স্বীকারোক্তি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

অলিপুর গ্রাম। স্নিগ্ধ সকাল। পূর্ব আকাশে সূর্য উঁকি দিতে শুরু করছে। আধাপাকা ধানের বাঁকানো শিষের ডগায় জমে আছে শরতের শিশির। সূর্য হতে বিকিরিত তীর্যক আলো শিশিরের পড়ন্ত ফোঁটা ভেদ করে চোখে আঘাত করছে। পূর্ব দিক থেকে চলে আসা সাপের মতো আঁকাবাঁকা কাঁচা রাস্তা। রাস্তাটি জেলা শহরে মূল রাস্তা থেকে এসে অলিপুর গ্রামকে দুভাগে ভাগ করছে। গ্রাম থেকে জেলা শহরের দূরত্ব আট–দশ কিলোমিটার। কাঁচা রাস্তার কারণে গ্রামটি এখনো প্রত্যন্ত অঞ্চল বলেই মনে হয়। রাস্তার পাশে অলিপুর উচ্চবিদ্যালয়। সকাল গড়াতেই ছাত্রছাত্রীদের হইচই শুরু হয়। থাকে বিকেল পর্যন্ত। তারপর নীরব। আশপাশে তেমন সাড়াশব্দ থাকে না। তখন গাছের পাতা কিংবা ছোট ডাল পড়ার শব্দও স্পট ঠাহর করা যায়।

তমিজউদ্দিন স্কুলের নাইট গার্ড। বয়স ৫২ কিংবা ৫৮। স্কুলের অল্প দূরত্বেই তার বাড়ি। সন্ধ্যা থেকে শুরু করে ফজরের নামাজ পর্যন্ত সে ডিউটি করে। তারপর অর্ধবেলা পর্যন্ত ঘুমায়। সকালবেলা কাঁচা রাস্তা দিয়ে একটি সাদা গাড়ি আসতে দেখা যায়। স্কুলের কৌতূহলী বাচ্চারা মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে কখন গাড়ি স্কুলের পাশে আসবে। দেখতে দেখতে গাড়ি স্কুলের কাছে চলে আসে। দাঁড়ায় স্কুলের পেছনের রাস্তায়। ধপাধপ করে কয়েকজন লোক নেমে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে চলে আসে। একজন বলে, আমরা গোয়েন্দা থেকে এসেছি। পরক্ষণেই জিজ্ঞেস করে, ‘তমিজউদ্দিন কোথায়? তার বাড়ি কত দূরে?’

হঠাৎ গোয়েন্দা আগমনে প্রধান শিক্ষক আবুল হোসেন কিছুটা ভড়কে যান। নিজেকে সামলে নিয়ে নিজের কক্ষ থেকে বের হয়ে তমিজউদ্দিনের বাড়ি দেখিয়ে দেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি তমিজউদ্দিনের বাড়ি থেকে তাকে হাতকড়া পরিয়ে গাড়িতে করে নিয়ে যায়। গ্রামজুড়ে শুরু হয় হইহুল্লোড়। ততক্ষণে মানুষের জটলা বেঁধে যায় স্কুলের পেছনে। ভিড়ের মধ্যে জসীম শেখ বলে ওঠে, ‘কী করছে তমিজউদ্দিন? পুলিশ তাকে ধরে নেবে কেন? বড় পরহেজগার মানুষ সে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। কারও কোনো ক্ষতি সে কোনো দিন করেনি।’ ‘নিরপরাধ মানুষকে কেনই বা পুলিশ ধরবে?’, পাশ থেকে বলে ওঠে আক্কাস আলী। তমিজউদ্দিনকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার পরদিন রেখাকেও পুলিশ ধরে নিয়ে যায়।

