জেগে ওঠা প্রাচীনেরা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

হিমালয়ের গোপন একটি উপত্যকা, যেখানে বছরের প্রায় পুরো সময় বরফ জমে থাকে। বছরের অধিকাংশ সময় ঘন বরফে ঢাকা থাকে চারপাশ, সূর্যের আলো খুব কমই সেখানে সরাসরি পৌঁছায়। চারদিকে অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করে—না আছে পশুপাখির শব্দ, না আছে মানুষের পায়ের ছাপ। বাতাসের দমকা ঝড় মাঝেমধ্যে চারদিকে হাহাকার তুলে আবার থেমে যায়। প্রকৃতি নিজেই জায়গাটিকে গোপন করে রেখেছে। এই অঞ্চলের অস্তিত্ব আধুনিক মানচিত্রে নেই। স্যাটেলাইট ইমেজেও এর কোনো পরিষ্কার ছবি ধরা পড়ে না। স্থানীয় লোকজনের কাছেও এটি কেবল একটি কিংবদন্তি। বহু অভিযাত্রী পূর্বে এই পথে ঢোকার চেষ্টা করলেও প্রচণ্ড তুষারঝড় আর ভয়ংকর খাদের কারণে তারা ব্যর্থ হয়েছিল।

নেপাল-বাংলাদেশের যৌথ অভিযাত্রী দল যখন একটি গলিত হিমবাহের উৎস অনুসন্ধান করতে নেমেছিল, তখনই ভাগ্যের লিখন উল্টে যায়। তারা দেখতে পায় স্বচ্ছ বরফের ফাঁক দিয়ে নিচে অদ্ভুত কাঠামোর আভাস। প্রথমে ভেবেছিল পাথুরে গঠন। কিন্তু পানির গভীরে নামতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে সত্যিটা—বরফের স্তরের নিচে ঘুমিয়ে আছে এক বিশাল বিস্মৃত নগরী। পানির তলদেশে ছড়িয়ে আছে ভাঙাচোরা স্তম্ভ, বিশাল গম্বুজ আর অর্ধেক ডুবে থাকা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। দেয়ালে অচেনা লিপি খোদাই করা, যার অক্ষরগুলো যেন কোনো প্রাচীন সভ্যতার গোপন ভাষা। দলটির প্রধান প্রত্নতত্ত্ববিদ রুবাইয়াৎ বিস্মিত কণ্ঠে ফিসফিস করে বলেছিল, ‘এটা অসম্ভব…হাজার বছরের পুরোনো শহর যদি হয়ও, তাহলে এত উচ্চতায়, হিমবাহের নিচে কীভাবে টিকে থাকল?’ প্রশ্নের উত্তর কারও কাছে ছিল না। শহরের ধ্বংসাবশেষ যেন এক রহস্যের পর্দা টেনে রেখেছে—কবে নির্মিত হয়েছিল, কেন বিলীন হলো আর কে বা কারা এখানে বাস করত। মনে হচ্ছিল, অভিযাত্রীরা কেবল এক নগরীর ধ্বংসাবশেষ নয়, বরং ইতিহাসের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া এক অভিশপ্ত সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে।

ধ্বংসস্তূপের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে দলটি আবিষ্কার করে একটি ভগ্ন প্রাচীর, যেটি এখনো বরফের চাপ সত্ত্বেও অটল দাঁড়িয়ে আছে। আলো ফেলে তারা চমকে ওঠে—পুরো দেয়ালজুড়ে খোদাই করা আছে অদ্ভুত দৃশ্য। সেখানে দেখা যায় বহু হাত ও বহু চোখওয়ালা প্রাণীর রূপ, যাদের চেহারা আধা মানব আধা পিশাচ। প্রতিটি চোখ যেন আলাদা দিকের দিকে তাকিয়ে আছে আর ঠোঁটের কোণে মানুষের মতো ধারালো দাঁতের সারি স্পষ্ট। কারও মাথায় শিং, কারও হাতে অস্ত্রের মতো অঙ্গ, আবার কারও পুরো দেহজুড়েই চোখের সারি, যা অস্বাভাবিক আলোয় চকচক করছে। একটি ভগ্ন মন্দিরের স্তম্ভে দেখা গেল, এই ভয়ংকর সত্তাগুলো মানুষের ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে—যেন শহরের বাসিন্দারা তাদের প্রার্থনা করছে। মানুষের মুখাবয়বে খোদাই করা আতঙ্ক আর বিস্ময়ের ছাপ স্পষ্ট। কারও হাত আকাশের দিকে উঁচু, কারও হাঁটু গেড়ে কাঁদার ভঙ্গি। দলের সদস্যদের গায়ে কাঁটা দেয়। প্রত্নতত্ত্ববিদ রুবাইয়াৎ ফিসফিস করে বলে, ‘এগুলো দেবতা নয়…উপাস্য কিছু অন্য রকম। কিন্তু মানুষ কেন এমন সত্তাকে পূজা করত?’ জলের নিচে ফ্ল্যাশলাইট নাচাতে নাচাতে তারা বুঝতে পারে, প্রতিটি ছবির ভঙ্গিতে লুকিয়ে আছে কোনো রহস্যময় ইঙ্গিত। কারও হাত ঘণ্টার মতো বৃত্ত তৈরি করে রেখেছে। অভিযাত্রীদের কারও কারও মনে অদ্ভুত এক চাপা শিহরণ জাগে—মনে হয়, হাজার বছর আগের সেই বাসিন্দারা সত্যিই দেখেছিল এই সত্তাগুলোকে। আর যদি সত্যি দেখে থাকে, তাহলে প্রশ্ন জাগে—ওরা এখনো কি এখানে আছে?

