সহনশীলতার আরেক নাম জিতে যাওয়া

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সহনশীলতা একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নাম। সহনশীলতা বা ধৈর্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, যা মানুষকে শান্তিপূর্ণভাবে একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করতে সাহায্য করে।

একটি মানবিক মূল্যবোধের নামই হলো সহনশীলতা। শুধু বই মুখস্থ করলাম আর বড় বড় ডিগ্রি নিলাম, অথচ মানুষের সঙ্গে আচরণ করলাম অমানুষের মতো, তাহলে কি লাভ ওমন বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের গোটা তিনেক সার্টিফিকেট দিয়ে। আসলে একজন মানুষের মানবিক আচরণ যদি সুন্দর বা নমনীয় না হয়, তাহলে তার অর্জিত সব প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই ব্যর্থ।

আমাদের ভেতরে যে ক্রোধ, যে হিংসা-বিদ্বেষ আর ঘৃণা বসত করে, সেই সব নেতিবাচক দিককে একপাশে সরিয়ে রেখে খুব অপ্রিয় কারও সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলার নামই সহনশীলতা। হয়তো কারও আচরণে কারও তেতো কথায় তার ওপর আমরা ভীষণ বিরক্ত। মনে হয় ইচ্ছেমতো সেই মানুষটাকে অপমান করি, যা ইচ্ছা তা–ই বলি। আমরা কিন্তু অনেক সময় এমন প্রতিহিংসামূলক আচরণ করেও ফেলি। তাতে কী হয়, সম্পর্কগুলো আরও বিষাদময় হয়। ভেঙে যায় বহুকালের বহুদিনের আত্মিক সম্পর্ক।

আমরা নিজেকে যত বেশি সংযত রাখতে পারব, আমাদের ধৈর্য বাড়াতে পারব, যেকোনো সমস্যার সমাধানও তত সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন হবে। তার জন্য প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষা।

প্রকৃতিতে যখন প্রচণ্ড ঝড়ঝঞ্ঝা হয়, তখনো কিন্তু একটা মা–পাখি সব প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে নিজের ছানাগুলোকে আগলে রাখে তার ডানার ভেতরে। সে কিন্তু উড়ে চলে যায় না। ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করে সেই কঠিন মুহূর্ত। তেমনি পাখিদের মতো আমাদের জীবনেও অনেক সময় ঝড় আসে। আমরা দিশাহারা হয়ে পড়ি। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যাই।

এমন পরিস্থিতিতে অনেক সময় জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পায়, তাই আমরা না বুঝে না জেনে অন্যদের উপদেশকে অবহেলা করি, তাদের অপমান করি, এমনকি রাগের মাথায় অনেক অমার্জিত ভাষাও ব্যবহার করি। যখন সেই দুর্যোগ কেটে যায়, তখন হয়তো অনুভব করি, কেন সেসব মানুষের সঙ্গে ও রকম নেতিবাচক আচরণ করেছিলাম? খানিকটা অসহায় বোধ হয়। মাথা নিচু হয়ে আসে।

লেখক

কাজেই আমরা যদি বিপদের সময় বা খারাপ সময়গুলো সহনশীলতার সঙ্গে কাটিয়ে উঠতে পারি, তাহলে আমাদের সম্পর্কগুলো নষ্ট হয় না, আবার আমাদের মধ্যে ভুল–বোঝাবুঝিও হয় না।

তার জন্য দরকার সময় ক্ষেপণ করা, ইংরেজিতে আমরা যাকে বলি ‘টেক ইউর টাইম’।

আসলেই তো একটু খেয়াল করলে দেখবেন, আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিন্তু এর–ওর সঙ্গে আমাদের বাগ্‌যুদ্ধ লেগেই আছে নানা কারণে। হতে পারে পারিবারিক কিংবা রাজনৈতিক ইস্যু। আত্মীয়–বন্ধু–সহকর্মীদের যেকোনো লেখা বা মন্তব্য অনেক সময় আমাদের নিজেদের মতের সঙ্গে মেলে না অথবা মনে হয়, কেন সে না জেনে না বুঝে এমন করে লিখল। আমরা তৎক্ষণাৎ বিগড়ে যাই। আমাদের মস্তিষ্ক মেনে নিতে পারে না কোনো নেতিবাচক বা কটুকথা। সঙ্গে সঙ্গে আমরা পাল্টা জবাব দিয়ে দিই। পরিপ্রেক্ষিতে তারাও নানান রকম মন্তব্য করে বসে। এতে করে দুই পক্ষের মধ্যে মারাত্মক এক ভুল–বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।