রেখা খাতুন তমিজউদ্দিনের দ্বিতীয় মেয়ে। পাশের গ্রামের বদরুলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বদরুল নেশাখোর হওয়ায় রেখা তাকে অপছন্দ করতে শুরু করে। সে কাজ নেয় বিসিক শিল্প নগরীর গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে। ফ্যাক্টরিতে পরিচয় হয় বাশারের সঙ্গে। একসঙ্গে দুজন আসা–যাওয়া করে। ফিরতে সন্ধ্যা হলে রাস্তা ফাঁকা থাকে বিধায় ভয় হয় রেখার। বাশার খানিক এগিয়ে দিয়ে যায়। সারা দিন দুজন একসঙ্গে কাজ করে, তবুও রাতে বাশারের সঙ্গে কথা বলার জন্য তার প্রাণটা বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। সকালে দেখা হবে জেনেও রাতটুকু শেষ হতে চায় না। রেখা ফোন করে বাশারকে। কথা বলে। প্রাণটা একটু শান্ত হয়। রেখার অস্থির ভাব দেখে রেখাকে সন্দেহ হয় বদরুলের। এ নিয়ে ঝগড়া হয় দুজনের।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বদরুল তমিজউদ্দিনকে সন্দেহের কথা জানালে সে বলে, ‘রেখা অনেক ভালো মাইয়া, এমন কাজ সে কখনো করবার পারে না।’ কিন্তু এতে বদরুল আশ্বস্ত হতে পারে না। রেখার প্রতি বদরুলের সন্দেহের পারদ ওপরে উঠতে থাকে। রাতে সে নেশা করে ফেরে। নেশার ঘোরে খাবার চায়। রেখা বলে, ‘সারাক্ষণ নেশার মধ্যে থাকো, খাবার আসবে কই থেকে, শুনি? ঘরে রান্না হয়নি আজ।’ কথা শুনে মাথায় রক্ত উঠে যায় বদরুলের। পাশে বসে থাকা রেখার কোমর বরাবর সজোরে লাথি মারে সে। প্রচণ্ড যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করে রেখা।

তমিজউদ্দিনের বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে কামালপুর গ্রাম। সে গ্রামেই বাশারদের বাড়ি। বাশার মা–বাবার দুই ছেলের মধ্যে ছোট। বয়স বাইশ। উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর আর পড়াশোনা করেনি সে। বড় ভাই আবসার তার পাঁচ বছরের বড়। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করে সে। জমিলা খাতুন বড় আদরে মানুষ করেছেন দুই ছেলেকে। বাশারের চাচি জমিলা খাতুনকে বলে, ‘আপা, এহন তো আপনার সুখের দিন পড়ছে, এইবার বাশারকে একটা বিয়া করান।’ জমিলা খাতুন পানের পিক ফেলতে ফেলতে বলে, ‘আগামী শীতে ছেলের বউ নিয়ে আসব ঘরে।’

‘আজকে ফিরতে দেরি হবে, মা’ বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় বাশার। কিন্তু রাত হলেও সে বাড়ি ফিরে আসে না। জমিলা খাতুন ছটফট করে রাত শেষ করে। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে ছেলের খোঁজ পেতে বেরিয়ে পড়েন তিনি। পাগলের মতো সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ নেন। ফ্যাক্টরিতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাত আটটায় সে ফ্যাক্টরি থেকে বের হয়েছে। কোথাও কোনো খোঁজ না পেয়ে থানায় গিয়ে সাধারণ ডায়েরি করে আবসার। তারপরও কোনো হদিস মেলে না বাশারের। মায়ের মনে সন্দেহ হয়, কোনো দুর্ঘটনার শিকার হলো বাশার? অপেক্ষায় একদিন–দুদিন করে মাস যায়, বছর যায়। ছেলে ফিরে আসে না। এভাবে চলে যায় দুবছর।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বাশার নিখোঁজ হওয়ার পর রেখার বিমর্ষ লাগে। নিজের মধ্যে পাপবোধ কাজ করে। বদরুলের কার্যকলাপ একদম সহ্য হয় না তার। প্রতিদিন ঝগড়া হয়। সেদিন সকালে ঝগড়ার সময় বদরুল রেখার চুলের মুঠি ধরে দুই গালে থাপ্পড় মারে। রেখা কোনোমতে হাতটা সরায়। তারপর পাশে থাকা একটা বাঁশ দিয়ে বদরুলের ঘাড়ে আঘাত করে। একপর্যায়ে বদরুল তালাক দেয় তাকে। রেখাও ছেড়ে দেওয়ার লোক নয়। ‘তোর চৌদ্দগুষ্টিকে জেলের ভাত খাওয়াব’ বলে হুমকি দেয়। তারপর নারী নির্যাতন আইনে মামলা করে রেখা। মামলায় গ্রেপ্তার হয় বদরুল।

