চাকরিতে বয়স বৃদ্ধির দাবির পক্ষে আমাদের যুক্তি

চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বৃদ্ধির দাবি দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। বিষয়টি এখনো নানা জটিলতায় ঝুলে আছে। চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বৃদ্ধি করা হবে কি না, সেটি নিয়ে চাকরি প্রার্থী আমরা যেমন কথা বলছি, তেমনি সরকারি মহলেও এটি দীর্ঘদিন ধরে একটি আলোচিত বিষয়। যত দ্রুত সম্ভব এ বিষয়টির একটি সুষ্ঠু সমাধান হওয়া উচিত বলে মনে করি।

চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা এখন ৩০ বছর। ৩১ বছর আগে করা এ নিয়ম এখন পর্যন্ত বলবৎ আছে।

আমরা দীর্ঘদিন ধরে এ নিয়মটির পরিবর্তন দাবি করে আসছি। আমরা মনে করি, ১৯৯১ সালের পর থেকে দেশের অনেক উন্নয়ন হয়েছে, মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, শিক্ষাব্যবস্থার মান বৃদ্ধি পেয়েছে, শিক্ষা গ্রহণের হার বেড়েছে। যেহেতু সবকিছুর পরিবর্তন ঘটেছে, সেহেতু সেই অনুপাতে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বৃদ্ধির দাবি কোনোভাবেই অযৌক্তিক নয়। বর্তমান সময়ে একজন শিক্ষার্থীর স্বাভাবিকভাবে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করতে প্রায় ২৫-২৬ বছর লেগে যায়। কারও কারও অবশ্য ২৪-২৫ বছরেও শেষ হয়, তবে তাঁদের সংখ্যাটা খুবই কম। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো একাডেমিক লেখাপড়া আর চাকরির লেখাপড়ার মধ্যে তেমন একটা মিল নেই। এতে আমাদের একাডেমিক লেখাপড়া শেষে আবার চাকরির জন্য নতুন করে লেখাপড়া শুরু করতে হয়। ২৫ বছর বয়সে একাডেমিক লেখাপড়া শেষে পুনরায় চাকরির লেখাপড়া শুরু করে মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে বর্তমান চাকরির প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ভালো করা খুবই কঠিন। চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বৃদ্ধি না হওয়ায় দেশ অনেক মেধাবী তরুণদের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলেও আমরা মনে করি। আমাদের দেশের অনেক ছেলেমেয়ে দেশের মানুষের টাকায় লেখাপড়া শিখে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যান। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো তাঁদের অধিকাংশই আর দেশে ফিরে আসেন না। আর দেশে এসেই–বা তাঁরা কী করবেন? কেননা, উচ্চশিক্ষা শেষে যখন তাঁরা দেশে ফেরার প্রস্তুতি নেন, তখন হিসাব কষে দেখেন তাঁরা দেশের চাকরির বাজারে অযোগ্য। স্নাতক, স্নাতকোত্তর শেষ করে বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ শেষ করতে করতে একজন শিক্ষার্থীর বয়স প্রায় ৩০ বছর হয়ে যায়, ক্ষেত্র বিশেষে কারও কারও বয়স ৩০ বছরের বেশি লাগে। আমাদের দেশের নিয়মের বেড়াজালে তাঁরা স্বভাবতই আর চাকরিতে আবেদনের যোগ্যতা রাখেন না। তখন তাঁরা নিজের ক্যারিয়ারের স্বার্থে বিদেশে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এতে আমাদের দেশ তারই সৃষ্টি করা তরুণ মেধাবীদের সেবা হতে বঞ্চিত হন। ফলে দেশের উন্নয়ন চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তা আর বলার অবকাশ রাখে না।

সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে আমরা প্রতিনিয়তই যোগাযোগ রাখছি। কিন্তু এখনো কোনো আশার বাণী শুনিনি। যতটুকু জানতে পেরেছি, সরকারের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুসারে আপাতত চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বৃদ্ধির কোনো পরিকল্পনা নেই। আমরা সরকারের এই সিদ্ধান্ত স্বভাবতই মেনে নিতে পারিনি। ফলে আমাদের আন্দোলন এখনো চলমান। আমরা আদৌ জানি না, আমাদেরকে আর কতকাল এভাবে আন্দোলন করতে হবে।

চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বৃদ্ধির দাবি আমাদের অতিমাত্রায় আবেগনির্ভর নাকি বাস্তবতাও আছে, তা নিয়ে দীর্ঘদিন আত্মসমালোচনা করেছি। দাবিকৃত বিষয়গুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা করেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এ–সংক্রান্ত তথ্য–উপাত্ত ও প্রয়োজনীয়তার চুল ছেঁড়া ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে আমার কাছে মনে হয়েছে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বৃদ্ধি এখন সময়ের দাবি। বর্তমানে চাকরিতে আবেদনের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩০ বছর। বর্তমানের নিয়মটি চালু করা হয়েছিল আজ থেকে তিন দশক আগে ১৯৯১ সালে। ১৯৯১ সালে মানুষের জীবনযাত্রার মান বর্তমানের মতো এত উন্নত ছিল না। মানুষ বেঁচেও থাকত কম সময়। সে সময় মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫৭-৫৮ বছরের মতো। ২০২৩ সালে এসে মানুষের গড় আয়ু ৭৩ বছর। ১৯৯১ থেকে ২০২৩ এই দীর্ঘ ৩২ বছরে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে ১৬ বছর। গড় আয়ু বাড়লেও চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বৃদ্ধি হয়নি একটুও। এটা যুক্তিসঙ্গত নয়।

