তুনি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

একটা গল্প শুনবেন, ভয়ংকর খুনের গল্প!

খুনের কথা শুনে আঁতকে ওঠে তুনি। পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখে মাঝবয়সী একটা লোক। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, সুঠাম দেহ, কাঁচা-পাকা চুল, পরিপাটি পোশাক।
আপনি কী আমাকে কিছু বলছেন?

হ্যাঁ, আপনাকে বলছি, লোকটা সাবলীলভাবে উত্তর দেয়। তুনি চারপাশ তাকিয়ে দেখে খুব কাছাকাছি কেউ নেই। সে খানিকটা বিচলিত হয়।

রেলস্টেশনের এই বেঞ্চগুলোতে  তিনজনের বেশি বসা যায় না। তুনি বেঞ্চের এক পাশে বসে মাঝখানে তার ব্যাগ রেখেছে। লোকটা পরিচিত মানুষের মতো বেঞ্চের অন্য পাশে বসে বলা শুরু করে, অনেকক্ষণ ধরে দেখছি আপনি বই পড়ছেন। সম্ভবত গল্পের বই। তাই আপনাকে গল্প শোনাতে এলাম। আপনাকে কষ্ট করে পড়তে হবে না, আমি বলব আপনি শুনবেন। যদি ভালো না লাগে তবে আমি চলে যাব।

আগবাড়িয়ে কথা বলা লোকজনদের একেবারেই অপছন্দ তুনির। তা ছাড়া এ ধরনের লোক অনেকটা ভণ্ড টাইপের হয়। তারা কথার মায়াবী জালে মানুষকে আবদ্ধ করে ফেলে। যদিও কথার জালে আবদ্ধ হওয়ার মতো মেয়ে তুনি নয়। কিন্তু খুনের কথা শোনার পর ভেতরে–ভেতরে একটা ভয় কাজ করছে। লোকটা সিরিয়াল কিলার নাকি! নাকি সত্যি সত্যি কোনো খুন করে এসেছে।

তুনি বুঝতে পারে লোকটা তাকে বেশ সময় নিয়ে খেয়াল করছে।

সুন্দরবন এক্সপ্রেসে টিকিট কেটে বিমানবন্দর রেলস্টেশনে অপেক্ষা করছে সে। গন্তব্য খুলনা। এটা সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র বিমানবন্দর, যেখান থেকে বিমানের পরিবর্তে ট্রেন ছাড়ে। ট্রেনের টিকিটের গায়ে স্টেশনের নাম দেখলে হাসি পায় তুনির।

ট্রেন দুই ঘণ্টা লেট। সোয়া আটটা সিডিউল টাইম কিন্তু আজ সুন্দরবন এক্সপ্রেস দুই ঘণ্টা পরে আসবে। হুট করে এ রকম সিডিউল বিপর্যয়ে সে ভীষণ রকম বিরক্ত। ফেসবুকে স্ক্রোল করতেও ভালো লাগছে না। অপেক্ষাকৃত দূরের একটা বেঞ্চে হেলান দিয়ে বসে চার্লস ডিকেন্সের ‘আ টেইল অব টু সিটিস’ পড়া শুরু করে । তুনি প্রকৌশলবিদ্যার শেষ সেমিস্টারের শিক্ষার্থী। সে যে সব সময় বই পড়ে তা নয়, তবে রেলস্টেশনে পড়তে ভালো লাগে। একে তো লোকজন হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। এর ওপর আলাদা একটা ভাব নিয়ে বসে থাকা যায়।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

একের পর এক ট্রেন আসছে যাচ্ছে কিন্তু সুন্দরবন এক্সপ্রেসের নামগন্ধ নেই। তুনি গল্পের মধ্যে ডুবে গেছে। এমন সময় অভদ্র লোকটা পড়ার ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। রাগে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে তার। স্টেশনের বড় ডিসপ্লের দিকে তাকিয়ে দেখে ট্রেন আসতে এখনো এক ঘণ্টা বাকি।

আমি আমার বোনকে খুন করেছি। ঠান্ডা মাথায় খুন করেছি, লোকটা ভণিতা ছাড়া স্বাভাবিকভাবে বলতে শুরু করে।

তুনি এবার ভালো করে লোকটার দিকে তাকায়। শার্লক হোমসের মতো করে পর্যবেক্ষণ করে। নাহ, তার চেহারায় অপরাধের ছাপ নেই। কিন্তু কেন সে এভাবে আমার কাছে স্বীকারোক্তি দিচ্ছে?

