ কেন! এত ভালো মেয়ে দেখে তোমরাই তো ছোটবেলায় ওর নাম দিয়েছ লক্ষ্মী। তোমরাই সারা দিন লক্ষ্মীর গুণগান করে বাসার সবার কানের পোকা নাড়িয়ে ফেলো। তো সেই মেয়েকে বউ বানাতে এত সমস্যা কেন?
শফিক সাহেব হুংকার দিয়ে বললেন—এখন তাহলে তোর কাছে আমাদের কৈফিয়ত দিতে হবে?
শিশিরের মা বললেন—দুটো ভালো কথা বলেছি বলে এখন বিয়ে করে ফেলতে হবে? তারপর কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন—এই দিন দেখব বলে তোকে মানুষ করেছি?
শিশির অস্থির হয়ে বলল—মা সিনেমার ডায়ালগ দেওয়া বন্ধ করো। আমি লক্ষ্মীকে ভালোবাসি সেই জন্য ওকে বিয়ে করব। এখন তোমাদের ভালো লাগুক আর না লাগুক আমি লক্ষ্মীকেই চাই। কারণ, সেও আমাকে ভালোবাসে।
শফিক সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন ছেলের কথায়। তার গাধা ছেলের এত সাহস হয়েছে! আসলে রামছাগলগুলো যখন প্রেমে পড়ে, তখন এ রকমই করে। তিনি প্রচণ্ড ক্রোধে স্ত্রীকে ‘ছেলেকে সামলাও’ বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
রিনা খান বিলাপ করতে করতে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
রাতে খেতে বসে শফিক সাহেব দেখলেন শিশির খেতে আসেনি। শিশির তার কলিজার টুকরা একমাত্র পুত্র। তার কোনো আবদার আজ অবধি তিনি অপূর্ণ রাখেননি। তবে তার ছেলেটাও মাশা আল্লাহ, কোনো দিন কোনো অন্যায় আবদারও করেনি। তার এবারের আবদারটা...এ ব্যাপারে আসলে দ্রুত কিছু করতে হবে। তিনি ছেলেকে খেতে ডাকলেন।
শিশির এসে চুপচাপ বসে রইল। শফিক সাহেব বললেন, খাবারের সঙ্গে রাগ করে লাভ নাই। তা ছাড়া রাতে না খেয়ে থাকা স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ। আগামীকাল লক্ষ্মীদের বাসায় যাব কথা বলতে। খেয়ে নাও।
শিশির খুশি হয়ে গেল। সে জানত তার বাবা তার কথা ফেলতে পারবে না। সে বাবাকে ধন্যবাদ দিয়ে খেতে বসে গেল।
রাতে ঘুমোবার আগে শফিক সাহেব তার স্ত্রীকে পুরো প্ল্যানিংটা বললেন। রিনা খান সবটা শুনে বললেন—বুদ্ধি তো ভালোই করেছ কিন্তু কাজে দেবে তো?
—অবশ্যই দেবে। শফিক সাহেব কোনো দিন কোনো কাঁচা কাজ করে না। সব জায়গামতো বলে কয়ে ঠিক করে রেখে আসছি। এখন শুধু পয়েন্টে পয়েন্টে খেলা হবে। সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না। তুমি ফারজানাকে আসতে বলে দিয়েছ তো। ও না থাকলে তো খেলা জমবে না।
—মেয়েটা অনেক দিন হয় বাবার বাড়ি আসে না। আমি ফোন করে এখনই সব বলছি। ও সকালেই চলে আসুক।
লক্ষ্মীর ভালো নাম জান্নাতুল ফেরদৌস। ওর জন্ম হওয়ার পর থেকে ওর বাবার ব্যবসায় খুব উন্নতি হতে শুরু করল আর ছোটবেলা থেকে খুব ঠান্ডা আর ভদ্র বলে সবাই একে লক্ষ্মী বলে ডাকতে শুরু করে। তারপর তার নামই হয়ে গেল লক্ষ্মী। লক্ষ্মীদের সঙ্গে শিশিরদের পরিবারের সম্পর্কটা খুব ভালো। এরা অনেক বছর ধরে এখানে এক সঙ্গে আছে। পাশাপাশি বাড়ি আর এত বছর ধরে একসঙ্গে থাকার কারণে এদের সম্পর্কটা প্রতিবেশীর চেয়ে বেশি কিছু হয়ে গেছে। এরা নিজেদের একটাই পরিবার মনে করে, যা হোক পরদিন রাতে লক্ষ্মীদের বাড়িতে শফিক সাহেব তাঁর পুরো পরিবারসহ দাওয়াত নিলেন। শিশিরের সারাটা দিন খুব আনন্দে কাটল। রাতে সবাই যথাসময়ে হাজির হয়ে গেল। লক্ষ্মীর মা অনেক খাবারের আয়োজন করেছেন। পপি শিশিরকে দেখেই বলল—কিরে ডাইনোসরের ডিম এমন সেজেগুজে এসেছিস যে? বিয়ে নাকি তোর?
