দেশমাতৃকা জগজ্জননী দেবী দুর্গা
‘তোমার আনন্দ ওই এলো দ্বারে এল এল এল গো ওগো পুরবাসী...’ ধ্বনিত হয় গণেশ পুজোর আড়ম্বর থেকেই। যদিও দুর্গাপূজার আগমনী শুরু হয় মহালয়ার ভোরের পবিত্র সন্ধিক্ষণে। উৎসবের সুবাস পাই—দুর্গাপূজা আসছে বলে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ শুনতে পাই মহিষাসুরমর্দিনীর অমর ভাষ্যে। যা আপামর বাঙালির হৃদয়ে স্থান করে আছে। অনুষ্ঠানটি পূজার অনুষঙ্গ হিসেবে মূল সুরটি যেন বাজিয়ে দেয় বাঙালির হৃদয়তন্ত্রীতে। কৃষ্ণপক্ষের অবসানে শুরু হয় শুক্লপক্ষ। একে আমরা বলি দেবীপক্ষ অর্থাৎ মাতৃ আরাধনার কাল।
গ্রামে বড় হয়েছি বলে ছোটবেলায় শহরের পূজা তেমন দেখা হয়নি। তাই পাড়ার পূজামণ্ডপে সময়-অসময়ে ঘুরে বেড়াতাম। তাতে ছিল অন্য রকম আনন্দ। আশপাশে অনেক গ্রাম থাকলেও পূজার আয়োজন হতো কয়েকটি মণ্ডপে। সে জন্য একই মণ্ডপ বারবার ঘুরে দেখা হতো। পূজার মণ্ডপ কিংবা আবহ সবই ছিল বিস্ময়-জাগানিয়ার মতো। তবে শহর ও গ্রামের পূজার পার্থক্য প্যান্ডেল এবং থিমের মাধ্যমে সহজেই ধরা দেয়। শহরের ধুলাবালু গ্রামের যে স্থানে পৌঁছায়নি, সেখানে আজও দোল খায় সারল্যমাখা হাসি। দৈনন্দিন জীবন সেখানে মন্থর। তাই যাপনে-আচরণে কিংবা আয়োজনে তেমন কৃত্রিমতা নেই। ক্ষণস্থায়ী শরতের বাতাসে ঈষৎ মনকে নাড়া দেয় শারদীয় উৎসবের আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে বলে। সবাই এমন আনন্দে আত্মহারা হয়ে মেতে ওঠেন পূজার আমেজে। তবে কোনোকালেই দুর্গাপূজা নিছকই কোনো অনুষ্ঠানের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিল না, এখনো নেই। পূজার আমেজে মুখর হয়ে আসে বাঁশের প্রতিটি প্যান্ডেল। যেখানে প্যান্ডেলগুলোর নিত্যনতুন থিম সামাজিক বার্তার ইতিবাচক মাধ্যমে হয়ে ওঠে। বিষয়-ভাবনা, আঙ্গিক বিষয়াদি মণ্ডপ নির্মাণকে কেন্দ্র করে প্রতিবছরই নজির তৈরি করে। শহর কিংবা গ্রামের পূজানির্বিশেষে সমাজ ও সংস্কৃতির বিষয়-ভাবনা বা থিম উঠে আসে শৈল্পিক অভিনবত্বে। সন্ধ্যাবেলায় আরতির লহমায় ঢাকঢোলের তাল নতুন আবহের জন্ম দেয়।
তবে যুগের চাহিদা অনুসারে এসেছে বেশ পরিবর্তন। নিজ আঙিনা থেকে বারোয়ারি প্যান্ডেলে, ক্রমে তা হয়ে ওঠে সর্বজনীন পূজা। বর্তমানে সর্বজনীন পূজার প্রচলন বেশি। পূজার আগমনী বার্তা সংসারের দুঃখ ও প্লানি মুছে দিয়ে ধ্বনিত হয় সবার মঙ্গল কামনায়। সামাজিক বন্ধন, ভ্রাতৃত্ববোধ, সাম্য বিম্বিত হয়ে ওঠে সমকালীন দুর্গোৎসবে। যা বয়ে নিয়ে আসে শুভচেতনা। তা আবার কখনো ঢাকের আওয়াজের সঙ্গে মিশে অসাম্য সমাজের প্রতিবাদে সমাজ বিপ্লবের আখ্যান হয়ে ওঠে। পুরাণের মতে, চেদি রাজবংশের রাজা সুরথ খ্রিষ্টজন্মের ৩০০ বছর আগে দুর্গাপূজার প্রচলন শুরু করেন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণমতে, রাজ্যহারা রাজা সুরথ প্রথম পূজা করে ৬০ হাজার বছর শান্তিতে রাজ্য শাসনের আশীর্বাদ পেয়েছিলেন। তবে ১৭ শতকে বাংলার আঞ্চলিক প্রশাসকেরা নিজেদের বাড়িতে দুর্গাপূজার প্রচলন করেন। তাঁদের অনেকেই ছিলেন রাজা উপাধিতে ভূষিত। তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়ণ বাংলায় প্রথম দুর্গাপূজা প্রচলন করেন। তবে কঠোর ধর্মীয় অনুশাসন থেকে বেরিয়ে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র দুর্গাপূজাকে করে তুলেছিলেন সামাজিক-সাংস্কৃতিক মিলনের উৎসব।
