বাতাসে লাশের গন্ধ, দায় কার
অগ্নিকাণ্ড আমাদের দেশের একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কিছুদিন পরপরই দেখা যায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। জীবন্ত মানুষের আগুনে পোড়ার গন্ধে প্রকৃতি নিস্তব্ধ হয়ে যায়। দেশজুড়ে আহাজারি-আর্তনাদ। একটি অগ্নিকাণ্ডের শোকের মাতম সইতে না সইতেই আরেকটা অগ্নিকাণ্ড। অকালে ঝরে যায় কত প্রাণ। আগুন শুধু প্রাণই কেড়েই নেয় না, মানুষকে নিঃস্বও করে দেয়। কিন্তু এ অবস্থা চলবে আর কত দিন? কবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দায়িত্বশীল হবে। আর কত মানুষ পুড়ে মরলে তাদের হুশ ফিরবে।
একটি দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে সবকিছু ঢেলে সাজালে বারবার একই দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতো না। প্রতিটি দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি হয়। নিয়মানুযায়ী অনেকে তদন্ত প্রতিবেদন জমাও দেয়। দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে উঠে আসে নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কথা। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্যি যে এসব তদন্ত প্রতিবেদনের একটিরও আলোর মুখ দেখার নজির নেই। তদন্ত কমিটি যেন লোকদেখানো ছাড়া কিছুই নয়। আবার ক্ষমতার দাপট ও বিচারের প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতায় অপরাধীরা ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যান।
ভবন নির্মাণে অনিয়ম, অবৈধ গ্যাস বা বিদ্যুৎ–সংযোগ, ত্রুটিপূর্ণ গ্যাসের পাইপলাইন, অপরিকল্পিত বৈদ্যুতিক সংযোগ, রাসায়নিক গুদামের দাহ্য পদার্থ ইত্যাদি নানা অনিয়ম তদন্তে উঠে আসে। প্রতিটি দুর্ঘটনায় একটা বিষয় লক্ষণীয় যে সেখানে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ পদ্ধতি নেই। নেই পর্যাপ্ত সিঁড়ির সুবিধা। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভবনে কোনো অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রই নেই। যত্রতত্র গড়ে উঠেছে রেস্তোরাঁ ও হাসপাতাল। তাহলে এসব দেখভালের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান ও কর্মকর্তারা তাঁদের দায়িত্ব কতটুকু পালন করছেন, তা বুঝতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না।
আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন, কলকারখানা, বস্তি, মার্কেট, রেস্তোরাঁ, দোকানপাট ও বিদ্যুতের সাবস্টেশন সবকিছুই আগুনে পুড়ছে। এমনকি জীবন রক্ষাকারী হাসপাতালও। বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ কয়েকটি শহরের একটি রাজধানী ঢাকা। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে সারা দেশে ২৭ হাজার ৬২৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় প্রাণ গেছে ১০২ জনের, আহত হয়েছেন ২৮১ জন। ২০২২ সালে দেশে ২৪ হাজার ১০২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৯৮ জন, আর আহত হয়েছেন ৪০৭ জন। ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের তথ্য মতে, সারা দেশে বছরে আনুমানিক ছয় লাখ লোক আগুনে পুড়ে।
সবশেষ ঘটে যাওয়া ঢাকার বেইলি রোডে ওই ভবনে আগুনে পুড়ে এখন পর্যন্ত ৪৫ জন নিহত হয়েছেন। গুরুতর আহত মানুষের সংখ্যা অর্ধশতাধিক।
গত বছর রাজধানীর গুলিস্তানে অগ্নিকাণ্ডে কোনো প্রাণহানি না হলেও ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। মালামালসহ পাঁচ হাজার দোকান পুড়ে গেছে। দোকান মালিক সমিতির ভাষ্য মতে, এক হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। নিঃস্ব হয়েছেন হাজার হাজার ব্যবসায়ী।
আমাদের ফায়ার সার্ভিসকে আরও আধুনিকায়ন করতে হবে জরুরি ভিত্তিতে। পাশাপাশি অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কে জনগণকেও সচেতন করতে হবে। কখনো আগুন লাগলে করণীয় কী, তা বেশির ভাগ মানুষই জানে না। শিক্ষাক্রমে অগ্নিকাণ্ডের সচেতনতা ও করণীয় অন্তর্ভুক্ত করার সময় এসেছে। পাশাপাশি ঢাকাসহ অন্যান্য বড় শহরগুলোয় পর্যাপ্ত জলাশয় খনন করতে হবে। ভবন নির্মাণে অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার বিকল্প কিছু নেই।
সবশেষে বলতে চাই, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত কমিটি আর নয়। তদন্ত কমিটির প্রতিটি প্রতিবেদন আমলে নিয়ে সুষ্ঠু বিচার করা হোক। আবাসিক ভবন ও কলকারখানা দেখভালের দায়িত্বে থাকা সব শাখাকে জবাবদিহির আওতায় আনা হোক। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন বন্ধ করা হোক। অবৈধ ভবন নির্মাণ বন্ধ হোক। আগে থেকেই সম্মিলিত কার্যকর পদক্ষেপে গ্রহণ করলে অগ্নিকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব।
**লেখক: আনিসুর রহমান, সাবেক সভাপতি, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি।
নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]