দুয়ারে দাঁড়িয়ে থেকো না আর

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

পড়ার টেবিলে ঝিম মেরে বসে আছে সাবিত রহমান।। তাকিয়ে আছে জানালার ওপাশে। জানালার গ্রিল বেয়ে একটা ফুলগাছের লতা এসেছে। দুই দিন আগে ফুল ছিল না। গতকাল ছোট একটা কলি নজরে এসেছিল তার। প্রথমে ভেবেছিল পাতা হয়তো। না, আজ দেখছে দুটি ফুল ফুটে উঠেছে। ঘুম ভেঙে তাকিয়ে দেখে চেয়ে আছে তার দিকে। কী নিষ্পাপ তাদের মুখখানা। চোখেমুখে হাসি। মনে হচ্ছে, পৃথিবীতে আসতে পেরে তারা ধন্য।

পূর্ব দিকের সূর্যটা ধীরে ধীরে ওপরে উঠছে। তার নরম আলো গায়ে মেখে পৃথিবী আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে। আজ সূর্য তাকে টানছে না একটুও। ফুল তাকে টানছে, মুগ্ধ করছে ভীষণ। ফুলের গায়ে রোদ পড়তেই ফুল দুটি হেসে দিল। সাবিত রহমানের খুব জানতে ইচ্ছা করছে এ ফুল দুটির নাম। কিন্তু কাকে জিজ্ঞেস করব? নাফিসাকে? উঁহু, সে তো বাসায় নেই। পাহাড়সমান অভিমান নিয়ে চলে গেছে। ফিরবে অভিমান ভেঙে গেলেই। কিন্তু কবে ভাঙবে, কে জানে।

বাইরে ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছে। মৃদুমন্দ বাতাস গায়ে লাগছে। গা–টা বেশ ঠান্ডা হয়ে গেছে। কিন্তু কপালে ঘাম জমে গেছে। পাণ্ডুলিপি ও কলম নিয়ে বসলেই লেখা আসে না। লিখতে পারে না সে। টেনশন হয়। টেনশনের কারণে প্রচুর ঘামে। তার টেনশন হলে নাক-মুখ ঘামতে শুরু করে। এটা কি কোনো রোগ? এই যে তার সামনে পাণ্ডুলিপি আর কলম শুয়ে আছে। জানালার ফাঁক গলে বাতাস আসছে। সেই বাতাসে পাণ্ডুলিপির পাতা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কলম খিলখিল করে হেসে উঠছে। তারা কি তার সঙ্গে বিদ্রূপের হাসি হাসছে? ঠিক বুঝে উঠতেও পারছে না সে।

মাথায় হাজারো গল্পের প্লট থাকা সত্ত্বেও লিখতে না পারার কী যে এক যন্ত্রণা, এটা লেখক ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না। পৃথিবীর মানুষের মরে যেতে ইচ্ছা করে যখন তাদের ঘরে অভাব–অনটন, দুঃখ–কষ্ট লেগে থাকে। আর লেখকের শুধু লিখতে না পারার কারণে মরে যেতে ইচ্ছা করে। পৃথিবীতে দম বন্ধ হয়ে আসে। অসহ্য লাগে প্রিয়তমার আলিঙ্গন।

গত পরশু রাতে সাবিত রহমানের স্ত্রী বাপের বাড়ি চলে গেছে। চলে যাবে নাই–বা কেন? দিনরাত এভাবে পাণ্ডুলিপি নিয়ে বসে থাকলে কি দিন কাটবে? কিছু একটা তো করতে হবে? সেই কিছু একটা কী? সে পাল্টা প্রশ্ন করতেই নাফিসা রেগে গেল। তারপর দু-একটা কথা, একটু মান-অভিমান, তারপর প্রস্থান।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

