মল্লযুদ্ধ
১. ‘অ্যান্ড দ্য উইনার ইজ মি-ল মা-স-কা-রা-স’ ডব্লিউ ডব্লিউ এফ রেসলিং টুর্নামেন্টের রিংয়ে অ্যানাউন্সারের গলা ফাটানো চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে রেফারি ‘লুচাডর’ মিল মাস্কারাসের হাত উঁচিয়ে জয় ঘোষণা করেন। গোগ্রাসে প্রতি সপ্তাহে সন্ধ্যায় ডব্লিউ ডব্লিউ এফ রেসলিং না দেখলে আমাদের পেটের ভাত হজম হয় না। ইমনের সঙ্গে অনেক ব্যাপারে বিপরীত পছন্দ থাকলেও রেসলিংয়ে আমরা দুজনই মুখোশধারী মিল মাস্কারাসের ভক্ত। তাঁর অবিশ্বাস্য ফ্লাইং কিক, কনুই দিয়ে গলা পেঁচিয়ে ধরে নাকে ডলা দেওয়া এবং অ্যাক্রোবেটিক নৈপুণ্যে আমাদের সব বন্ধুরাই মুগ্ধ। অন্য জনপ্রিয় রেসলার হাল্ক হোগান, অ্যান্ড্রু দ্য জায়ান্ট তাঁদেরও আলাদা ভক্তকুল তৈরি করেছেন।
অদেখা–অচেনার প্রতি মানুষের চিরন্তন আকর্ষণ। মেক্সিকোর ‘লুচা লিব্রা’ বা মুখোশধারী পেশাদার কুস্তি প্রতিযোগিতা ল্যাটিন সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ১৮৬৩ সালে ফরাসি দখলদারত্বের সময় মেক্সিকোতে এই ধরনের মুখোশধারী কুস্তিগিরদের আবির্ভাব ঘটে। মুখোশের আড়ালে তাঁদের আসল নাম হারিয়ে যায়। কুস্তি উপভোগকারী দর্শকেরা জানেন না মুখোশের আড়ালে কে আছেন? রহস্যময় মুখোশধারী লুচাডররা মুখোশ দিয়ে তাঁদের অতীত জীবনের কোনো একটা ঘটনার প্রতীক প্রকাশ করেন। এ জন্য দেখা যায়, অনেক সময় সাধারণ রেসলারদের টার্গেট থাকে লুচাডরদের মুখোশ খুলে ফেলা।
১.
আব্বা-আম্মা মেজ মামার বাসায় সন্ধ্যায় বেড়াতে গেছেন। আমরা অধীর আগ্রহে বিটিভির পর্দায় রেসলিং প্রতিযোগিতার মাঝখানের বিজ্ঞাপন দেখছি। আমাদের বাসার সাহায্যকারী বাবুল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমাদের দুই ভাইকে উসকানি দিচ্ছে রেসলিং করার জন্য। ‘মামা, আনপেরা দুটি খাট এক জায়গায় জোড়া দিয়ে মিল মাস্কারাসের মতো ফ্লাইং কিক মারেন। আমি রেফারি হমু’, বাবুল। বাবুইল্লাকে আমি একটা ধমক দেওয়ায় বলতে থাকে, ‘ইমন মামার সঙ্গে আনপে পারবেন না। এর লাইগ্যাই ডরে রেসলিং করতেছেন না।’ কলিং বেলের শব্দে বাবুল দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেন। ‘কি রে টেমা, তোর খবর কী? “শুনতে পেলাম। বাবুল চিৎকার করে ঘোষণা দেয়”, সানী, দাদা আইছে।’ জাকিয়া মামি ড্রয়িংরুমে ঢুকে আমাদের বলেন, ‘টিভিতে এত মনোযোগ দিয়ে কী দেখছো?’