শিশির একটু হাসল। এই পপি আপুটা একটা জিনিস। ছোটবেলায় যখন ওরা সবাই একসঙ্গে খেলত, তখন রান্নাবাটি খেলায় সব সময় বাজার করার কাজটা শিশিরকে দিত। সে যখন বাজার করে ফিরত, তখন পপি তার চুল মুঠো পাকিয়ে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলত ‘কিরে মাত্র এই কয়টা বাজার এনেছিস? কত টাকা মেরেছিস? সত্যি করে বল, নইলে এমন মারা মারব তোকে’ খেলার মধ্যেও সে সত্যি সত্যি মারত। একবার তো এক থাপ্পড়ে কানের পর্দা ফাটিয়ে ফেলল! পুরো এক মাস লেগেছিল কান ঠিক হতে। খুব ডানপিটে ছিল, এখনো তেমনই আছে। এর সামনে পড়লেই পা কাঁপতে শুরু করে দেয় শিশিরের। সেই ছোট থেকে তাকে ডাইনোসরের ডিম ডাকে এখনো সেটা ভুলতে পারল না। এমন সময় পপি শিশিরের দিকে তাকিয়ে বলল—কিরে বিয়ের কথা শুনে তুই এমন লালটুস হয়ে গেলি কেন? তোকে তো দেখতে এখন গাধার মতো লাগছে! এদিকে আয়, বাসায় লেবু নেই চট করে দোকান থেকে দুই হালি এনে দে।
শিশির তখন বাবার দিকে তাকাল, দেখল তার বাবা তার দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে কটমটিয়ে তাকিয়ে আছে। শিশির তাড়াতাড়ি এখান থেকে সরে যাওয়াটাই বেটার অপশন মনে করল। তাই সে উঠে চলে গেল লেবু আনতে।
কিছুক্ষণ পর লক্ষ্মীর মা এসে সবাইকে খেতে ডাকলেন। শফিক সাহেব তখন লক্ষ্মীর বাবাকে বললেন—আমরা আসলে একটা বিষয় নিয়ে আলাপ করতে এসেছি। আগে কথা বলি তারপর নাহয় খাওয়া যাবে?
লক্ষ্মীর বাবা বললেন—আগে খাই গল্প পরে করা যাবে। পেট খালি থাকলে গল্প আবার জমে নাকি? হা হা হা...চলুন উঠুন।
সবাই খেতে বসেছে। শিশির চেয়ারে বসে লক্ষ্মীর দিকে তাকিয়ে কী সব ইশারা করছিল আর মুচকি হাসছিল। শফিক সাহেব সেদিকে তাকিয়ে জোরেশোরে একটা কাশি দিয়ে বললেন—শিশির খাবার টেবিলের ওপর, ওদিকে তাকিয়ে কী খুঁজিস তুই?
শিশির তাড়াতাড়ি নিজের প্লেটে মনোযোগ দিল। আর লক্ষ্মী সেখান থেকে সরে গেল। একটু পর শিশির খেতে গিয়ে একটা কাশি দিল আর লক্ষ্মী দৌড়ে এসে বলে ‘ঠেকল নাকি? আস্তে খাও, এই নাও পানি...’ শিশির লক্ষ্মীর দিকে তাকিয়েই পানি খাচ্ছে আর লক্ষ্মীও শিশিরের দিকে তাকিয়ে আছে...ফারজানা সেটা দেখে মুখ বেঁকিয়ে বলল—কিরে লক্ষ্মী, আজকে তুই কিছু রেঁধেছিস? নাকি খালি পানি আর হাসিই খাওয়াবি?
