জীবনের প্রথম রাজহাঁস কেনা

ফাইল ছবি

১.

বাড়িতে গেলে আমি ও আমার বন্ধু খোদা বখশ প্রায়ই শনিবার চাঁচকৈড় হাটে যাই। এই হাটের বয়স ১০০ বছর ছুঁই ছুঁই হবে। ঘটনাচক্রে এই হাট চলনবিলের অন্যতম বড় হাটে পরিণত হয়েছে। আমি চাঁচকৈড় হাট থেকে মুরগি, কবুতর ও মাছ কিনে এনে তা ফ্রিজিং করে ঢাকা নিয়ে আসি। প্রসঙ্গত, মাছ চলনবিলের নদী-খাল-ডোবার আর মুরগি ও কবুতর গ্রামের মানুষের বাড়িতে পালন করা। এই মুরগি–কবুতরের মাংস আর মাছ স্বাদে ও গুণগত মানে অনন্য। এ হাটে মুরগির পাশাপাশি দেশি হাঁস, চীনা হাঁস, রাজহাঁসও পাওয়া যায়। আমার বাড়ি নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলায়। হাট থেকে আমার বাড়ির দূরত্ব দূরত্ব কিলোমিটার হবে।

২.

হাঁটে গিয়ে একবার মনে হলো হাঁস কেনা যেতে পারে। যে কথা সেই কাজ! আমার হাঁস কেনা ও হাঁসের মাংস খাওয়ার তেমন অভিজ্ঞতা না থাকায় খোদা বখশের পরামর্শ নিলাম। সে আমাকে দেশি হাঁস কিনে দিল। আমার হাঁসের মাংস খাওয়ার পর ভালো লাগায় পরেরবার বাড়ি এসে অন্য ধরনের হাঁস কেনার ইচ্ছা প্রকাশ করতেই বন্ধু আমাকে চীনা হাঁস কিনতে উৎসাহ দিল। আমরা সেই হাটে দুটি চীন হাঁস ১ হাজার ৩০০ টাকায় কিনলাম। হাঁসের প্রতি আমার দুর্বলতা বেড়েই চলল। ইদানীং চলনবিলে হাঁসের বাণিজ্যিক প্রতিপালন বেড়েছে। বছরের নির্দিষ্ট সময় বিল অঞ্চলে পানি থাকায় হাঁস প্রাকৃতিকভাবে প্রতিপালন করতে সুবিধে হয়। এখন বাজারজাত করাও সহজ। তাই দিন দিন চলনবিলের হাঁসের চাহিদা বাড়ছে।

৩.

এর কিছুদিন পরে আবার বাড়ি গেলাম। তখন বাড়িতে আমার আম্মা ছিলেন না। তিনি অবশ্য হাঁস কেনা ও মাংস খাওয়া পছন্দ করেন না, যে কারণে আমাদের বাড়িতে হাঁসের মাংস খাবার তেমন রেওয়াজ ছিল না। যাহোক, আমি আমার বন্ধু খোদা বখশকে নিয়ে হাটে গিয়ে তাকে জানালাম যে দুই ধরনের হাঁস কিনলাম; রাজহাঁস তো কেনা হলো না! সে বলল, চলো আজ কিনে ফেলি। আসলে রাজহাঁসের গলা কেমন লম্বা হওয়ায় আমার কাছে কেমন জানি লাগত। সে যা–ই হোক না কেন, রাজহাঁসের দাম করতেই চক্ষু চড়কগাছ! একটা ভালো রাজহাঁসের দাম ন্যূনতম এক থেকে দেড় হাজার টাকা! দুটি নয়, একটি রাজহাঁস কিনে অন্য হাঁসের মতো প্রসেস করে বাড়ি নিয়ে এলাম। এ আমার জীবনে প্রথমবারের মতো রাজহাঁস কেনা। বলে রাখা ভালো, সাধারণত মুরগি বা হাঁস কেনার পর হাটে কালু ভাইয়ের কাছে নিয়ে যাই। কালু ভাই জবাই করে প্রসেসিং করে আমাদের দিয়ে দেন। তিনি একটা মুরগি প্রসেসিং করতে ১০ টাকা এবং হাঁস প্রসেসিং করতে ২০ টাকা নেন। তবে কেউ যদি মুরগি জবাই করার পরে মাংস টুকরা করে নিতে চান, কালু ভাই সেভাবেই মাংস টুকরা করে দেন; তবে সে ক্ষেত্রে তিনি বেশি টাকা নিয়ে থাকেন। আমরা বাসায় আনার পরে বুয়া মাংস পিস পিস করে তারপর রান্না করেন।

৪.