সানী মামা রেসলারদের কেরামতি দেখে হাসতে থাকেন, ‘মিছামিছি মারামারি করে, ব্যথা পায় না।’ এটা শুনে ইমন মৃদু প্রতিবাদ করে বলে, ‘না, না, এটা সত্যিকারের মারামারি। ওই যে দেখেন, কী ফ্লাইং কিক মারল?’ আমারও একটু সন্দেহ জাগল। সানী মামা বলতে থাকেন, ‘দেখ, ঘুষি মারার আগে সামনে পা দিয়ে জোরে রিংয়ে আওয়াজ করে। এত যে মারামারি করে, রক্ত বের হয় না। আমাদের ফিলিপস বাত্তির মতো জ্বলজ্বলে মুখ নিমিষেই কুপির আলোর মতো ম্লান হয়ে যায়। জাকিয়া মামি মামাকে থামানোর চেষ্টা করেন, দেখো তো, ওরা কত উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে রেসলিং দেখছে, তুমি তাদের আগ্রহটা নষ্ট করে দিচ্ছো।’ তাহলে কি মোহাম্মদ আলী, নাসের ভুলু, ভুলু পালোয়ান আপসে মারামারি করতেন?
২.
বক্সিংয়ে সব সময় শুধু মোহাম্মদ আলী নামটাই শুনে এসেছি। হঠাৎ লোকমুখে মোহাম্মদ আলীর আগমনের নিউজটা শুনে পুরো ঢাকাবাসীর মতো আমরাও উদ্বেলিত। সাদা হাফপ্যান্ট পরা মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে কদিন আগে লিওনেল স্পিংসয়ের ফাইট টিভিতে দেখেছি। সাদা মানে ভালো আর কালো মানে খারাপ, এটা আমাদের বদ্ধমূল ধারণা। এমনিতেই মোহাম্মদ আলী সাদা হাফপ্যান্ট পরেন, তার ওপর কদিন আগে খ্রিষ্টান থেকে মুসলমান হয়েছেন; তাই আমাদের ওনাকে নিয়ে জানার অনেক আগ্রহ! বড় ভাইদের কাছে শুনেছি, আমেরিকান মোহাম্মদ আলীর আগের নাম ‘কেসিয়াস ক্লে’। ভিয়েতনাম যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করায় আমেরিকান সরকার তাঁকে বক্সিং রিংয়ে নিষিদ্ধ করেছিল ও পদক কেড়ে নিয়েছিল। বাংলাদেশের জুনিয়র বক্সিং চ্যাম্পিয়ন ১২ বছরের গিয়াসউদ্দিনের কাছে নকআউট হয়ে রিংয়ের ভেতর পড়ে যাওয়া আলীকে দেখে মনে হলো, তিনি মানুষ হিসেবেও অমায়িক ও নিরহংকার। মোহাম্মদ আলীর সফরের পর আমরাও স্কুলের জুতার মোজা হাতে গলিয়ে গ্লাভস বানিয়ে বিপুল উদ্যমে মুষ্টিযুদ্ধ অনুশীলন করা শুরু করি।
৩.
আম্মা, ‘আমাদের সময় গামা পালোয়ান দশ সের দুধ খাইত, দশটা মুরগি একবারে খাইত, ত্রিশটা ডিম দিয়ে নাশতা করত! আর তোরা এক গ্লাস দুধ না খাওয়ার জন্য কত রকম মুখ ভেংচি কাটিস!’ দুধের কেমন কেমন গন্ধ! অনেক কষ্ট হয় এক গ্লাস দুধ খেতে। আর হাফ বয়েল ডিম তো আমাদের চোখের বিষ, মামলেট চলতে পারে। কিন্তু আম্মা ভাজাপোড়া খাবার দিবেন না। তাই অনেক কসরত আর অনেক বাহানার পর ডিম-দুধ খাই। আম্মা প্রায়ই গামা পালোয়ানের উদাহরণ দেন। আম্মাকে জিজ্ঞাসা করলে বলেন, ‘পুরো ভারতবর্ষের কুস্তি চ্যাম্পিয়ন ছিলেন গামা পালোয়ান।’ কিন্তু কুস্তিগির আর সুমো কুস্তিগিরদের ড্রেসআপের কথা চিন্তা করে আমরা দুই ভাই মুখ চেপে উচ্চকণ্ঠে হাসতে থাকি।
দুপুর থেকেই একটি ছোট্ট বিমান আকাশের বেশ নিচ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। ভেবেছিলাম, হয়তো মশার ওষুধ ছিটাচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ মাঠে ছেলেপেলেদের চিৎকার ‘ওই যে, ওই যে, ধর, ধর! “জানালার কাছে দৌড়ে গিয়ে দেখি, আকাশ থেকে কাগজের বৃষ্টি হচ্ছে। দরজা খুলে দৌড়ে অন্য ছেলেপেলেদের উত্তেজনায় আমরাও শামিল হই। বাদল বলল, ‘মনে হয়, প্লেন থেকে টাকা ফেলছে!’ দৌড়াতে দৌড়াতে সবার সঙ্গে হুটোপুটি করে কয়েকটি নিউজ প্রিন্ট কাগজের লিফলেট পেলাম। লেখা রয়েছে, ‘কুস্তি! কুস্তি! কুস্তি!’ বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ফ্রিস্টাইল কুস্তি প্রদর্শনীর লিফলেট এটি। পাকিস্তানের বিখ্যাত ভুলু পরিবারের নাসের ভুলু, আসলাম গোঁগা, ভারতের নির্মল সিং, ইংল্যান্ডের এলেন টার্নার, বাংলাদেশের পুলিশ সদস্য টাইগার জলিল এ প্রতিযোগিতার মূল আকর্ষণ। ব্যাপক প্রচার ও টেলিভিশনে খেলা দেখানোয় পুরো দেশেই খুব আলোড়ন তুলে।
৪.