একটু ভেবে দেখুন, আমরা যদি খানিকটা সময় নিই, নিজেকে বোঝাতে সক্ষম হই যে সে যা লিখেছে বা বলেছে, এটা একান্তই তার নিজস্ব ভাবনা। কাজেই সেই কথার জবাব আমাকে এখনি দিতে হবে কিংবা না দিলে আমি ছোট হয়ে যাব হেরে যাব, না, এমন ভাবনা ভুল। বরং আপনি যদি পরে কোনো উপযুক্ত বা মোক্ষম সময়ে প্রমাণ করতে পারেন যে আপনার সেই বন্ধুর লেখা কথাগুলো ভুল ছিল মিথ্যা ছিল তাহলে কিন্তু সেই ব্যক্তিই লজ্জা পেয়ে যাবে। যদি তার বিন্দুমাত্র বিবেক বোধ থেকে থাকে। কাজেই সব সময় যে সব কথার জবাব দিতেই হবে, তার কিন্তু কোনো মানে নেই।

মনে রাখবেন, সব সময় তর্ক করে বা লড়াই করে জেতা যায় না। সহনশীলতার আরেক নাম জিতে যাওয়া।

অনেক সময় নিজের পরিবারেও এমন অনেক মানুষ থাকে, যাঁরা কারণে–অকারণে বাঁকা কথা শোনায় বা শুনিয়ে মজা পায়। এটা একেকজন মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। আপনি যদি সারাক্ষণ তার বাঁকা কথার সোজা উত্তর দিতে যান, তাহলে দেখবেন, তার সঙ্গে আপনার রেষারেষি লেগেই আছে। তাই বুদ্ধিমানের কাজ কি হবে জানেন, তাকে ধৈর্যের সঙ্গে এড়িয়ে যাওয়া। আরে বাবা বলেছে তো কি হয়েছে, বলুক না, আমার তো গা পচে যাচ্ছে না। হ্যাঁ, অনেক সময় মাত্রাতিরিক্ত অসৌজন্যমূলক আচরণ মেনে নেওয়া যায় না। মনে হয় প্রতিবাদ করি অথবা কথা বলাই বন্ধ করে দিই। কিন্তু কয় দিন কথা বলবেন না? সে তো আপনার বাড়ির লোক, পরিবারেরই অংশ, তাহলে?

সমাধান একটাই, নিজেকে সংযত রাখা। নিজেকে বোঝানো। অনেক সময় চুপ করে থাকাটাও একটা প্রতিবাদ।

রবিবাবুর গানের মতো, ‘অনেক কথা যাও যে বলে, কোনো কথা না বলে।’

সত্যিকার অর্থে ধৈর্য আমাদের শিক্ষিত, পরিণত ও জ্ঞানী করে তোলে। ধৈর্যশীল ব্যক্তি শেষ পর্যন্ত সফলতা অর্জন করে। বিপদে যে ব্যক্তি ধৈর্য ধারন করে সে সহজেই অন্যকে ক্ষমাও করে দিতে পারে। আর ক্ষমার চেয়ে মহৎকর্ম জগতে দ্বিতীয়টি নেই।

গৌতমবুদ্ধ যেমন বলেছেন, ‘ধৈর্য হলো সেই গুণ, যা আপনাকে অনেক বাধা অতিক্রম করে শান্তি ও মুক্তির পথে নিয়ে যায়।’

তার মানে এই নয়, জগতের সব ঘটে যাওয়া অন্যায় দেখেও আপনি চুপ করে থাকবেন। সেটাও একধরনের অপরাধের শামিল। তবে প্রতিবাদের ভাষা হতে হবে শালীন ও সমঝোতাপূর্ণ।

প্রেম, ভালোবাসা, মায়া-মমতা, সম্পর্ক—সবকিছু টিকিয়ে রাখতে পারে একমাত্র সহনশীলতা। প্রতিটি ধর্মে ধৈর্যের কথা বলা হয়েছে। নির্দয় ব্যবহার আমাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটায়, কিন্তু আল্লাহ ধৈর্যশীল ব্যক্তিকে ভালোবাসেন।

মানুষের মনুষ্যত্বের মূল উপকরণ হলো মায়া, মমতা, বিনয়ী, ক্ষমা, স্নেহ, ভালোবাসা, উদারতা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সততা, ধৈর্য, সহনশীলতা নামের কতগুলো সহজ শব্দ।

অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের ভাষায় শেষ করি আমার আজকের লেখা, ‘শুধু আইন দিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করা যায় না, দরকার সহনশীলতা।’

লেখক: রোজিনা রাখী

‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]