প্রথমে ভেবেছিল যাক, দু-একটা দিন অন্তত শান্তিতে থাকতে পারবে। পাণ্ডুলিপির বাকি কাজটাও শেষ করতে পারবে। কিন্তু সে চলে যাওয়ার পর থেকে তার আর কাজটাজ, খাওয়াদাওয়া, ঘুম—কিচ্ছু হচ্ছে না। সারা রাত কলম কামড়ে বসে থাকে। দেয়ালঘড়ির দিকে তাকায়। ঘড়ির কাঁটা একটা পাঁচের ঘরে আটকে আছে। সে–ও আঁটকে থাকে ঘড়ির কাঁটায়। ঘড়ি নষ্ট না ব্যাটারি নষ্ট, কে জানে। হাতঘড়িটা কোথায় আছে, জানে না। নাফিসা ঘরে না থাকলে সবকিছু ওলট–পালট হয়ে যায়। যার যেখানে থাকা উচিত, সে সেখানে থাকে না। খুঁজতে গেলে আলাদা পেরেশানি পোহাতে হয়। এখন সিগারেট ফুঁকতে ইচ্ছা করছে তার। রান্নাঘরে দেশলাইয়ের বাক্স থাকার কথা, সে গেলেই ওটা আজ পাবে না। ঘড়ির সময়টা দেখা দরকার। খিদেয় পেটটা ভেতরে ঢুকে গেছে। পুরো ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজল সে। কোথাও পেল না। ঘড়ির দরকার নেই। আদিম যুগের মানুষের মতো অনুমান করে সময় বের করতে বারান্দায় এল।

সূর্যের দিকে তাকাল। সূর্যের লাল বর্ণটা এখন আর নেই। সম্ভবত সকাল নয়টা বাজে। কমও হতে পারে। আজকের দিনটাও কেমন যেন মরা মরা লাগছে। দিনের সঙ্গে মানুষের মনেরও গভীর একটা সম্পর্ক আছে হয়তো। নাফিসা দুই দিন পর আপনা–আপনি ফিরে আসবে অভিমান ভেঙে। সাবিত তাকে ছাড়া থাকতে পারলেও সে সাবিতকে ছাড়া থাকতে পারবে না। কথাটা ভুল, সাবিতও তাকে ছাড়া একমুহূর্ত থাকতে পারবে না। কিন্তু সে তাকে তা বুঝতে দেয় না। তার কথা হলো, ভালোবাসা লুকিয়ে রাখাই ভালো।

সূর্য পশ্চিমাকাশে তলিয়ে গেছে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মেঘেরা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে। কালো মেঘে ছেয়ে গেছে লাল আসমান। সাবিত রহমানের বুকের মধ্যে দুপুর দুপুর লাগছে, ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। এর আগে এ রকম ব্যথা কখনো হয়নি।

রাত ১২টা ২২, সে জেগে আছে। বাসাটা চুপচাপ হয়ে আছে। ভূতের বাড়ি মনে হচ্ছে। তার কড়া লিকারের চা খেতে ভীষণ ইচ্ছা করছে। চুলায় কেটলি চেপে দিয়ে রিডিং টেবিলে এল। গল্পের প্লট মাথায় কিলবিল কিলবিল করছে। সাবিত রহমান এখন লিখতে পারছে। পুরো পাণ্ডুলিপির কাজ রেডি করে ফেলেছে, কিন্তু লেখাতে তৃপ্তি পাচ্ছি না। নাফিসা পাশে থাকলেই তার ভালো লাগত। নিজেকে এখন একা একা লাগছে। এবার হয়তো নাফিসার মনে প্রচুর অভিমানের মেঘ জমেছে। তাকে যেতেই হবে অভিমান ভাঙাতে। পৃথিবীর সবকিছু তুচ্ছ করে হলেও।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সাবিত রহমান গায়ে পাতলা একটা চাদর জড়িয়ে বের হলো। বাসার গলি ছেড়ে বড় রাস্তায় উঠল। হাঁটছে। এত দূরের পথ এভাবে হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া এই রাতদুপুরে রিকশা পাওয়ারও কথা নয়। দূর থেকে রিকশার টুংটাং শব্দ কানে এল। একটু আশার আলো দেখতে পেল। গাঢ় অন্ধকার পথের পথিক যদি এক টুকরা আলো পায়, তখন কী যে খুশি হয়। সেই পথিকের চেয়েও সে একটু বেশিই খুশি হলো। যাক, এত দূর পথে দু-একটা খুচরো আলাপ জমিয়ে যেতে পারবে।