বদরুলকে জেলা কারাগারে পাঠায় পুলিশ। জেলখানায় বদরুলের অনেক সঙ্গী জোটে। আব্বাস আলী, রমেশ চন্দ্র, নূর আলী, গয়েশ্বর—এরা সবাই বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত আসামি। জেলখানার আড্ডায় কে কত বড় অপরাধ করছে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে চলে শক্তির বাহাদুরি। যার অপরাধ সবচেয়ে জঘন্য তার বাহাদুরি সবচেয়ে বেশি। আব্বাস বলে, ‘কিরে বদরুল, বউয়ের হাতে মার খেয়েছিস আবার নারী নির্যাতনের মামলায় জেলেও আছিস। তুই কি পুরুষ নাকি মহিলা।’ কথা শুনে তুচ্ছার্থক ভঙ্গিতে সবাই হু হু করে হেসে ওঠে। এতে বদরুলের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো লাগে। সে বলে, ‘আমার মতো অপরাধ তোমরা কেউ করলে সরাসরি ফাঁসি হবে।’ ‘তোর ব্যাডা ফাঁসি হওয়া লাগবে না, তুই বউয়ের হাতেই মরবি’, বলে গয়েশ্বর।

রাত গভীর হলেও চলছে নিজেদের অপরাধের বাহাদুরি। সবাই মিলে বদরুলকে টিপ্পনী কাটে। বদরুলের গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে, লোমগুলো দাঁড়িয়ে যায়। সে বলে ওঠে, ‘বউয়ের নাগরকে খুন করেছি দুবছর হলো। কেউ আমার কিচ্ছু করতে পারে নাই। তোমরা করলে তো এত দিনে তোমাদের কবরে দূর্বা গজাত।’ সবাই একটু নড়েচড়ে বসে। খুন করেছে বদরুল? সবাই অতি উৎসাহে শুনতে চায়, কিভাবে এত সাহসী কাজ সে করছে। বদরুল বলে, ‘কামালপুরের বাশার ছিল তার বউয়ের প্রেমিক। সেদিন রাতে বাশারকে ফোনে ডাকে রেখা। কিছুক্ষণ পরেই বাশার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে আসে’, বলে থামে বদরুল। সবাই সাগ্রহে তাকিয়ে থাকে বদরুলে মুখপানে। নূর বলে, ‘তারপর কী হলো?’ ‘তারপর, আমি আর আমার শ্বশুর মিলে বাশারকে নিয়ে যাই স্কুলঘরে। দরজা বন্ধ করে দিই। সঙ্গে থাকা স্কচটেপ লাগিয়ে দিই মুখ বরাবর, যাতে কোনো শব্দ বাইরে যেতে না পারে। শ্বাসরোধ করে খুন করি বউয়ের প্রেমিককে’, বলে হো হো হেসে ওঠে বদরুল। চোখ দুটি বের হয়ে আসতে চায় তার, চেহারায় ফুটে ওঠে হায়েনার অবয়র।

আব্বাস পাশে চুপচাপ শুনছিল বদরুলের রোমহর্ষ কাহিনি। সে বলল, ‘খুন করছ বুঝলাম, কিন্তু বাশারকে কেউ খোঁজ করল না?’ ‘খোঁজ করছে। পায়নি’, বলে বদরুল। সবার অনুসন্ধিৎসু চোখ তাকিয়ে আছে বদরুলের দিকে। সে বলে চলছে, ‘মৃত বাশারকে স্কুলঘরের টয়লেটের নিচে চাপা দিয়ে দিছি। রেখার বাবা নাইট গার্ড ছিল বলে অতি সহজে কাজটি করতে পারছি। কেউ আমাদের কিচ্ছু করবার পারে নাই’, বলে আরেকবার হাসে বদরুল।

তিন মাস পর জেল থেকে ছাড়া পায় আব্বাস। আব্বাসের বাড়ি কামালপুর গ্রামে। বাশার নিখোঁজের ব্যাপারে সে জানত। সে খুনের খবর দেয় বাশারের মাকে। জমিলা খাতুন সব শুনে হত্যা মামলা করে থানায়। সে মামলায় পুলিশ অভিযান চালিয়ে তুলে নেয় তমিজউদ্দিন ও রেখাকে।

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়