প্রেরণাদায়ী মা

মা দিবস পালিত হয়েছে ১২ মে। পাঠকের লেখা থেকে বাছাই করা লেখা প্রকাশিত হচ্ছে নাগরিক সংবাদে

মাপ্রথম আলো

আমার মা। আমাকে যিনি গর্ভে ধারণ করেছেন, যাঁর গর্ভে আমি একটু একটু করে বেড়ে উঠেছি।

ছোটবেলা থেকেই খুব দুরন্ত আমি। দুই ভাইয়ের পর আমার জন্ম। দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় ভাই ক্যাপ্টেন খায়রুল আনাম (শাহীন) আরেক ভাই চিকিৎসক সদরুল আনাম (তাজীন)। মায়ের নাম হুরুন্নেসা রউফ। বাবা আবহাওয়াবিদ মো. আবদুর রউফ। আমার পর আরেক বোন রওশন আরা রোশনা।

যা–ই হোক, দুরন্ত আমি শুধুই মুরগির সঙ্গে খেলতাম। মা মুরগি পালতেন আর ডিমে বাচ্চা হতো—তখন মায়ের হাতে সেলাই করা জামা ছড়িয়ে দিয়ে ওখানে খাবার দিতাম— মুরগির বাচ্চারা খুটখুট করে খাবার খেত। সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। আমরা থাকতাম চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ সরকারি কলোনিতে।

পাড়াবেড়ুনী দস্যি মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেল রবীন্দ্রনাথের সমাপ্তির নায়িকার মতোই। ১৯৭৪ সালে এসএসসি পাস করলাম। ১৯৭৫ সালের ১৪ এপ্রিল (১ বৈশাখ) বিয়ে হলো। ১৯৭৬ সালে মা হলাম। সবকিছু এত তড়িৎ গতিতে হয়ে গেল, আমি যেন কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। চার মাস বয়সের শিশুকন্যাকে রেখে এইচএসসি পরীক্ষা দিলাম। কী পরীক্ষা দিলাম, কিছুই পড়া নেই। এক ঘণ্টায় পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে এলাম। মা বুঝিয়ে আবার পরীক্ষা হলে পাঠালেন। চট্টগ্রাম নাসিরাবাদ সরকারি বালিকা মহাবিদ্যালয়ে পড়তাম। পাসও করে গেলাম।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় (সম্মান) পরীক্ষার জন্য গেলাম। আমাদের সেশন জটের জন্য ১৯৭৬ এবং ১৯৭৭ একসঙ্গে করা হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় লিখিত পাস করলাম কিন্তু মৌখিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলাম। কারণ, তখন আমি আবার মা হতে চলেছি। স্যাররা বললেন, তাঁরা একটা সিট নষ্ট করতে চান না।

খুব কষ্ট হলো, যা–ই হোক, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে বাংলায় (সম্মান) ভর্তি পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করে কলেজে নাম লেখালাম। সবই সম্ভব হলো আমার মায়ের জন্য। রাগ করে বইপত্র সব ছুড়ে ফেলতাম। মা আদর করে বলতেন—দেখো, তোমারই ভালো লাগবে, এমএ পাস করলে।

দুটো বাচ্চাকে গোসল করিয়ে দুধের শিশিতে দুধ ভরে কলেজে যেতাম। সকাল সাড়ে ৯টায় কলেজে যেতাম আর বিকেল ৪টায় ফিরে আসতাম। স্যারদের লেকচার আমার মাথায় থাকত। বইয়ের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই।

মা না থাকলে আমি কখনোই পড়তে পারতাম না। মায়ের বাসায় থাকতাম। মা দুটো বাচ্চাকে সামলাতেন। তাই আমি কলেজ করতে পারতাম। টেবিলের নিচে বেড়াল তার বাচ্চাকে রেখে বাইরে যেত। আবার ফেরত আসত। মা আমার বাচ্চাকে বলতেন—ওই দেখো বিড়ালের আম্মু, তার বাচ্চাদের রেখে কলেজে গেছে। আবার ফেরত আসে। তার পর থেকে আমার ছোট মেয়ে রোজীনা মুস্তারীন টুশি আর কাঁদত না। বলত—‘বিড়ালের আম্মু কলেজ যায়, আমার আম্মুও কলেজে যায়।’

এমনি করেই আমি পড়েছি। মা বলতেন—তুমি যখন তোমার বন্ধুদের কাছে যাবে, তখন তোমাকে খুব ছোট মনে হবে। এভাবে বাচ্চাদের রেখে আমি অনার্স পাস করেছি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ শেষ করেছি। যেদিন এমএ পরীক্ষা দিই, তার সাত দিন পর আমার ছেলে হয়। শোয়েব আহমেদ। মায়ের অনুপ্রেরণাই আমাকে পড়তে শিখিয়েছে। কোনো বাধাই আর বাধা মনে হয়নি।

আমার বড় মেয়েটি সামিনা মুস্তারীন কুয়েট থেকে পাস করেছে। সে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। দ্বিতীয় মেয়েটি রোজীনা মুস্তারীন হলি ক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে পাস করেছে। দীর্ঘদিন ভোরের কাগজ এবং পরে প্রথম আলো পত্রিকায় ‘নকশা’ এবং ‘আনন্দ’ পাতায়  কাজ করেছে। বাংলাদেশের আন্তবিশ্ববিদ্যালয়গুলো ২০০২ সালে ইংরেজি কবিতা আবৃত্তিতে প্রথম স্থান অধিকার করে এবং সোনার মেডেল পায়। ২০০২ সালে এই রোজীনা মুস্তারীন একটি দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করে। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক শেষ বর্ষের ছাত্রী ছিল। ছেলেটি বিবিএ শেষ করে ভাইয়া গ্রুপে মার্কেটিং বিভাগে চাকরি করছে।

  • লেখক: রিফাত আরা শাহানা

নাগরিক সংবাদ–এ ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]