তখন শিশির বলল—করেছে তো, পায়েস রান্না করেছে। সবাই তখন শিশিরের দিকে একসঙ্গে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। শিশির প্রমাদ গুনল...মনে মনে নিজেকে গালি দিয়ে বলল—‘একটু কী চুপ থাকা যায় না?’
লক্ষ্মীর খালা রিমি তখন পাশ থেকে আঙুলে ওড়না প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে শিশিরের ছোট চাচাকে উদ্দেশ্য করে বলল—শাকিল ভাইয়া, আলু ভাজিটা কিন্তু আমি রান্না করেছি। আজই ইউটিউব দেখে শিখেছি, আপনার জন্য...না মানে অন্যদের জন্যও। (বলে রাখি, রিমি হচ্ছে লক্ষ্মীর ছোট খালা। যে বিয়ের জন্য ভীষণ রকম পাগল। বাড়ির কেউ অবশ্য সেটাকে পাত্তা দেয় না। ওদিকে তার এই পাগলামো শিশিরের ছোট চাচাকে দেখলে ভাতের বলকের মতো উতলে উতলে ওঠে)।
শাকিল আলু ভাজিটা নিতেই যাচ্ছিল কিন্তু রিমির কথা শুনে হাত গুটিয়ে ফেলে বলল—আলুতে আমার অ্যালার্জি আছে। খেলেই গলা চুলকায়, রাগ হয়, রাগে গালাগাল করতে ইচ্ছা হয়, তারপর যে রান্না করেছে তার মুখে ঘুষি মারতে মন চায়।
রিমি তখন কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল—এ আবার কেমন অ্যালার্জি? অ্যালার্জি হলে চুলকায় শুনেছি, কিন্তু রাগ হয়, গালাগাল, মারামারি আসে—এমন কিছু তো শুনিনি!
শাকিল বিরক্ত হয়ে বলল—সারা দিন স্নো, পাউডার, আলতা, লিপস্টিক নিয়ে পড়ে থাকলে জানবেন কেমন করে? জীবনে কোনো দিন সাজগোজের বাইরে কিছু শেখার চেষ্টা করেছেন?
হ্যাঁ করেছি তো। ‘আমি তো সারা দিনই রূপচর্চা আর তাড়াতাড়ি বিয়ে হওয়ার সব দোয়া শিখে ফেলেছি ইউটিউব দেখে দেখে...একটু ভাত দেই?’ বলে রিমি শাকিলের প্লেটে ভাত তুলে দিতে গেল।
শাকিল চেঁচিয়ে বলল, আমার কিন্তু ভাতেও অ্যালার্জি হয়ে যাবে।
রিনা খান তখন বললেন, এই রিমি ওর গায়ের ওপর উঠে যাবে নাকি? ওকে শান্তিতে খেতে দাও তো, ছেলেটাকে দেখলে আর হুঁশ থাকে না। অবশ্য খাবেই আর কী? রান্নার যা আয়োজন দেখছি! দেখে তো মনে হচ্ছে আমরা না বলে চলে এসেছি।
ফারজানা কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে আস্তে করে মাথা থেকে দুটো চুল ছিঁড়ে প্লেটে দিয়ে দিল তারপর জুড়ে দিল চিৎকার!
পপি তখন দ্বিগুণ তেজে বলল—খাবার সময় চুল ছেড়ে দিয়ে খাবি আর প্লেটে পেটে তা ঢুকবে না, তা–ই হয় নাকি? জীবনে তো চুলে শ্যাম্পুও দিস না। চুলের সঙ্গে উকুন পরেছে কয়টা, সেটাও দেখে নে। মাথা তো নয় যেন উকুনের অভয়ারণ্য! তোর জামাইর কী শ্যাম্পু কেনার টাকাটাও নাই?
