আজকের পৃথিবীতে যত যুদ্ধ-সংঘাত সব শুরু ইউরোপীয়দের টানা সেই লাইন থেকে

গাজায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। হামলার পর ধোঁয়ার কুণ্ডলী। গাজা নগরীতেছবি: ফাইল ছবি, রয়টার্স

সিরিয়া থেকে ইরাক, লেবানন থেকে আফগানিস্তান, সুদান থেকে চাদ, সোমালিয়া থেকে কঙ্গো, কিংবা লাতিন আমেরিকার পাহাড়ি জঙ্গল—পৃথিবীর প্রতিটি আগুনের উৎসে লুকিয়ে আছে এক পুরোনো কলমের দাগ। সেই দাগ টেনেছিলেন ইউরোপের সভ্যতার দূতেরা, তাঁরা স্কেল দিয়ে কেটেছিলেন ভূমি, জাতি, ভাষা আর ইতিহাস—ফলাফল হলো আজকের বিভক্ত কুর্দিস্তান, অস্থির লেবানন, যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান, রক্তে ভেজা কঙ্গো কিংবা নিঃস্ব লাতিন আমেরিকা। এক শতাব্দী পেরিয়েও সেই লাইনগুলো এখনো মুছে যায়নি—বরং সময়ের সঙ্গে রক্তে আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে।

ইউরোপের ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো—ব্রিটেন, ফ্রান্স, পর্তুগাল, বেলজিয়াম, স্পেন, ইতালি—ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের পর বিশ্বজয়ের মশাল হাতে বেরোয় সোনা, তেল, জমি আর প্রভাব খাটানোর সন্ধানে। আফ্রিকা, এশিয়া, আরব—সব অঞ্চলকেই তারা দেখেছিল লাভজনক জমি হিসেবে। স্থানীয় সংস্কৃতি, জাতি, ভাষা—এসব তাদের কাছে ছিল একেবারে অপ্রাসঙ্গিক। তারা শুধু চাইত শাসনযোগ্য মানচিত্র। তাই কলোনিয়াল অফিসের অন্ধকার ঘরে বসে একটি টেবিলে কাগজ পেতে তারা কতগুলো রেখা টেনে দিয়েছিল যা নদী, পাহাড়, ঘরবাড়ি, মানুষ, ভালোবাসা, ইতিহাস, ভাষা, সংস্কৃতি এমনি গোত্রের কবর পর্যন্ত কেটে বিভক্ত করে দিয়েছিল মাঝ বরাবর। এই বর্ডার মেকিং ছিল একধরনের জিওপলিটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং—যেখানে ইউরোপীয় কৌশলবিদেরা মনে করতেন, একটি বিভক্ত সমাজই দীর্ঘ মেয়াদে নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ। এই রাজনৈতিক গণিতেই জন্ম নেয় বিভক্ত আফ্রিকা, জ্বলন্ত মধ্যপ্রাচ্য আর অস্থির দক্ষিণ এশিয়া।

১৮৮৪ সালের বার্লিন কনফারেন্সে ইউরোপের শক্তিধর দেশগুলো পুরো আফ্রিকা ভাগ করে নিয়েছিল নিজেদের মধ্যে। একজন আফ্রিকানকেও আমন্ত্রণ জনানো হয়নি সেই বৈঠকে। মানচিত্রের দিকে তাকালে মনে হয় কেউ যেন কাগজে স্কেল দিয়ে সোজা দাগ কেটে রেখেছে, যেখানে কোনো নদী বাঁক নেয়নি, কোনো পর্বত থামাতে পারেনি, আফ্রিকার কঙ্গো নদীর মতো মানুষের জীবনধারাকেও তারা কেটে বিভক্ত করে দিয়েছে। এক দেশের ভেতরে পাঁচ ভাষা, তিন ধর্ম, দশ জাতিগোষ্ঠী আর বহু শতাব্দীর শত্রু উপজাতি সব একসঙ্গে বন্দী। আর সেখান থেকেই জন্ম নেয় সংঘাত, গৃহযুদ্ধ, জাতিগত নিধন। রুয়ান্ডায় হুতু-তুতসিদের রক্তক্ষয়ী হত্যাযজ্ঞ, সুদানের অনন্ত গৃহযুদ্ধ, নাইজেরিয়ার উত্তর-দক্ষিণ বিভাজন—সবকিছুর মূলেই সেই মানচিত্রের দাগ।  

ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ কলমের আঁচড়টি পড়েছিল ১৯১৬ সালের এক রাতে। স্যার মার্ক সাইকস এবং ফ্রঁসোয়া জর্জ-পিকো একটি কাগজে লাল, নীল আর কালো কালিতে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রের লাইন টানলেন। শুরু অনন্ত বিভাজনের। কুর্দিরা ভাগ হয়ে গেল ইরাক, সিরিয়া, তুরস্ক ও ইরানে। সব দেশেই তারা বঞ্চনার শিকার। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ, ইরাকের সাম্প্রদায়িক লড়াই, লেবাননের অস্থিরতা, কিংবা বেলফোর চুক্তির ফলে সৃষ্ট গাজার ধ্বংসস্তূপ—সবই সেই এক টুকরা কাগজের ইতিহাসের ফল।

পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ কলমের আঁচড়টি পড়েছিল ১৯১৬ সালের এক শীতের রাতে। লন্ডন আর প্যারিসের দুই কর্মকর্তা—স্যার মার্ক সাইকস এবং ফ্রঁসোয়া জর্জ-পিকো—একটি কাগজে লাল, নীল আর কালো কালি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে কিছু লাইন টানলেন। সেখানেই ঠিক হয়ে গেল—কে পাবে তেল, কে পাবে সৈকত, কে পাবে মরুভূমি। এই চুক্তির নাম: সাইকস-পাইকট চুক্তি। সেই থেকে শুরু হলো অনন্ত বিভাজন। কুর্দিরা ভাগ হয়ে গেল চার দেশে—ইরাক, সিরিয়া, তুরস্ক, ইরান। সব দেশেই তারা আজ বঞ্চনার শিকার। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ, ইরাকের সাম্প্রদায়িক লড়াই, লেবাননের অস্থিরতা, কিংবা বেলফোর চুক্তির ফলে সৃষ্ট গাজার ধ্বংসস্তূপ—সবই সেই এক টুকরা কাগজের ইতিহাসের ফল।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
লেখক

১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজন ইতিহাসের আরেক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। স্যার সিরিল র‍্যাডক্লিফ—যিনি জীবনে ভারত দেখেননি—মাত্র পাঁচ সপ্তাহে টেনে দিয়েছিলেন ৪৭ কোটির মানুষের ভাগ্যরেখা। একদিকে পাকিস্তান, অন্যদিকে ভারত। মাঝখানে রক্তের নদী। ৩০ লাখ মানুষ নিহত, দেড় কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত, হাজারো নারী ধর্ষিতা।
ব্রিটিশদের টানা ডুরান্ড লাইনের কারণে পশতুনরা আজ ভাগ হয়ে গেছে দুটি ভিন্ন দেশে। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে আজও গুলির শব্দ সেই লাইনেরই প্রতিধ্বনি। ১৪৯৪ সালে আন্দিজ পর্বত আর আমাজন জঙ্গল ভাগ করতে গিয়ে স্পেন ও পর্তুগাল তৈরি করেছে কতগুলো কৃত্রিম রাষ্ট্র আর ধ্বংস করেছে মায়া, ইনকা, অ্যাজটেকের মতো সভ্যতা। ফলাফল তেল, সোনা, খনিজসহ অপার সম্পদ থাকতেও পুরো অঞ্চলটি আজ দরিদ্রতা ও বিদ্রোহের আগুনে ঝলসে গেছে।

অনেকে বলেন—ইউরোপীয়দের দোষ দেওয়া সহজ; কিন্তু স্বাধীনতার পর স্থানীয় শাসকেরা কেন ঐক্য গড়তে পারেননি? এটা আংশিক সত্য। তবে যখন একটি রাষ্ট্রের ভেতরে জাতিগত, ভাষাগত, ধর্মীয়, এমনকি অর্থনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ বিপরীত জনগোষ্ঠীকে জোর করে এক মানচিত্রে বন্দী করা হয়, তখন সংঘাত অনিবার্য হয়ে যায়। যেমন—আফ্রিকার দেশগুলো স্বাধীনতা পেলেও তাদের সীমান্ত ছিল ‘ফিক্সড কলোনিয়াল বর্ডারস’—জাতিসংঘও সেগুলো অপরিবর্তনীয় ঘোষণা করে। ফলে সমস্যাগুলো জাতিগত ঐক্য নয়, বরং বর্ডার-ইম্পোজড ইনস্ট্যাবিলিটি হিসেবে রয়ে যায়। গাজায় শিশুর কান্না, সুদানে মায়ের বিলাপ, ইউক্রেনে বাঙ্কারের শব্দ—সবই সেই পুরোনো কলমের কালি, যা রক্তের নদী হয়ে পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়ছে।

  • লেখক: ইব্রাহীম খলিল (সবুজ), আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়