২০২০ ও ২১ সালে করোনা মহামারির কারণে প্রায় দুই বছর চাকরিতে নিয়োগ পরীক্ষা বন্ধ ছিল। করোনা মহামারির পর নিয়োগ পরীক্ষা শুরু হলে একই দিন একই সময় একাধিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ায় আমরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। সরকার আমাদের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে অস্থায়ী ভিত্তিতে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৯ মাস বৃদ্ধি করেছে। তবে এটি ক্ষতিগ্রস্ত সব শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পারেনি, উল্টো বৈষম্য তৈরি করেছে বলে মনে করি। কেননা, করোনা মহামারিতে কমবেশি সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সুবিধা পেয়েছে একটি বিশেষ শ্রেণি। ২০২০ সালে যেসব শিক্ষার্থীর বয়স ত্রিশের কোঠায় ছিল, করোনা মহামারি তাঁদের কাছে যেন আশীর্বাদ হিসেবে এসেছিল। কেননা, করোনার কারণে তাঁরা এখনো চাকরিতে আবেদনের সুযোগ পাচ্ছেন। অপর দিকে ওই সময় আমাদের যাঁদের বয়স ২৬ বছর ৯ মাস ছিল, করোনা আমাদের জন্য শুধু অভিশাপ নয়, চরম অভিশাপ হিসেবে দেখা দিয়েছে। করোনার কারণে আমাদের মহা মূল্যবান সময় নষ্ট হয়েছে একটা টার্নিং মুহূর্তে। সেই হিসেবে করোনা মহামারি শেষে আমাদেরই বেশি সুযোগ–সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটি না হয়ে হয়েছে হিতে বিপরীত। ফলে দেখা যাচ্ছে, চাকরিতে যাঁদের আর আবেদনের কোনো সুযোগই ছিল না, তাঁরাই পাচ্ছেন বাড়তি ৩৯ মাস। আর যাঁদের বাড়তি সুযোগ পাওয়া ছিল একরকম অধিকার, তাঁরা পাচ্ছেন না বাড়তি একটি দিনও। গভীরভাবে চিন্তা করলে বুঝা যায় বিষয়টি শুধু বৈষম্যই তৈরি করেনি, চরমভাবে বঞ্চিতও করছে আমাদেরকে। এটা রাষ্ট্রের কাছ থেকে কাম্য নয়। কেননা, সব নাগরিকদের সমানাধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য। করোনায় যে শুধু আমরা চাকরি প্রার্থী শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি তা নয়, বর্তমানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরাও সমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা যখন চাকরির বাজারে প্রবেশ করবে, তাদেরকেও এই ক্ষতি বয়ে বেড়াতে হবে। অস্থায়ীর পরিবর্তে যদি স্থায়ীভাবে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বৃদ্ধি করা হতো, তাহলে কেউই ক্ষতিগ্রস্ত হতো না বরং সবাই সমভাবে উপকৃত হতাম বলে মনে করি।

তরুণেরা দেশের অমূল্য সম্পদ। দেশের স্বার্থে কাজ করতে তাঁরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। উন্নত বিশ্বের প্রতিটি দেশ তরুণ জনশক্তিকে কাজে লাগায়। তরুণদের সেবা হতে দেশ যাতে কোনোভাবে বঞ্চিত না হয় সে ব্যাপারে দেশগুলো বেশ সোচ্চার। ফলে ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বিশ্বের ১৬২টি দেশ তরুণদের কাছ থেকে সেবা নিশ্চিতকল্পে ৩৫ বছরের যুবকদের চাকরিতে আবেদনের সুযোগ রেখেছেন। কোনো কোনো দেশ চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা সীমাবদ্ধ না রেখে উন্মুক্ত রেখেছে। উদ্দেশ্য একটাই, যেকোনো বয়সের জনশক্তি দেশকে সেবা দিতে আগ্রহী হলে, কোনো নিয়মের বেড়াজালে যেন তার অদম্য ইচ্ছা আটকে না যায় তা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা সম্প্রতি ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন এবং সেই লক্ষ্যে কাজও শুরু করেছেন। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে তরুণ জনশক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। তরুণ জনশক্তিকে বাদ দিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়। তরুণদের কেউ যাতে নিজের যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হন, তা নিশ্চিত করতে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বৃদ্ধি করা দরকার। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বয়স নয়, তরুণদের মেধা, বিচক্ষণতা ও যোগ্যতাকে মূল্যায়ন করা উচিত বলে মনে করি।

লেখক : সাবেক শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।