লোকটা তুনির দিকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করে, শুধু খুন নয়, এর সঙ্গে অনেকগুলো শিল্পসত্তাকে ধ্বংস করে দিয়েছি! একটা পরিবারের স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছি, আমি বহুমাত্রিক খুনি! তুনি খেয়াল করে লোকটার গলা ধরে আসছে। আসলে মানুষ যখন কোনো অপরাধের সাবলীল স্বীকারোক্তি দেয়, তখন সে শিশুর মতো আচরণ করে।

আচ্ছা, স্টেশনে এত মানুষ থাকতে আপনার কেন মনে হলো আমাকেই গল্প শোনাতে হবে। হুমায়ূন আহমেদের একটা উপন্যাস ছিল এ রকম, আপনি কি তার পুনরাবৃত্তি করছেন?

হুমায়ূন আহমেদের ‘রুপা’ উপন্যাসটা এমন, ওটা প্রেমের উপন্যাস। আমি আপনাকে সিলেক্ট করেছি কারণ আপনাকে দেখে অনেক স্বাধীন, স্বাবলম্বী আর আধুনিক মনে হয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয়, আপনি বই পড়ছিলেন। বইপড়ুয়াদের আলাদা একটা কল্পনার জগৎ থাকে। এরা পড়তে পড়তে একটা প্যারালাল জগৎ কল্পনা করে। এরপর গল্পের চরিত্রগুলোর সঙ্গে সেখানে বসবাস করে। এই যেমন এখন আপনি ‘আ টেইল অব টু সিটিস’ পড়তে পড়তে লন্ডন ও প্যারিসকে কল্পনা করছেন।

আপনি কি প্রতিদিন এভাবে কাউকে না কাউকে বেছে নেন গল্প বলার জন্য, তুনি চুইংগাম চিবাতে চিবাতে বলে।

প্রতিদিন আসা হয় না। যখন অপরাধ বোধ সহ্য করতে পারি না তখন আসি। এভাবে অপরিচিত মানুষের কাছে গল্পের ছলে অপরাধের কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করি, নিজেকে শাস্তি দিই।

পরিচিত মানুষের কাছে বলেন না?

কাউকে কাউকে বলি। কিন্তু গল্পের একটা সূত্র আছে। সাধারণত একটা গল্প একই পাঠক কিংবা শ্রোতা একাধিকবার পড়তে বা শুনতে পছন্দ করে না, বোরিং লাগে। লোকটা তো ঠিকই বলেছে, তুনি মনে মনে বলে। একই বই দুবার পড়তে তার একেবারেই ভালো লাগে না।

ইরিটেটিং কোনো কিছু বেশি সময় চলতে থাকলে মানুষের মস্তিষ্ক সেখান থেকে একটা ছন্দ খুঁজে পায়। সম্ভবত এ কারণে লোকটাকে এখন আর ততটা বিরক্তিকর মনে হচ্ছে না তার। সে কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করে, কীভাবে খুন করলেন আপনার বোনকে?

লোকটা  আবার বলতে শুরু করে, তখন আমি সবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়েছি। ছোট্ট একটি চাকরি করি এবং চিলেকোঠার একটা রুমে থেকে পড়াশোনা করি বিদেশে যাওয়ার জন্য। আমার বোন পারুল ছিল আমার চেয়ে ছয় বছরের ছোট। ভীষণ রকমের পাকনা, দুষ্ট আর দস্যু প্রকৃতির মেয়ে। বাড়িতে গেলে আমার সঙ্গে দিনের মধ্যে কয়েকবার বিশ্বযুদ্ধ হতো পারুলের। বিশেষ করে খাওয়ার টেবিলে জমজমাট লড়াই হতো। এমনকি আমার প্লেটের খাবার পর্যন্ত খেয়ে ফেলত! আমার কোনো টি-শার্ট ভালো লাগলে দখল করে নিত।