‘দুলাভাই, আজকে সুমন-ইমনকে আটকানো হয়েছে; রুবি আপাকে নিয়ে বিকেলে নাশতা আর রাতে ভাত খেলে আপনার ছেলেদের ছাড়ব’ জাকিয়া মামি টেলিফোনে আব্বাকে হাসতে হাসতে ‘আজব মুক্তিপণ’ চাইলেন। আব্বা যতই ‘বোন, আজকে অফিসের অনেক ঝামেলা আছে’ বলতে থাকেন, মামি একটাই দাবি জানাতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত রাতে ভাত খাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় মামি টেলিফোন রাখেন। মামি, ডাক্তার জাকিয়া সুলতানা ডেন্টাল সার্জন-পিজি হাসপাতালে এম এস কোর্সে উচ্চতর ট্রেনিং নিচ্ছেন। ওনার বাসায় কেউ গেলে না খাইয়ে ছাড়বেন না; হাসিখুশি, সহজসরল মামি খুব সহজেই অন্যকে আপন করে নেন।
মাঝেমধ্যে আমরা দুই ভাই সকাল ৯টা–সাড়ে ৯টা থেকে মামা-খালাদের বাসায় সফর শুরু করি। আজিমপুরের বাসা থেকে হেঁটে ধানমন্ডি ১ নম্বরে ছোট খালা, ছোট খালার বাসা থেকে হেঁটে ভূতের গলিতে মেজ খালার বাসা, সেখান থেকে আবার পদব্রজে গ্রিনরোড কলোনিতে সানী মামার বাসা—শেষ পর্যন্ত ধানমন্ডিতে মেজ মামার বাসা দিয়ে আমাদের সফর শেষ হয়। মামিকে আমাদের সফরের সার্কেল পূর্ণ করার জন্য মেজ মামার বাসার কথা জানাতে, মামি বিকেলের নাশতার আগে ফেরত আসার অঙ্গীকার চাইলেন। হুমকি দিলেন, ‘যদি না আসো, তোমাদের বাসায় আর যাব না।’
গ্রিনরোড কলোনি থেকে বের হয়ে ভূঁইয়া একাডেমির কাছে আসতেই রিকশা থেকে দেখি একদল পথচারী গোল হয়ে ব্যাপক উৎসাহের সঙ্গে কাউকে বাহবা দিচ্ছেন। ‘আরে পিচ্চিটারে সামনের বৈশাখে লালদীঘির জব্বারের বলীখেলায় পাঠামু’—একজন দর্শকের মন্তব্য। রিকশার ওপর দাঁড়িয়ে আমরাও দেখার চেষ্টা করি ‘কী ঘটনা’! ভিন্ন সাইজের দুই পথশিশু মল্লযুদ্ধে লিপ্ত। ছোট বাচ্চাটি বেশি মার খেলেও—তার জেদ বেশি; প্রতিবারই ভূমিশয্যা থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে। আমরা রিকশাওয়ালা মামুকে তাঁদের মারামারি বন্ধের জন্য অনুরোধ জানালে, জানান ‘গরিবের পুলাদের এই জিদটাই আছে—জিদ না থাকলে কঠিন পৃথিবীতে টিকতে পারব না।’
* লেখক: আসফাক বিন রহমান, সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর।
নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]