ব্যস লেগে গেল ধুন্ধুমার কাণ্ড! ফারজানা আর পপিকে টেনে ধরে রাখা যাচ্ছে না। ২-৪টা কিল–ঘুষি না মেরে তারা কেউ থামবে না বলে পণ করেছে যেন। এর মধ্যে রিমি শুধু ‘শাকিল...শাকিল...আপনি ব্যথা পাবেন...প্লিজ সরে যান...’ বলে চিৎকার করছে। কেউ কাউকে থামাতে পারছে না। সবাই তারস্বরে চিৎকার করেই যাচ্ছে। অতঃপর বিয়ের আলোচনা শুরু করার আগেই বিয়ে ভেঙে গেল! শফিক সাহেব আর রিনা খান ছেলেকে ঘাড়ত্যাড়া ছাগলের মতো টানতে টানতে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। পপি আর ওর মা লক্ষ্মীকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। ওদিকে রিমি ‘আমার শাকিল...আমার শাকিল...’ বলে কেঁদে যমুনা নদী বানিয়ে ফেলেছে।
***
শফিক সাহেব, রিনা খান আর ফারজানা দরজা বন্ধ করে বিছানায় গোল করে বসে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছিল। কারণ, তাদের ‘বিয়ে ভাঙা’ মিশন সাকসেস হয়েছে। কিন্তু ফারজানার মনে বিরাট আফসোস রয়ে গেছে যে সে পপিকে দুটো ঘুষি মারতে পারেনি।
ওদিকে শিশির তার ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে আছে। কী করতে গেল আর কী হয়ে গেল! এটা কোনো কথা? এরপরে লক্ষ্মীকে বিয়ে করার কথা তো স্বপ্নেও বাবাকে বলা সম্ভব না। কিন্তু লক্ষ্মীকে ছাড়া তো তার চলবে না। কী হবে এখন? শিশির কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। লক্ষ্মীকে পাওয়ার সব দরজা এখন তার কাছে বন্ধ বলে মনে হচ্ছে! দুঃখে তার গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। সব দোষ ওই ফারজানা আর পপির। কী দরকার ছিল মারামারি লাগতে যাওয়ার? বিরাট কুস্তিগির হয়ে গেছে একেকটা! আর ফারজানা এত কুটনা হলো কবে থেকে? এমনিতে তো সবার সঙ্গে বেশ ভালো সম্পর্ক! ইচ্ছা করছে পপি আর ফারজানা দুটোকে একটা দরজা জানালা বন্ধ ঘরে বেঁধে রেখে বিটিভি চালু করে দেই। তাতে যদি তাদের স্বভাবের কিছু উন্নয়ন ঘটে। তখনই পপির ফোন এল। শিশিরের মোটেও ইচ্ছে হচ্ছিল না পপির সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু ফোন না ধরলে দেখা যাবে এক্ষুনি বাড়ি এসে কান ছিঁড়ে দিয়ে যাবে। তাই সে ফোন ধরল। ফোন ধরতেই পপি বলল—কিরে কি করছিলি?
—কিছু না।
—তোর সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।
—কী কথা?
—আমি জানি তুই এখন দরজা বন্ধ করে গরুর মতো হাম্বা হাম্বা করে কাঁদছিস। শিশির তখন কিছু বলতে গেল কিন্তু পপি ওকে পাত্তা না দিয়ে বলতে থাকল—লক্ষ্মীও খুব কান্নাকাটি করছে। আমি অনেক ভেবে দেখলাম তুই গাধা মার্কা হলেও ছেলে ভালো আছিস। তাই আমি চাই তোর সঙ্গে লক্ষ্মীর বিয়েটা হোক। যদিও কুটনি ফারজানা শাঁকচুন্নিটা বিরাট প্রবলেম...তবে ভেবে দেখলাম, ও তো আর এখানে থাকছে না। আর এলেও আমি তো আছি, লক্ষ্মীকে কিছু বললে ওর মুখ খুন্তি দিয়ে সেলাই করে দেব। কিন্তু সমস্যা হলো ওই শাঁকচুন্নি ফারজানা যে বিশ্রি কাণ্ড ঘটিয়ে গেছে এরপর আর বাড়ির কেউ এই বিয়েতে রাজি হচ্ছে না। তাই তোদের সামনে একটাই পথ আছে...তোরা পালিয়ে বিয়ে কর। আমি সব সাহায্য করব। কী বলিস?