রাস্তায় নেড়ি কুকুরগুলো কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। সাবিত রহমানকে একা হাঁটতে দেখে শুয়ে শুয়ে অলস ভঙ্গিতে ঘেউ ঘেউ করছে কুকুরগুলো। একটা কুকুর দাঁড়াল। কী মনে করে যেন আবার বসে পড়ল।

এই রিকশা, এই। যাবেন?
কই যাইবেন, কইয়া ফেলান।
কাজীবাড়ি, পুকুরপাড়।
ও, ওই দিকেই ত যাইতাছি। উইঠ্যে বহেন।
আকাশে মেঘ জমেছে। বিজলি চমকাচ্ছে। সে রিকশায় উঠে বসল। কুকুরগুলো গা ঝাড়া দিয়ে রাস্তার ওপাশে বন্ধ টংয়ের দোকানের বেঞ্চের তলায় চলে গেল। ওরাও হয়তো বৃষ্টি আসার আভাস পেয়ে গেছে।

রিকশা চলছে। দ্রুতগতিতে। গলাটা চুলকাচ্ছে, গলায় প্রচণ্ড ব্যথা করছে তার। শীত শীত লাগছে। জ্বরটর এসেছে হয়তো। কপালে হাত বুলিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবে, কপাল গরম কি না। চাদরের ভেতর থেকে হাত বের করতে ইচ্ছা করছে না। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। সাবিত রহমানের শরীর অনিয়ম সহ্য করতে পারে না। গত দুই দিন ঘুমাতে পারেনি সে। প্রচুর ঘুম ধরেছে। সে দুই চোখ বুজে আছে। যেন পাখির মতো আকাশে ডানা মেলে উড়ছে।

কাজীবাড়ি পুকুরপাড়ে এসে রিকশা থামল। রিকশাওয়ালা তাকে বারবার নামতে বলছে। সে শুনতে পাচ্ছে, কিন্তু নামতে পারছে না। তাকাতে পারছে না। কথা বলতে পারছে না। সে কি আর কোনো দিন তাকাতে পারবে না? নাফিসাকে একনজর দেখতেও পারবে না?
জ্ঞান ফিরল রাত দুইটাই। নিজেকে আবিষ্কার করল হাসপাতালের বেডে। গায়ে সাদা অ্যাপ্রোন, গলায় স্টেথো ঝোলানো একজন ডাক্তার এলেন। ডাক্তারকে সে চেনে। খুব কাছের মানুষ, কিন্তু ডাক্তারের নামটা তার মনে পড়ছে না। সে অনেকক্ষণ মনে করার চেষ্টা করল, তবু মনে করতে পারল না।

ডাক্তার হাতে চাপ দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কী যেন পরীক্ষা–নিরীক্ষা করলেন। তারপর হাসি হাসি মুখ করে বললেন, বিপদ অনেকটাই কেটে গেছে। সে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে একটু হাসি দেওয়ার চেষ্টা করল। হাসিটা বিস্তৃত হলো না। ডাক্তার চলে গেলেন। ডাক্তার চলে যাওয়ার পরপরই নাফিসা দুয়ার ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। হাতে নতুন একটা বই। বইয়ের গায়ে লেখা, ‘দুয়ারে দাঁড়িয়ে থেকো না আর’। তার নতুন আরও একটা বই প্রকাশিত হলো, অথচ সে কিছুই জানল না। হঠাৎ তার মনে প্রশ্ন জেগে উঠল, ‘এখানে কত দিন ধরে আছি? দুই দিন, তিন দিন।’ নাহ্‌, সে আর ভাবতে পারল না। সে নাফিসার দিকে চেয়ে থাকল। তার চোখে জল, ঠোঁটে হাসি। সূর্যকন্যা হাসছে, সেই আনন্দে আজ পৃথিবীও হাসছে। সাবিত রহমানের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে, ‘দুয়ারে দাঁড়িয়ে থেকো না আর!’

কিন্তু সে বলতে পারছে না। বলার চেষ্টা করছে, মুখ দিয়ে একটা শব্দও বেরোচ্ছে না। একটু আগে ডাক্তার রেজা চৌধুরী তাকে শব্দ করে কথা বলতে নিষেধ করে গেছেন।