বৃষ্টিভেজা সকাল

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

ছবি: এআই জেনারেটেড

রিমা ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠল। জানালার কাচে কাদা জমে আছে, বৃষ্টি থেমেছে কিছুক্ষণ আগে। বাইরে রাস্তা ফাঁকা, শুধুই কুয়াশা আর নীরবতা। ঘরের কোণে রাখা তার একমাত্র দাম্পত্য আলোকচিত্র মা, বাবা আর ছোটবেলায় সে চোখের সামনে ঝলমল করছে। বাবা চলে গেছেন বহু বছর আগে, আর মা এখন তার দৃষ্টিতে অচল একটি বৃক্ষের মতো স্থির।

রিমা কফি বানাতে গিয়ে দেখে, কাপটি ফেটে গেছে। এমন ছোট ছোট ঘটনা যেন তার একাকিত্বকে আরও গভীর করে তুলছে। সে জানে, আর কেউ তার কষ্ট বুঝবে না। ছোটবেলায় বৃষ্টির দিনে বাবা তাকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটতেন, আজ সে একা রাস্তার ধারে বসে আছে। মনে হচ্ছে, পৃথিবী তাকে ভুলে গেছে। রিমা নিজের কক্ষে ফিরে বসল, হাতে ধরা পুরোনো খাতা। সেই খাতায় তার সব ব্যর্থতা, সব একাকিত্ব, সব স্বপ্নের ভাঙন লেখা। সে লিখল, আমি কেবল একা। কেউ নেই আমার। কেউ আসবে না।

চোখে জল জমে উঠল। সে জানল, এই বৃষ্টিভেজা সকাল তার একাকিত্বকে আরও গভীর করেছে।

দুপুরের দিকে রিমা পার্কে হেঁটে গেল। ছোটবেলায় এই পার্কেই সে খেলা করত, মা-বাবার হাত ধরে হাঁটত। এখন শুধু বৃক্ষ। হঠাৎ সে লক্ষ করল, একটি ছোট কুকুর তাকে অনুসরণ করছে। চোখে কোনো ভয় নেই, শুধু দুঃখ। রিমা ভাবল, আমার একমাত্র বন্ধু হয়তো সে। সে কুকুরটাকে ডেকে খেলা করল। কুকুরের কোমল স্পর্শে কিছুটা স্বস্তি পেল।

কিন্তু স্বস্তিটা দীর্ঘস্থায়ী নয়। পার্কের বেঞ্চে বসে রিমা বুঝল, মানুষের মতো কেউ তাকে ভালোবাসে না। ছোটবেলার বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ কেটে গেছে, ফোনগুলো নীরব। রিমা ভাবল, তার জীবনে কোনো গল্প, কোনো হাসি, কোনো উজ্জ্বল সকাল আর আসবে কি?

কুকুরটি বসে রিমার পায়ে মাথা রাখল। সে হেসে বলল, তুমি অন্তত আমাকে পেয়েছ। কিন্তু নিজের কণ্ঠের ভাঙন শুনে তার হাসি থেমে গেল। রিমা রাতে ঘরে ফিরল। রোদ্দুর নেই, শুধু ঘরের বাতি নিভৃতে আলো ছড়াচ্ছে। সে বই বের করল, কিন্তু চোখে পড়ল না কোনো লেখা। স্মৃতি যেন বারবার ঘুরছে তার মনে।

ছোটবেলায় বাবা তাকে পড়াতেন, মা গান শেখাতেন। আজ? শুধু নীরবতা। ঘরের কোণে রাখা ছোটবেলার খেলনা, ভাঙা ঘড়ি, সবকিছু তার জীবনের প্রতিচ্ছবি। রিমা কাঁদতে শুরু করল। মনে হলো, তার একা থাকা শুধু শারীরিক নয়, আত্মার একাকিত্ব আরও গভীর। সে জানল, এই একাকিত্ব কিছুদিনের নয়, এটি তার জীবনভর। সে একটি চিঠি লিখল, কিন্তু প্রাপকের নাম নেই। চিঠিতে লেখা—

আমি আজও এখানে আছি, বৃষ্টির নিচে একা। কেউ আমার জন্য আসে না, কিন্তু আমি বসে থাকি, ভাঙা ঘড়ির কাঁটার মতো।

রিমা জানালার পাশে বসে বৃষ্টি দেখছে। প্রতিটি ফোঁটা যেন তার হৃদয়ের ওপর পড়ছে। কুকুরটি পাশে শুয়ে আছে, কিন্তু তার চোখে কোনো আনন্দ নেই, শুধু শান্তির প্রার্থনা।

রিমা বুঝল, কেউ তার কষ্ট মুছে দিতে পারবে না। বৃষ্টি থেমে গেলে, জল শুকিয়ে গেলেও, তার ব্যথা ভেতরে থেকে যাবে। সে বলল নিজের ভেতর, আমি একা, কিন্তু এই একাকিত্বের মধ্যে হয়তো কিছু শান্তি আছে।

রিমা জানালার কাচে হাত রেখে ভাবল, তার জীবনও এই বৃষ্টির মতো কখনো থেমে যায় না, শুধু ভেতরে জমে থাকে। রাত গভীর হয়। কুকুরটি ঘুমাতে গেল। রিমা শুয়ে চোখ বন্ধ করল। চোখের কোণে জল। মনে মনে সে ভাবল, জীবনের সব বৃষ্টি কখনো শুকিয়ে যায় না।

রিমা সকালে উঠে দেখল, কুকুরটি ঘরে নেই। জানালা খোলা, বাতাস প্রবেশ করছে। বাইরে হালকা রোদ উঠেছে। সে বুঝল, যদিও পৃথিবী কঠিন, জীবন একাকিত্বে ভরা, তারপরও কিছু ছোট আলো আছে যেমন কুকুরটির সঙ্গ, ছোট স্মৃতি, বৃষ্টির ফোঁটা। সে হেসে বলল, যদিও কেউ নেই, আমি আজ বাঁচছি।

রিমা জানল, তার জীবনের ব্যথা, একাকিত্ব সবই থাকবে। কিন্তু তার ভেতরে এক ছোট আলো জ্বলছে, যা তাকে জীবনের কঠিন পথে সামলাতে সাহায্য করবে।

*লেখক: মো. শওকত আলী খান, সিরাজগঞ্জ সদর। [email protected]