ঈদ আনন্দের একাল–সেকাল

বেলুন নিয়ে শিশুদের ঈদ আনন্দপ্রথম আলো ফাইল ছবি

এক মাস সিয়াম সাধনার পর একরাশ আনন্দ আর খুশির আমেজ নিয়ে আসছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। ঈদুল ফিতরের কথা মনে এলেই সবার অন্তরে বেজে ওঠে কাজী নজরুল ইসলামের সেই বিখ্যাত গানটি—‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। এ দিন উৎসবের দিন, আনন্দ ভাগাভাগি করার দিন। ধনী-গরিব মিলেমিশে উপভোগ করার দিন।

কিন্তু প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সমাজে ঈদের মধ্যেও ঘটেছে অনেক পরিবর্তন। ঈদের চাঁদ দেখার জন্য এখন আর ছোট-বড় কেউ আকাশের দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকে না। চাঁদ দেখার জন্য এখন ইন্টারনেটযুক্ত হাতের মুঠোফোনই যথেষ্ট। আগেকার আমলের মানুষ ঈদকে উপভোগ করত, কিন্তু এখনকার যুগে মানুষ উপভোগ করার থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্যকে উপভোগ করানোর পেছনে বেশি ছুটছে। অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই যুগে উৎসব দেখার থেকে দেখানোর মানুষের সংখ্যা বেশি।

আগেকার সময় ঈদের দিনে নারীরা ঘরোয়াভাবে তৈরি করতেন বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু খাবার। স্মার্টফোন না থাকায় তখন তাঁদের মধ্যে ছিল না কোনো কনটেন্ট তৈরি করার প্রচেষ্টা, ছিল না খাবারের ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করার ঝোঁক। শপিং করা নিয়ে গ্রামের নারীদের ছিল না কোনো প্রকার আগ্রহ। অনলাইনের ব্যবহার না থাকায় তখন মেয়েরা ঘরে বসেই নতুন নকশার জামার আবদার করতে পারত না। দূরে যাঁরা থাকতেন, তাঁদের ছিল না অনলাইনে অগ্রিম টিকিট কেটে রাখার সুযোগ। ফলে তাঁদের জন্য পরিবারের সদস্যরা অপেক্ষায় থাকত। আগে একান্নবর্তী পরিবার ছিল বলে মানুষ অনেক দূরবর্তী স্থান থেকেও ছুটে আসত পরিবারের সঙ্গে ঈদ উপভোগ করার জন্য। কিন্তু এখন পরিবারগুলো ছোট ছোট হয়ে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ায় ঈদের আনন্দ আর আগের মতো ভাগাভাগি করা হয় না। শহরের অনেক পরিবারই ছুটে আসত গ্রামে ঈদ উদ্‌যাপন করার জন্য। তখন গ্রামের প্রতিটি ঘর মেহমানের আগমনে উৎসবমুখর হয়ে উঠত। কিন্তু এখন ব্যস্ততার কারণে শহরের মানুষকে কষ্ট করে ঈদ করতে আর গ্রামে যেতে হয় না। বর্তমান সময়ে ঈদ এলেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়, তখনকার যুগে তা ছিল না।

বর্তমানে ফেসবুক, মেসেঞ্জার আর আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের দেশের সামাজিক উৎসবগুলো হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের খেলার পুতুল। মানুষ এখন সামাজিক উৎসবের থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোকে বেশি প্রাধান্য দেয়। কে কার আগে ছবি পোস্ট করবে, কার ছবি কতটুকু সুন্দর হয়েছে, পোস্টে কতগুলো লাইক ও কমেন্ট পড়েছে, এগুলো করতে করতেই তাদের দিন চলে যায়। ফলে আগের মতো আর তারা সামাজিক উৎসব আনন্দমুখরভাবে পালন করতে পারে না। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে একদিন ঈদের মতো একটি আনন্দের দিনকেও আমরা হারিয়ে ফেলব। তখন ঈদ থাকবে শুধু দাদি-নানিদের গল্পে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো আমাদের যেমন সব সহজ করে দিচ্ছে, তেমনি বিলীন করে দিচ্ছে আমাদের বাস্তবিক আনন্দগুলোকেও। তাই ঈদকে শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতেই নয়, বরং সামাজিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। তবেই সমাজে সৃষ্টি হবে সম্প্রীতির বন্ধন।

*লেখক: মাইফুল জামান ঝুমু, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]