এখন বাতাসে আছে হিমের পরশ। এই না শীত না গরমের উপভোগ্য সময় হাঁস জমে যায় সঠিকভাবে রান্না করতে পারলে। সহজ অথচ সুস্বাদের তেমনই হংসব্যঞ্জনের রন্ধনপ্রণালি ভোজনরসিকদের জিবে জল এনে দেবে। হাঁসের মাংস ভারতীয় খাবারের অংশ, উত্তর-পূর্ব ভারতে এর গুরুত্ব রয়েছে। হাঁসের মাংস কলা দিয়েও রান্না করা যায়। নারকেলের দুধ দিয়ে রান্না হাঁসের মাংস অনেক কিছুর স্বাদ ভুলিয়ে দেবে। আর হাঁসের মাংস ভুনা রেসিপি অথবা হাঁসের মাংসের কালাভুনা! এসব রান্নার কোনো জবাব হয় কি? বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের মানুষ বিভিন্ন উপায়ে রান্না করা হাঁসের মাংস খেতে বেশ পছন্দ করে। বাংলাদেশে শীতকালে হাঁসের মাংস অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি খাওয়ার প্রচলন রয়েছে।  

৫.

যাহোক, কালু ভাইয়ের প্রসেস করা রাজহাঁস ঢাকায় নিয়ে এলাম। বাসায় এনে আমার স্ত্রীকে বলি দু-এক দিনের মধ্যেই রাজহাঁসের মাংস রান্না করো। সে ‘হ্যাঁ’সূচক জবাব দেয়। আমার স্ত্রীর রাজহাঁসের মাংস ও রান্না সম্পর্কে তেমন ধারণা ছিল না। হয়তো তাদের বাড়িতেও রাজহাঁসের মাংস খুব একটা রান্না হয়নি।

৬.

যখন অফিস থেকে বাসায় ঢুকছি, তখন রাত প্রায় আটটা বেজে গেছে। আমার স্ত্রী জানাল, বঁটি ভেঙে গেছে! আমি অবাক হতেই সে বলল, রাজহাঁসের মাংস কাটতে গিয়েই এ ঘটনা ঘটেছে! আমি দেখলাম বঁটির এক পা নেই, ভাঙা! আর মুখ না পোড়ালে বেশি দিন কাজ করতে কষ্ট হবে। বঁটি বাঁকা হয়ে গেছে! আমি বিরক্ত হয়ে বঁটির পা আর বঁটি নিয়ে ওয়েল্ডিং মেশিনের দোকানের সন্ধানে বের হই। কারণ, বাসায় বঁটি একখানা আর পা ছাড়া বঁটি দাঁড়াবে কীভাবে? বঁটি এখন না সারেলে কাল রান্না বন্ধ!

৭.

তখন ওয়েল্ডিং মেশিনের দোকান বন্ধ হচ্ছিল। আমি যাওয়ায় আর কাজটি জরুরি মনে করে দোকানদার আবার মেশিন চালু করে বঁটির পা বঁটির সঙ্গে লাগিয়ে দিলেন। কিন্তু তিনি বঁটি সোজা করতে পারলেন না। যাহোক, আপাতত কাটাকাটি করা যাবে। ভাবলাম, পরে সময় করে বঁটি পুড়িয়ে নিতে হবে।

৮.

বঁটি পোড়ানো হয়েছে, বিকল্প হিসেবে বাসায় রাখার জন্য আরও একটা বঁটি বানানোও হয়েছে। তবে কাটতে না পারা রাজহাঁসের সেই মাংস আজও আমার ডিপ ফ্রিজে সংরক্ষিত রয়েছে। সময় করে বাজার থেকে মাংস কেটে নিয়ে আসতে হবে। ভবিষ্যতে রাজহাঁসের মাংস কিনলে পিস পিস করে না কেটে আর বাড়ি নিয়ে আসব না। এ আমার জীবনে চরম শিক্ষা! জীবনে প্রথমবারের মতো রাজহাঁস কেনার গল্প আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়েই থাকবে।

লেখা: ফাত্তাহ তানভীর রানা, গল্পকার ও কবি