শিশির আস্তে করে বলল, পালিয়ে বিয়ে? সেটা কী ভালো দেখাবে?
পপি বিরক্ত হয়ে বলল, তাহলে তুই তোর ভালো দেখানো নিয়ে থাক, আমি লক্ষ্মীর জন্য পাত্র দেখি?
—এভাবে বলছ কেন? আমাকে একটু ভাবতে তো দেবে?
—ভেবে কী করবি তুই? জীবনে দেখেছিস ভেবে ভেবে কোনো গাধা পৃথিবীর কিছু পরিবর্তন করতে পেরেছে? আমার এত কথা বোঝাবার সময় নেই। তুই তাহলে লক্ষ্মীর চিন্তা বাদ দে।
শিশির তখন ব্যস্ত হয়ে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে তুমি যা বলছ, তা–ই হবে।
—কাল বিকেল ৪টায় কাজী অফিস চলে আসিস। আমি লক্ষ্মীকে নিয়ে আসব।
—আচ্ছা। কিন্তু বাসার সবাইকে কে সামলাবে?
—তোদের বিয়ের সমস্ত দায়িত্ব আমার। বাসা আমি ট্যাকেল দেব, তোর কিছুই করতে হবে না কিন্তু একটা শর্তে...
—কী শর্ত!
—তোর ওই অ্যালার্জি চাচাকে বিয়ে করতে হবে রিমি খালাকে। দুটো বিয়ে একসঙ্গে হবে।
—কী বলছ এসব! ছোট চাচা রিমি খালাকে দেখলেই বিরক্ত হয়ে যায়, বিয়ে করবে কী করে?
—ওর অ্যালার্জি আমি জন্মের মতো ঘুচাব। সে জন্যই এই বিয়েটা দরকার। আর এই বিয়ে না হলে তোর বিয়ে বাতিল। ভাবিস না ক্যানসেল হয়ে গেল আর মিটে গেল। বিয়ে যদি ক্যানসেল হয় তো তোর বেঁচে থাকা হারাম করে না দিলে আমার নামও পপি না।
শিশিরের গলা শুকিয়ে চৈত্রের খরা হয়ে গেল। পপি তাকে যে হুমকি দিচ্ছে, তা তাকে মেনে নিতেই হবে। কারণ, ও যা করবে বলে হুমকি দেয়, তার চেয়ে বেশি ঘটায়! সে তখন মিনমিন করে বলল—ঠিক আছে আমি ছোট চাচাকে নিয়ে আসব। কিন্তু এই বিয়ের দায়িত্বও তোমার।
—‘ঠিক আছে। এই পপি কাউকে ভয় পায় না। ঘুমা এখন।’ বলে পপি ফোন রেখে দিল।
শিশিরের ঘুম এল না। একদিকে লক্ষ্মীকে পাওয়ার আনন্দ, অন্যদিকে ছোট চাচার বিয়ে নিয়ে আতঙ্ক! কী হবে আগামীকালটা?
***
কাজী অফিসে পপিরা এসে বসে আছে। ওদের আসার ১৫ মিনিট পর শিশির আর ওর ছোট চাচা এল। শাকিল ওদের দিকে তাকিয়ে বড় একটা ধাক্কা খেল। কারণ, বউ সাজে সে যাকে দেখছে, সে লক্ষ্মী নয়! লক্ষ্মীর বিয়ে অথচ ও একদম সাধারণভাবে বসে আছে ওদিকে বউ সাজে যাকে দেখা যাচ্ছে, সে রিমি!!! পাগলটা বিয়ে দেখতে এসেছে বউ সেজে! বিয়ের যত কিড়া আল্লাহ মনে হয় এই মাথাতেই দিয়ে দিয়েছে। রিমি তখন শাকিলের দিকে একবার তাকাল আর সঙ্গে সঙ্গে লজ্জা পেয়ে মুখ নামিয়ে ফেলল...শাকিল তখন ‘ন্যাকা ষষ্ঠী’ বলে কাজির দিকে এগিয়ে গেল। অতঃপর কাজি সাহেব ওদের ডাকলেন বিয়ে পড়াবার জন্য। আর তখনই কারেন্ট চলে গেল। কারেন্ট যেতেই রিমি চেঁচিয়ে উঠল—‘ও বাবাগো...শাকিল আপনি কোথায়? আমার খুব ভয় করছে...আমার হাতটা ধরেন প্লিজ...‘শাকিল সেটা শুনে বলল—হাত কেন, আপনার গলা চেপে ধরি? ভূতের ভয় চিরতরে সাঙ্গ হয়ে যাক?’