আমার মোবাইলে মেয়েদের নাম দিয়ে সেভ করা নম্বরে ফোন দিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলত। আবার একই সঙ্গে বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে বানিয়ে বানিয়ে বলত, তোমাদের ছেলের সঙ্গে অনেক মেয়ের সম্পর্ক আছে। পরেরবার ক্যাম্পাস থেকে ফেরার সময় তোমাদের ছেলে বউ নিয়ে আসবে, তখন মজা বুঝবে! এসব বলে বাবা–মায়ের কান ঝালাপালা করে ফেলত। একবার রাগে আমি কানপট্টির নিচে কষিয়ে থাপ্পড় দিয়েছিলাম।

এরপর পারুল মরে গেল, এ তো? এ রকম গল্প প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় অহরহ দেখা যায়। ইচ্ছে করছে ট্রিপল নাইনে ফোন করে আপনাকে পুলিশে দিই, তুনি রাগান্বিতভাবে বলে।

আমি আগে শেষ করি, এরপর না-হয় পুলিশে দেন। লোকটা আবার শুরু করে। পারুল পড়াশোনায় মোটামুটি ছিল। পড়াশোনার পাশাপাশি ভালো গল্প লিখত, গান গাইত, ছবি আঁকত। দাবাড়ু হিসেবে তার দক্ষতা ছিল ঈর্ষণীয়। আমি কখনো ওর সঙ্গে পারতাম না। একবার ঘোড়া দিয়ে আমার রাজা–মন্ত্রীকে এমনভাবে চেক দিয়েছিল যে তার পরে থেকে আমি দাবা খেলাই বন্ধ করে দিয়েছি।

আমার মাথায় যে অল্প চুল দেখছেন, এটা আমার বোনের কাজ। ওর সব রাগ আমার মাথার চুলের ওপর দিয়ে যেত। চুল টেনে নাস্তানাবুদ করে ফেলত। লুডু খেলায় আমি বেশি বেশি চুরি করতাম। আর এ জন্য ও আমার মাথার চুল টেনে শেষ করে দিত!

কিন্তু  আমার জন্য ওর ভালোবাসা ছিল আকাশচুম্বী। মাঝেমধ্যে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে গভীর রাতে বাসায় আসতাম। এসে দেখতাম ও না খেয়ে আমার জন্য বসে আছে অথবা ঘুমিয়ে পড়েছে।  যখন বাড়ি থেকে ক্যাম্পাসে যেতাম, সবকিছু এমনভাবে গুছিয়ে দিত যে একটা সুতাও বাইরে থাকত না। মাথার চুল থেকে পায়ের জুতা পর্যন্ত খেয়াল রাখত।

আমি  ছিলাম ওর কাছে পৃথিবীর একমাত্র ভালো মানুষ। আমার চেয়ে বেশি ভালো কেউ পৃথিবীর আট শ কোটি মানুষের মধ্যে ছিল না। বলিউডের মুভি দেখে ও বলত, তোমরা মুভিতে এসব দেখাও আর আমার ভাইয়া এসব বাস্তবে করে দেখায়!

আমার পড়ালেখা যে বছর শেষ হলো, সেই বছর পারুল এইচএসসি পরীক্ষা দিল। এরপর অ্যাডমিশন টেস্টের জন্য কোচিং করতে ঢাকায় আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু এর মধ্যে বাবা হুট করে ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলে। ছেলে ভালো, পরিবার ভালো—সবকিছু মিলে একটা ভালো প্রস্তাব। এ রকম প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া অমঙ্গল হবে। ছেলেপক্ষ বলছে বিয়ের পরে তারা মেয়েকে পড়াশোনা করাবে। তা ছাড়া পড়াশোনা করলেও তো মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে! বাবা আমাকে বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে কনভিন্স করে ফেলে।

বিয়ে প্রায় ঠিকঠাক। আমি ছোট বোনের সঙ্গে বিয়ে নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। নিজে নিজে ভাবলাম, ভালো ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলে মন্দ কী! এর মধ্যে এক ভোররাতে বাবা ফোন দিয়েছে। সাধারণত অসময়ে বাড়ি থেকে ফোন আসার অর্থ হলো দুঃসংবাদ। হ্যাঁ, সেটা দুঃসংবাদ ছিল। পারুল রাতে বাড়ি থেকে পালিয়েছে!