আশ্বিনের নবরাত্রি থেকে অকালবোধনের মাধ্যমে শারদীয় দুর্গাপূজার সূচনা হয়। সেই দুর্গা সিংহের পিঠে বসা শুধু মহিষাসুরমর্দিনী নয়, অর্ধবৃত্তাকার পটে আঁকা কাঠামোয় পূজিত লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশ। দেবীর প্রতিমাটি মহিষাসুরমর্দিনী। চণ্ডী ব্যাখ্যায় সে ভীষণ ভয়াল রূপ। কিন্তু দশভুজারূপে পূজিত হন শান্ত, স্নিগ্ধ রূপের অপার মহিমায়। আবার কখনো হয়ে ওঠেন গিরিনন্দিনী উমা থেকে দানবদলনী দুর্গা। পুরাণ, লোকবিশ্বাসের আড়ালে থেকে যায় নৃতত্ত্ব এবং সভ্যতার ইতিহাসের বেশ কিছু অচেনা কাহিনি। সভ্যতার আদিলগ্ন থেকেই প্রকৃতিকে দেবীশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তবে পুরাণগুলোয় দেবী স্বমহিমায় বিরাজিত। সবকিছু মিলে দুর্গাপূজা হয়ে ওঠে সবার শারদীয় দুর্গোৎসব। যা বহন করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এক বিশেষ সংস্কৃতির মেলবন্ধন। শাস্ত্রমতে, এই পূজায় ঘ্রাণ হবে ধূপের, তেজ হবে প্রদীপ এবং সুধাসমুদ্র হবে ভোগ-নৈবেদ্য।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যেও দুর্গাপূজার অস্তিত্ব মিশে আছে। সেসব সাহিত্য সম্ভারে দেবীকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়েছে। কখনো বা কালী, কখনো চণ্ডী, কখনো শ্যামা, কখনো আনন্দময়ী, কখনো অন্নদামঙ্গল। পৌরাণিক কালের আগেই ‘তৈত্তিরীয় আরণ্যক’-এর অন্তর্গত যাজ্ঞিকা উপনিষদে ‘দুর্গা’ শব্দটি প্রথম পাওয়া যায়। যেখানে দুর্গা-গায়ত্রীতে এ শব্দটি ‘তন্নো দুর্গঃ’ রূপে ব্যবহৃত হয়। এই শব্দটির ব্যবহার উপনিষদ ছাড়াও প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থ মহাভারত ও রামায়ণেও পাওয়া যায়। দেবী দুর্গতিনাশিনী তাই দুর্গা। মূলত তিনিই দেশমাতৃকা হিসেবে আবির্ভূত হন। পুরাণমতে, তিনিই দুর্গম নামক অসুরকে বধ করেছেন বলে তিনি দুর্গা। অপরদিকে মহিষাসুর অশুভ ও অহংকারের প্রতীক, যা জগতে অমঙ্গলের হেতু। তাকে শুলে বিঁধে রেখেছেন স্বয়ং দেবী, যিনি কল্যাণময়ী বরাভয়দায়িনী হিসেবে জগতের কল্যাণ করে আসছেন। পূজার ষষ্ঠীতে দেবীর ষষ্ঠাধিকল্প অর্থাৎ আবাহন, বোধন, আমন্ত্রণ, অধিবাস প্রভৃতি অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। দেবীর বোধন হয় বিল্ববৃক্ষে। সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত দেবীর অর্চনা করা হয়ে থাকে। পূজার বিশেষ অনুষ্ঠান অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিতে দেবীর ‘সন্ধিপূজা’ আয়োজন করা হয়।
অন্যদিকে শিল্পীর কল্পনায় তিনি কখনো হয়ে ওঠেন দেশ মাতৃকারূপে, পূজিত হন শিল্পের দেবী হিসেবে। এই শৈল্পিকতা দেখতে পাই শিল্পীর সুনিপুণ শিল্পের কারুকাজে। সে জন্য দুর্গাপূজা একদিকে ধর্মানুষ্ঠান অন্যদিকে শিল্পের অনিন্দ্য সুন্দর রূপ হিসেবে বিরাজমান। তাই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বকে বিশেষভাবে বিবেচনা করে ইউনেসকো দুর্গাপূজাকে স্বীকৃতি দিয়ে বিশ্বের ইনট্যানজিবল হ্যারিটেজের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।
মূলত দেবীকে দেশমাতৃকা হিসেবে কল্পনা করা হয়। হৃদয়েই দেবীর আসন, মন তার পূজার অর্ঘ্য। এখানেই বিশ্ব যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। যে আরাধনায় বাঙালির সমাজচিন্তা ও ভাবনার জয়জয়কার সৃষ্টিলগ্ন থেকেই সমুজ্জ্বল। সে ক্ষেত্রে বাঙালিরা দেবীকে ঘরের মেয়ে হিসেবে যেমন বরণ করেছে, তেমনি অন্যায় অসাম্য দেখলে দেবীর শক্তিরূপকে স্মরণ করা হয় প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে। তখন মহানবমীর যজ্ঞ হয়ে ওঠে ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পোড়ানোর হোমাগ্নি।
প্রতিবছর পূজার আয়োজন শেষ হয় দশমী-যাত্রার মধ্য দিয়ে। তখনই চিত্ত ব্যাকুলতায় বলি—
গিরি, এবার আমার উমা এলে, আর উমা পাঠাব না।
বলে বলবে লোকে মন্দ, কারো কথা শুনব না।
কিন্তু তা আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। প্রতিমা বিসর্জনের পর ফাঁকা ম-পে বুকের ভেতর কষ্ট নামে। সবাই অপেক্ষায় থাকি পরবর্তী পূজার আগমনী উৎসবের।
লেখক: ব্যাংকার