শাকিলকে আর গলা চেপে ধরতে হলো না, তার আগেই কারেন্ট চলে এল। কারেন্ট আসতেই শিশির তাকিয়ে দেখে, তাদের দুই পরিবারের সবাই এখানে হাজির! সে আতঙ্কে জমে গেল। এরা এখানে কী করে এল!!! কী হবে এখন? তার বাবার রক্তচক্ষুর দিকে তাকাতেই তার টয়লেট পেয়ে গেল...সে অতি কষ্টে মুখ ফুটে বলল—‘পপি আপু...’
পপি সঙ্গে সঙ্গে বলল—কিসের পপি? আমি তোকে চিনি না, যা ভাগ।
শিশির বুঝে ফেলল পপি তাকে ফাঁসিয়েছে এবং খুব খারাপভাবেই ফাঁসিয়েছে। পল্টিবাজ পপিকে এভাবে বিশ্বাস করে ধরা খাওয়ার জন্য এখন তার ইচ্ছে হচ্ছে সাইকেলের নিচে পড়ে হাত পা ছুড়ে গড়াগড়ি করে জান দিয়ে দিতে। সবাইকে এখন সে কী জবাব দেবে? কী করবে?
শিশিরের চেহারাটা এই মুহূর্তে যা হয়েছে, তা দেখে যে কারওরই মায়া লাগবে কিন্তু তার সামনে দাঁড়ানো মানুষগুলোর মোটেও মায়া হচ্ছে না বরং সবাই তার দিকে ক্ষুধার্ত বাঘের মতো চকচকে চোখে তাকিয়ে আছে। এখন যা করার তাকেই করতে হবে। সে এর থেকে বের হওয়ার দ্রুত একটা উপায় খুঁজল এবং হুট করে পেয়েও গেল। সে লক্ষ্মীর হাত ধরে সবাইকে ঠান্ডা মাথায় বলল—‘তোমরা কেউ আমাদের বিয়ে আটকাতে পারবে না। যদি ভুলেও সে চেষ্টা করো তাহলে আমি এক্ষুনি ট্রিপল নাইনে কল করে পুলিশ ডাকব।’
আর তখনই সবাই হা হা করে হেসে উঠল। হাসির শব্দে একেবারে ছাদ উড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। শিশির বুঝল না সবাই হুট করে এমন বিকট শব্দে হেসে উঠল কেন?
ফারজানা তখন তাকে পুরো ঘটনা খুলে বলল। আসলে সবকিছুই প্ল্যান করে করা হয়েছে সেই শুরু থেকেই। তোমরা নিজেরা নিজেদের পছন্দ করে সব পেটের ভেতর চেপে রেখেছ তাই আমরা সেটার হালকা একটা প্রতিশোধ নিলাম। লক্ষ্মীকে শিশিরের বউ হিসেবে সবারই খুব পছন্দ কিন্তু একটা প্রেম হবে আর সেখানে এক দিনও দুশ্চিন্তা হবে না, ঝামেলা হবে না, ভিলেন থাকবে না, সেটা তো হয় না। তাই সবাই মিলে স্টোরিটাতে টক, ঝাল, মিষ্টি মিলিয়ে ককটেল বানিয়ে দিলাম। তা ছাড়া সবার ইচ্ছে ছিল এই বিয়েটা একটু অন্য রকম হোক, একটু ড্রামাটিক হোক। তাই এ আয়োজন। সবাই মিলেই এটা করেছে। শুধু তোরা দুজন জানতি না। কেমন লাগল সারপ্রাইজ?