ডুবুরিরা যখন শহরের ভগ্ন প্রাচীর পার হয়ে গভীরে নেমে যায়, তাদের চোখে পড়ে এক বিশাল পাথরের গঠন—ঘণ্টার মতো আকারের। পাথরটি মসৃণ, বৃত্তাকার, কোনো ফাটল বা ভাঙনের ছাপ নেই। প্রথম দিকে তারা ভেবেছিল, হয়তো এটি কোনো মন্দিরের অংশ বা ঘড়ির নিদর্শন। কিন্তু যত কাছে গিয়ে দেখা যায়, পাথরটি মসৃণ, বৃত্তাকার এবং কোনো প্রাকৃতিক ফাটল বা ছেঁড়া নেই। এর ওপরের অংশ কেবল ঘূর্ণমান বৃত্তের মতো। একজন ডুবুরি পাথরটিতে হাত বুলিয়ে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে চারপাশের পানি কেঁপে ওঠে। ছোট ঢেউগুলো আস্তে আস্তে ঘূর্ণমান হয়ে যায় আর পানির নিচ থেকে গভীর প্রতিধ্বনি আসে। ডুবুরিরা একে একে পিছিয়ে যায়। মনে হয়, পাথরের মধ্য দিয়ে কোনো শক্তি জেগে উঠছে, যা বহু বছর ধরে আটকে ছিল। পাথরের চারপাশে ছায়ার মতো কিছু অদ্ভুত আকৃতি ধীরে ধীরে ঘিরে ধরতে থাকে। তারা অস্বচ্ছ, আকার ঠিক বোঝা যায় না, কিন্তু উপস্থিতি অনুভব করা।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

রাতে, দলটির গবেষক নিশিকান্ত ঘুম ভেঙে চিৎকার করে বলে, ‘আমি দেখেছি…শহরের বাসিন্দারা এখনো আছে। বরফের স্তরের নিচে দাঁড়িয়ে, শুধু অপেক্ষা করছে। বরফ গললেই তারা ফিরে আসবে।’ প্রথমে বাকিরা এটিকে নিছক বিভ্রম বা স্বপ্ন ভেবেছিল। কিন্তু কয়েক রাতের মধ্যেই সবাই একই ধরনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। তারা দেখেছিল—বরফের তলদেশে অজানা চোখ ও অঙ্গ, বহু হাত-চোখওয়ালা সত্তা, ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। চোখ বন্ধ করলেই সেই ধোঁয়াটে, অস্বচ্ছ ভিড় তাদের কাছে এসে দাঁড়াচ্ছে। স্বপ্নগুলো একরকম তীব্রতা নিয়ে আসে—হয়তো তাদের মনে কেবল আতঙ্ক নয়, বরং এক অজানা আহ্বানও জাগে। ধীরে ধীরে সবাই বুঝতে পারে, বরফের আড়ালে লুকানো এক প্রাচীন ও বিপজ্জনক জীবন, যা ঠিক এই মুহূর্তে আবার আবির্ভূত হতে চলেছে। সবাই ফিরে আসবে লোকালয়ে। ফেরার প্রস্তুতি নেওয়ার মুহূর্তে হিমবাহ হঠাৎ গর্জন করে ফেটে যায়। বিশাল ফাটল দিয়ে বেরিয়ে আসে কালো বরফের টুকরা।

প্রথমে মনে হয়, বরফের সাদা টুকরা গাঢ় কালো হয়ে গেছে। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখা যায়, ভেতরে কিছু নড়ছে। দূর থেকে ছায়ার মতো লাগে। তবে কাছে গিয়ে তাকালে বোঝা যায়, তাদের আকার-আকৃতি মানবচোখে বোঝা অসম্ভব। তাদের মধ্যে কেউ বলে, সেখানে আছে মুখ, অসংখ্য চোখ, আর ঠোঁট, যা ধীরে ধীরে নড়ে, যেন ফিসফিস করে কিছু বলছে। বরফের ভেতর আটকে থাকা এই অদ্ভুত সত্তাগুলো যেন শহরের প্রাচীন বাসিন্দাদের প্রতিচ্ছবি, তবে কোনো মানুষের নয়। ডুবুরিরা স্থির ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ কিছু বলতে পারছে না, শুধু অনুভব করছে—বরফ ও সত্তাগুলোকে অনুভব করা যায় এবং তারা এখন মুক্ত হতে চাচ্ছে।

দলটি তড়িঘড়ি করে অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করে এবং নিরাপদ শহরে ফিরে আসে। কিন্তু তাদের ভয় শেষ হয় না। প্রতি রাতেই প্রত্যেকের ঘুম ভাঙে একই দৃশ্য দিয়ে—হিমবাহ গলছে, কালো বরফের টুকরা ভেঙে পড়ছে আর সেই হাজার চোখওয়ালা সত্তারা ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। স্বপ্নে তারা ফিসফিস করতে শুনতে পায়—‘বরফের টুকরা গলেছে…আমরা ফিরছি।’

স্বপ্নগুলো এত বাস্তব, এত দমবন্ধ করা যে প্রত্যেকের ঘুম ভেঙে যায় হাহাকার আর নিঃশ্বাসের সঙ্গে। মনে হয়, শহরটি তাদের স্বপ্নের বাইরে নয়, বাস্তবের। তারা শহরের মধ্যেই আছে।

লেখক: সৌরভ হাছান হিমেল, শিক্ষার্থী, ব্রিটানিয়া ইউনিভার্সিটি