৩০ বছর পর...
আমাদের এসএসসি ব্যাচ-৯২। সময়ের স্রোতে ৩০ পার হয়ে ৩১-এ। যাপিত জীবনের হিসাবে নেহাত কম নয়। বড় পরিসরে আমাদের একত্রিত হওয়া হয়নি। যাপনের নানা সময়েই একত্রিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষারা জেগে উঠত, কিন্তু নাগরিক ব্যস্ততা, অফিস, পরিবার—সবকিছু মিলিয়ে আর হয়ে ওঠেনি।
আমরা উপলব্ধি করলাম, না, এভাবে চলতে পারে না। সময় বের করতে হবে। ২০২৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। আমরা একত্রিত হলাম। সংখ্যা খুব বেশি না। ৩৭ জন। ভবিষ্যতে সংখ্যাটা আরও অনেক বাড়বে, এ আত্মবিশ্বাস নিয়ে শুরু করলাম।
এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। সেই ১৫-১৬ বছরের কৈশোরের সময় যেন আছড়ে পড়ল সবার সামনে। ওই সময় একে অপরকে সর্বোচ্চ সম্বোধনের ভাষা ছিল তুই-তুমি। কালের আবর্তে সামাজিক ও অবস্থানগত কারণে নিজেদের ভেতর তুই-তোকারি উঠে আপনি জায়গা করে নিয়েছে। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, বর্ডার ক্রস করে যারা একে অপরকে তুমি-আপনি বলে সম্বোধনের রাস্তায় ছিল, তারা তুই-তোকারি করে একে অপরকে ডাকছে। আহ্, কী শান্তি!
স্কুলসংলগ্ন খাল থেকে আমাদের ট্রলার ছাড়ার পর সবার শরীর থেকে স্কুলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল। আহ্, কী সুঘ্রাণ। ৩০ বছরে ঘ্রাণের মাত্রা না কমে যেন বেড়েছে।
প্রাথমিক সিদ্ধান্তে আমরা নৌপথে চরফ্যাশনের তারুয়া ও চর কুকরি-মুকরিতে দুই দিনের সফরের প্রোগ্রাম করি। কিন্তু ব্যাচের বন্ধুরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কর্মব্যস্ততার কারণে ছুটি বা সময় বের করতে পারেনি। তারপরও ঢাকা থেকে ছুটে এসেছে লেলিন, সাখাওয়াত, শিমুল, শহীদুল। ফেনী থেকে সুনীল। বগুড়া থেকে মোশারেফ। বরগুনা থেকে তৌফিক রুমু। অন্যদের অবস্থান মোটামুটি জেলার ভেতরই। নানা দিক বিবেচনা করে ট্রলারে তেঁতুলিয়া নদীর মাঝখানে জেগে ওঠা বিভিন্ন চর দেখে সুবিধাজনক একটায় নেমে পড়ার সিদ্ধান্তে পৌঁছাই। তবে মাসুম আর মুজিব তারুয়া, চর কুকরি-মুকরিতে যাওয়ার পক্ষে সোচ্চার ছিল। শেষ পর্যন্ত আগামী বছর ওই স্থানে যাওয়া হবে, এ প্রতিশ্রুতিতে তারা রণে ভঙ্গ দেয়।
আমরা যদিও উপকূলের মানুষ, মেঘনা-তেঁতুলিয়া আমাদের পূর্ব-পশ্চিমে—সেই হিসেবে নদী বা চরে খুব একটা যাওয়া হয় না। পেশাগত কারণে আমি মাঝেমধ্যে যাই। এক-একটা চরও যে অপর সৌন্দর্যের আধার হতে পারে, এটা অনেকেই জানে না। আমি আশ্বস্ত করলাম, নদী আর চর তোদের নিরাশ করবে না।