শিশির আর লক্ষ্মী সবার কথা শুনে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইল। তাদের মাথা কাজ করতে চাইছে না। তারা ঠিক কাকে বিশ্বাস করবে সেটা ক্লিয়ার হতে পারছে না। সেই সময় রিমি চেঁচিয়ে উঠল ‘উফফ ভাল্লাগে না, এত কথা কিসের? আমার বিয়েটা কখন হবে? কেউ কী দেখছে না বিয়ের দেরি হয়ে যাচ্ছে? সেই সকাল থেকে বউ সেজে বসে আছি সেটা কেউ দেখছেই না...’
শাকিল অবাক গলায় বলল—আপনারও বিয়ে? কবে, কার সঙ্গে?
রিমি লাজুক গলায় বলল—‘কেন আপনার সঙ্গেই তো।’
কথা শুনে শাকিলের বুকে ব্যথা করে উঠল। কী বলে এই মেয়ে? এ রকম একটা আহ্লাদের বাক্স সে নিজের গলায় ঝুলিয়ে নেবে? সে মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল শিশির তাকে ধরে ফেলল। শাকিল তখন বিড়বিড় করে বলল—পালাতে হবে আমাকে...পালা শাকিল, পালা...নয়ত তোর জীবন পাতলা ডালের ঢ্যালঢ্যালা খিচুড়ি হয়ে যাবে!
এদিকে শফিক সাহেব রিমির কথা শুনে আনন্দে আত্মহারা। কারণ, ছেলের বিয়ের সঙ্গে ভাইয়ের বিয়েটাও বিনা খরচে দিয়ে ফেলা যাচ্ছে। তিনি ঘোষণা করলেন শিশির এবং লক্ষ্মীর পাশাপাশি শাকিল আর রিমির বিয়েটাও এখনই হয়ে যাবে যদি না রিমির পরিবারের কোনো আপত্তি থাকে। রিমির বোন দুলাভাই কোনো আপত্তি করলেন না, বরং তারা ভীষণ খুশি একে বিদায় করতে পেরে।
অতঃপর শিশির আর লক্ষ্মীর বিয়ে হয়ে গেল। তারপর শাকিল আর রিমির বিয়ে। শাকিল কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না দেখে পপি একটা স্টিলের ডান্ডা হাতে নিয়ে ওর পাশে দাঁড়িয়ে রইল যাতে পালাতে না পারে। শেষমেশ চূড়ান্ত মেজাজ খারাপ, রাগ আর হতাশা নিয়ে শাকিল বিয়ে করতে কাজীর সামনে বসল। সে মনে মনে বলল—‘জীবিত মানুষটাকে তুই বিবাহিত করে দিলি! আসিস বাসরঘর করতে তোকে যদি পাঞ্চিং ব্যাগ বানিয়ে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে না দিয়েছি তো আমার নামও শাকিল না। রিমি তুই শাকিল দেখেছিস কিন্তু শাকিলের ঘুষি দেখিস নাই। তোর বিয়ের সাধকে আমি এক রাতে ইতিহাস বানিয়ে ফেলব।’ কিন্তু কী অদ্ভুত, কবুল বলার পর থেকেই রিমির প্রতি অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে। বারবার ওর দিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে। একটু ভুটকি হলেও রিমির মুখটা কী মিষ্টি! আর এতটাও ন্যাকা নয়, আমি একটু বেশিই ভেবে ফেলেছিলাম মনে হয়। রিমি কাঁদছিল দেখে তার মায়া হতে লাগল...রিমিকে টিস্যু বের করে দিল, পানি এগিয়ে দিল...তারপর মুখ ফসকে বলে ফেলল—‘বউ, আমরা হানিমুন করতে কোথায় যাব?’
কী একটা অবস্থা!!!
লেখক: শামীমা জামান, শিক্ষিকা, প্রেসিডেন্সি স্কুল, সাভার, ঢাকা
**লেখা, ভ্রমণ অভিজ্ঞতা ও ছবি পাঠাতে পারবেন আপনিও। ঠিকানা [email protected]