গণপরিবহনে নারী হেনস্তার শেষ কোথায়?

নারী নির্যাতনপ্রতীকী ছবি

কয়েক মাস আগে ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে ময়মনসিংহ টু নান্দাইলগামী বিআরটিসি বাসে উঠেছিলাম। কিন্তু স্বপ্নকে বাড়িতে নিতে যতটা প্রফুল্ল মন নিয়ে বাসে উঠেছিলাম, বাসে ওঠার পর সেই প্রফুল্লটা এক নিমেষেই শেষ হয়ে গেল। বিআরটিসির নারীদের সিটে বসে আছেন পুরুষ, আর প্রায় ১০ থেকে ১৫ জন নারী দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। অথচ বাসের সামনের সিটের ওপরের দিকে সুন্দর হাতে লেখা ‘মহিলা ও প্রতিবন্ধীদের আসন ১৫টি’। মহিলা আসনে পুরুষদের বসা নিয়ে কেউ কোনো প্রতিবাদ করছেন না, এমনকি বাসচালক ও বাসচালকের সহকারীও না।

১ অক্টোবর ২০২৫ পূজার ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকা টু ময়মনসিংহের মুক্তাগাছাগামী ‘ইসলাম’ নামের একটি বাসে উঠলাম। বাসে ওঠার পর ভাড়া দেওয়ার সময় আমার পাশের যাত্রী মহাখালী থেকে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা যাওয়ার ভাড়া দিয়েছেন ১৮০ টাকা। আর আমি ঢাকার উত্তরার হাউস বিল্ডিং থেকে বাসে উঠেছি, নেমেছি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলায়। যা মুক্তাগাছা উপজেলার আরও ৩৭ দশমিক ৬ কিলোমিটার আগে। অথচ আমার থেকে জোর করে ২০০ টাকা ভাড়া নিয়েছে। এ অবস্থায় নারী হয়ে বাসচালকের সহকারীকে কিছু বলতে গেলে সে আরও উল্টাপাল্টা অনেক কিছু বুঝিয়ে দেয়।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

যানবাহনে নারী হেনস্তার ইতিহাস শুধু ওপরের দুটি ঘটনাতেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং যৌন হয়রানি, গণধর্ষণ, ছিনতাই প্রভৃতিতেও ছড়িয়ে পড়েছে। বাসে ওঠার সময় চালকের সহকারী কর্তৃক নারীর গায়ে হাত দেওয়া, ভাড়া নেওয়ার নামে নারীর হাতে হাত লাগানো, পুরুষ যাত্রীদের লোভাতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ, বাসের ইঞ্জিনের ওপর নারীদের আসন স্থাপন প্রভৃতি এখন সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যানবাহনে এ ধরনের নারী হেনস্থার ঘটনা আজ নতুন নয়, এর আগে এসব ঘটনার কথা বহুবার পত্রিকায় উঠে এসেছে। বহুবার এর প্রতিরোধের পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আমরা নারীরা যানবাহনে এখনো অনিরাপদ। সর্বশেষ সরকার পরিচালিত জনগণনা অনুসারে, নারী মোট জনসংখ্যার ৫১ শতাংশ। অর্থাৎ, ভোটের হিসাবে নারীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তারা চাইলে নিজেরাই সরকার গঠন করতে পারবে। অথচ দেশের এই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর একটা অংশ যখন প্রতিনিয়ত হেনস্তার শিকার হচ্ছে, তখন এ দেশের নিরাপত্তার ওপর আমাদের আস্থা কী?

বর্তমানে নারীরা বহির্মুখী। তাদের প্রতিদিনই রুজির প্রয়োজনে কিংবা শিক্ষাগ্রহণের প্রয়োজনে বাইরে বের হতে হয়। সরকার যেখানে শিক্ষাক্ষেত্রে ও কর্মক্ষেত্রে নারীদের অগ্রগতির সম্ভাবনা রাখছে, সেখানে গণপরিবহনে নারীরা অগ্রগতিতে এক ধাপ পিছিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে গণপরিবহন হয়ে উঠেছে নারী অগ্রগতির অন্তরায়।

কিন্তু এসবের শেষ কোথায়? যানবাহনে নারী হেনস্তার ঘটনা আর কত তুলে ধরলে এ সমস্যার সমাধান ঘটবে? একটি দেশ সভ্য কি না, তা নির্ধারিত হয় সে দেশের নারীরা কতটা নিরাপদ, সেটা দেখে। এই হিসেবে আমাদের দেশ কি আদৌ সভ্যের তালিকায় পড়েছে? জরিপ অনুযায়ী দেশের গণপরিবহনে নারীদের ৯৪ শতাংশ মৌখিক বা শারীরিক নিপীড়নের শিকার হয়। নিপীড়িতদের অধিকাংশই কোনো প্রতিবাদ করে না পুনরায় হয়রানি কিংবা মানসম্মানের ভয়ে। নারীদের এ নীরব কান্নার অবসান ঘটাতে দ্রুতই কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। পাশাপাশি নারীর প্রতি সংবেদনশীল হওয়া উচিত। বিআরটিসি বাসে নারীদের আসনে নারীদের স্থান হোক। প্রতিটি যানবাহনের ভাড়া আগে থেকে নির্ধারিত করে তালিকা আকারে যানবাহনে টানিয়ে রাখতে হবে, যেন ভাড়া নিয়ে কাউকে তর্কে জড়াতে না হয়। বাংলাদেশের প্রতিটি সড়কে এমন লোকাল বাস চালু হোক, যেখানে নারীদের নির্ধারিত আসন ইঞ্জিনের ওপর না দিয়ে বাসের মাঝামাঝি অবস্থানে থাকবে। কেননা নারীরা এমনিতেই সারা দিন চুলার গরম আঁচের কাছে থাকে। তার ওপর বাসে ইঞ্জিনের গরম তাপ যেন নারীদের জীবনকে করে তুলে বিষাদময়। এ ছাড়া নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে তৈরি আইনের যথাযথ প্রয়োগ, সমাজে সচেতনতামূলক বার্তা এবং নারীর প্রতি সবার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন জরুরি। রাস্তাঘাট, লঞ্চ, বাসে নারী হয়ে ওঠুক নিরাপত্তার শীর্ষে—এই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: মাইফুল জামান ঝুমু, ফরাসি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়