আমাদের শিকড় বোরহানউদ্দিন সরকারি উচ্চবিদ্যালয়সংলগ্ন খালে বাউফল থেকে আসা ট্রলার থাকার কথা ৮টায়। সময়মতো সবাই উপস্থিত। কিন্তু ট্রলারের দেখা নেই। মাঝির ফোনে জানা গেল কুয়াশার কারণে নদীতে আটকা পড়েছে। আসতে দেরি হবে। স্কুলমাঠে পূর্ব নির্ধারিত নাশতা খিচুড়ির প্যাকেট সবার হাতে পৌঁছে দেওয়া হলো। আমাদের সঙ্গের বাবুর্চি দেলোয়ার গ্যাসের চুলায় চা বানিয়ে দিল। দেলোয়ারের চা খেয়ে সবার প্রশংসা।
এর মধ্যে স্কুলের মাঠে খুনসুটি, স্মৃতি বিনিময় চলছে। তারপর সবার গ্রুপ ছবি তোলার পালা। নানা অ্যাঙ্গেলে ছবি তোলা হলো। এর মধ্যে ট্রলার চলে এল। কালবিলম্ব না করে সবাই ট্রলারে উঠে বসল। ট্রলারে একের পর এক কোরাস, একক গান গাইতে গাইতে চর লতিফে ভিড়লাম। সবাই নামল। আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। যেদিকে দুচোখ যায়, শসাখেত। খেত থেকে শসা তোলা হচ্ছে। গাছ থেকে তাজা শসা ছিঁড়ে খেতে কার না ইচ্ছা হয়। শসাখেতের মালিককে বললাম। উনি বললেন, যত পারেন খান। আমরাও মোটামুটি ঝাঁপিয়ে পড়লাম। তিন-চার-পাঁচ যে যে কয়টা পেরেছে, খেয়েছে। খেতের মালিক আবার ট্রলারে বসে কেজি দশেক দিয়েও দিলেন। চর শরিফাবাদে ভিড়ে দেখি শত শত একর তরমুজখেত। সবে ফুল থেকে ফল ছেড়েছে। আরেক দিকে দেখা মিলল বাঙ্গির খেত। শত শত মহিষ যেন চর কুঞ্জের দখল নিয়েছে। একেকটা চরে একেক ধরনের ফসলের বৈচিত্র্য, প্রাণীর বৈচিত্র্য, জীবনযাত্রার বৈচিত্র্যে আমরা মুগ্ধ।
সবশেষে আমরা নামলাম চর গ্রিসের কাছের জনমানবহীন এক চরে। এখানে আমরা রাজা; আমরা প্রজা। মাসুদ সঙ্গে করে নদীতে মাছ ধরতে ঝাঁকি জাল নিয়ে এসেছে। মাসুদ জাল ফেলছে, কিন্তু মাছ তেমন ওঠেনি। একে একে জাল ফেলায় যোগ দিল মঞ্জু, মোশারেফ, লেলিন, সাখাওয়াত, ভুট্টো। জালের পর্ব শেষ হওয়ার পরই ফুটবল ম্যাচ। দুই গ্রুপে ১৭ জন করে। খেলা ১-১ গোলে ড্র।
এবার গোসল করে নামাজ। তারপর খাওয়ার পালা। আমরা জনা দশেক নদীতে নেমে পড়লাম। অন্যরা ঠান্ডার ভয়ে নামবে না। ওমা! দু-তিন মিনিট আমাদের ডোবাডুবির পর দেখি এক এক করে নদীতে নামছে। সবাই যেন কৈশোরে চলে এল। কেউ কারও গায়ে মাটি মাখিয়ে দিচ্ছে। কেউ মাটি তুলে কারও গায়ে মারছে। কেউ নিজেকে সেভ করতে ডুব দিচ্ছে।
গোসল শেষে দেলোয়ার বাবুর্চির রান্না করা দুপুরের খাবার। খোলা আকাশের নিচে চরের মাটিতে বসে এটা হয়তো সবার প্রথম এ রকম খাওয়া। কিন্তু সবার চোখে তৃপ্তির ঢেকুর। তেঁতুলিয়া নদীতে নিজেদের ঝাঁকি জাল ফেলা, চরে ফুটবল খেলা, নদীতে গোসল, সাঁতার, মাটি ছোড়াছুড়ি, লটারি ড্র, এক বন্ধুর বিবাহোত্তর সংবর্ধনা, ব্যাচের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা শেয়ার করতে করতে দেখি সূর্যমামা ডুব দিচ্ছে। মনে হলো, আজকের দিনটা এত ছোট কেন! আর একটু বড় হলে কী এমন ক্ষতি হতো!
লেখক: শিক্ষক ও সংগঠক
**নাগরিক সংবাদে লেখা পাঠাতে পারেন [email protected] এ