এ পর্যন্ত বলে কিছুটা দম নেয় লোকটা। ইতিমধ্যে আরও একটা ট্রেন স্টেশন ছেড়ে চলে যায়। পারুলের জন্য এখন তুনির খারাপ ফিল হচ্ছে। সে ধারণা করছে লোকটা পারুলকে মেরে ফেলেছে।

এরপর কী হলো, তুনি জিজ্ঞেস করে।

পারুলের পালিয়ে যাওয়া নিয়ে প্রথম প্রথম আমার মধ্যে একটা ভীতি কাজ করে। এ বয়সী মেয়েদের রাগ–অভিমান অতিমাত্রায় বেশি। সহজে সুইসাইড করে ফেলতে পারে। সবচেয়ে বড় বিব্রতকর বিষয় হলো এসব ব্যাপারে আত্মীয়স্বজনকে জিজ্ঞেস করা; আমার বোন কিংবা আমার মেয়ে তোমাদের বাসায় গিয়েছে কি না। তাহলে তারা ভিন্ন কিছু রটিয়ে জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলবে। সে জন্য আমরা বিভিন্ন কৌশলে আত্মীয়স্বজনদের জিজ্ঞেস করি কিন্তু পারুলের হদিস মেলে না।

আমাদের বাসা রেলস্টেশনের অনেক কাছাকাছি হওয়ায় সুবিধার পাশাপাশি কিছুটা অসুবিধা হয়। বিশেষ করে খুব তাড়াতাড়ি বাংলাদেশের যেকোনো জায়গায় যাওয়া যায়। সে সম্ভবত ট্রেনে করে কোথাও চলে গেছে।

একদিকে বিয়ের আয়োজন চলছে, অন্যদিকে কনে পালিয়েছে। মানুষের কাছে এটা নাটকীয় মনে হলেও আমাদের জন্য এটা ছিল জীবন-মরণের ব্যাপার। ভোর থেকে বেলা নয়টা পর্যন্ত সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ নিয়েও তার সন্ধান পেলাম না।

সাড়ে নয়টার দিকে ছোট বোনের ফোন থেকে আমার ফোনে রিং আসে। পিক করতেই শুনি, ভাইয়া, আমি কমলাপুর রেলস্টেশনে, তুমি এসে আমাকে নিয়ে যাও। আমি কালবিলম্ব না করে দ্রুত কমলাপুর রেলস্টেশনে যাই। দেখি পারুল উদাস হয়ে বসে আছে। আমাকে দেখামাত্রই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে। আমার বুঝতে অসুবিধা হয় না, ও বাবার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আমার কাছে চলে এসেছে। ভাইয়া ওর শেষ ভরসা। পারুলের ধারণা ছিল, ভাইয়ার কাছে গেলেই মুক্তি মিলবে।

স্টেশন থেকে বের হয়ে আমরা মতিঝিলে আসি। এরপর একটা রেস্টুরেন্টে খেয়ে বড় বোনের বাসায় যাই। বড় বোন ধানমন্ডি থাকে। আমি খেয়াল করে দেখলাম পারুলের মধ্যে সেই চাঞ্চল্য নেই। এটা–সেটা কেনার বায়না নেই। এক আতঙ্কিত কিশোরীর প্রতিচ্ছবি। কিন্তু আমি এসব নিয়ে মাথা ঘামাই না। মেয়েটাকে একটাবার বুঝতে চেষ্টা করি না। বাবা আমাকে নির্দেশ দেয়, পারুল তোমার বড় আপার কাছে দুই দিন থাকুক। আমি টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি তোমরা বিয়ের কেনাকাটা করো, এরপর সবাই একসঙ্গে বাড়িতে এসো।

আমি একটাবারও বড় আদরের ছোট্ট বোনটার হৃদয়ের স্পন্দন বোঝার চেষ্টা করলাম না। কেনাকাটা শেষ করে দুদিন পরে আমরা বাড়িতে গেলাম। এরপর মহা ধুমধাম করে বিয়ে দিলাম পারুলকে।

না, পারুল আর দ্বিমত করেনি। পালানোর চেষ্টা করেনি। শুধু বিয়ের আগে আমার দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল!

অসভ্য হৃদয়হীন বর্বর আমি তখনো কিছুই বোঝার চেষ্টা করিনি!

বিয়ের সপ্তাহ দুয়েক পরে আমি অনুধাবন করি, এক নিরুপায় কিশোরী নিজেকে বাঁচাতে পালিয়ে গিয়েছিল তার বড় ভাইয়ের কাছে। তার বিশ্বাস ছিল, ভাইয়ার কাছে গেলে সে মুক্তি পাবে। কিন্তু ভাইয়ার কাছে গিয়ে তার মুক্তি মেলেনি। বরং ভাইয়া তাকে ধরে এনে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিয়েছে। আধুনিক চিন্তাধারার বড় ভাই তার স্বপ্নডানা কাঁচি দিয়ে কুচি কুচি করে কেটে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছি।

আমি কল্পনা করি, ফাঁসির মঞ্চ থেকে কোনো এক আসামি পালিয়ে তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত মানুষের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। আসামির ধারণা ছিল, এই লোকটা ইচ্ছে করলেই তাকে বাঁচাতে পারে। কিন্তু সেই বিশ্বস্ত আশ্রয়দাতা তাকে ধরে এনে নিজ হাতে জল্লাদের কাছে সোপর্দ করেছে। আসলে মৃত্যু তার তখনই হয়েছে, যখন বিশ্বস্ত মানুষ তাকে আবার জেলখানায় ফিরিয়ে এনেছে! পারুলের ক্ষেত্রে আমি এমন কাজটা করেছি!

আমি একটা চৌকস কিশোরীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছি।
একটা মেয়ে নারী হয়ে ওঠার আগেই তাকে হত্যা করেছি।
একজন গল্পকারকে হত্যা করেছি।
একজন শিল্পীকে হত্যা করেছি!

আমি তাকে হত্যা করেছি, যে আমাকে দেবতা মনে করত, আমার কাছে আশ্রয়ের জন্য এসেছিল, বাঁচার জন্য এসেছিল!

তুনি লোকটার দিকে তাকিয়ে দেখে তার চোখ–মুখ–বুক জলে ভিজে গেছে। তার নিজের চোখও জলে ছলছল করছে!

ইতিমধ্যে সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেন চলে আসে। তুনি ব্যাগ নিয়ে দ্রুত ট্রেনে উঠে নিজের সিট খুঁজে নেয়। এরপর আবার ভিড় ঠেলে দরজার কাছে চলে আসে। পারুল এখন কী করে, কোথায় আছে, সেটা জিজ্ঞেস করার জন্য ট্রেন থেকে নামবে। কিন্তু ততক্ষণে ট্রেন ছেড়ে দেয়। দরজায় দাঁড়িয়ে তুনি দেখতে পায়, লোকটা অসহায়ের মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত লোকটাকে দেখা যায়, ততক্ষণ সে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে! অপরিচিত লোকটার জন্য তার বুকের মধ্যে হুহু করে কেঁদে ওঠে।

চাঁদনি রাতে প্রচণ্ড বেগে ট্রেন চলতে শুরু করে। নিজের সিটে এসে ধপাস করে বসে তুনি। একরাশ বিস্ময় নিয়ে ভাবতে থাকে, আমি যে ঠিক একই কারণে বাসা থেকে পালিয়ে খুলনায় ভাইয়ার বাসায় যাচ্ছি, ভদ্রলোক সেটা জানল কেমনে?

*নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]