বারান্দায় আবছা অবয়ব

আজিমপুর লেডিস ক্লাব শিশু বিদ্যালয়ের সহকর্মীদের সঙ্গে আম্মা—বদরুন নাহার বেগম রুবী (বাঁ দিক থেকে প্রথম)।

বুঝতে পারলাম, ‘কাজইল্যা’ ইচ্ছা করেই ল্যাং মেরে বলটা তার দখলে নিয়েছে। পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যাওয়ার পরও কোনোরকমে দাঁত কিড়মিড়িয়ে রাগ সামলালাম। পিঠে সুপারওম্যান আম্মার প্রখর দৃষ্টিশক্তি টের পাচ্ছি। ইচ্ছা থাকলেও কাজলের দাঁত কেলানো বন্ধ করতে শব্দ বা শক্তি প্রয়োগ করতে পারছি না। মাঠে কোনো অ্যাকশন দিলে সন্ধ্যায় বাসায় আম্মার অ্যাকশন। যতক্ষণ আমরা মাঠে খেলি, জানালায় দাঁড়িয়ে থাকতেন আম্মা। মাঠে গালাগালি-মারামারি-ঝগড়াঝাঁটি করা যাবে না। উসকানিদাতা আমরা দুই ভাই বা কোনো বন্ধু যে–ই হোক, বাসায় আগে আমাদের বিচার।

খুব সকালে আম্মার হাতের নাশতা করে আমরা দুই ভাই আজিমপুর কলোনির ৩২ নম্বর বিল্ডিং থেকে ব্যাগ নিয়ে লাফাতে লাফাতে আজিমপুর লেডিস ক্লাব শিশু বিদ্যালয়ে যেতাম। তিনি শিশুদের আপনজন ‘রুবী আপা’। ‘আম্মা’ বদরুন নাহার বেগম রুবী সেখানে ক্লাস ওয়ানে পড়াতেন। আমরা আফসোস করতাম, ক্লাসমেটরা আম্মাকে আপা ডেকে সাত খুন মাফ পায়! আব্বা ঠাট্টা করে বলতেন, আজিমপুর শিশু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক! আম্মা ছাত্রছাত্রীদের খুব যত্ন নিয়ে পড়াতেন, গল্প বলতেন, নৈতিক শিক্ষা দিতেন। শিশুদের পরীক্ষা এলে মনে হতো যেন আম্মারই পরীক্ষা।

স্কুল থেকে এসে গৃহস্থালির কাজ শেষে দুপুরে পত্রিকা ও দেশ-আনন্দবাজারের পূজাসংখ্যা, বিচিত্রা-রোববারের ঈদসংখ্যা, সেবা প্রকাশনীর কিশোর ক্ল্যাসিক, ওয়েস্টার্ন উপন্যাসগুলো পড়তেন। হুমায়ূন আহমেদ, রাবেয়া খাতুন, বুদ্ধদেব-সুনীল-আশাপূর্ণা প্রমুখ লেখকের বই আম্মার সঙ্গে কাড়াকাড়ি করে আমরা দুই ভাইও পড়েছি। ঘর গোছাতে গোছাতে লতা মঙ্গেশকরের ‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে’ গানটি গুনগুন করে গাইতেন আম্মা। অনেক সময় আকাশবাণী, সিলন রেডিও ছেড়ে গান চালিয়ে ঘরকন্নার কাজ করতেন।

আম্মা ছিলেন খুব সহজ-সরল এবং দৃঢ় নৈতিকতা বোধসম্পন্ন মানুষ। বাসার বুয়া, গ্রামের দুস্থ মহিলা, সবার জন্য ছিল খুব মায়া। আমাদের বাসায় দাদাবাড়ি-নানাবাড়ির মানুষজন নির্দ্বিধায় এসে থাকতেন, হাসপাতালে ভর্তি হতে যেতেন, চাকরিতে যোগদান করতে যেতেন। আম্মা খুশি মনে তাঁদের জন্য রান্না করতেন, সম্মানের সঙ্গে তাঁদের খাবার পরিবেশন করতেন। রাতে আমার ছোট ভাইকে মেহমানদের মশারি টানিয়ে দিতে বলতেন।

লালবাগের পাশে আজিমপুর কলোনিতে আমাদের দুই ভাইয়ের জন্ম। আমরা মাঝেমধ্যে বন্ধুদের সঙ্গে কুট্টি ভাষায় কথা বলতাম। কখনো কখনো আমরা কথা না শুনলে বলতেন, ‘এই লালবাগের ছেড়া’। আমার ছোট ভাইকে আদর করে বলতেন মিনি।

আজিমপুর কলোনিতে কোনো বিল্ডিংয়ের লোকেশন বলার আগে মেহমানদের জানিয়ে দেওয়া হতো সলিমুল্লাহ এতিমখানার পেছনে সুমন-ইমনদের বিল্ডিংয়ের কাছে আসবেন। এখানেই জন্ম হওয়াতে সবাই বেশ আদর করত এবং চিনত। আম্মার কঠোর নজরদারির কারণে দুষ্টুমি লিমিট ক্রস করত না।

আম্মা রাতে শুধু দ্য এ টিম, নাইট রাইডার, ম্যাকগাইভার সিরিজগুলো দেখার পারমিশন দিতেন। আমরা বিকেলে দোতলার সিঁড়ি থেকে স্লো মোশনে সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যানের অনুকরণে দৌড়ে মাঠে যেতাম। ফুটবল-ক্রিকেটের পাশাপাশি বিভিন্ন বাগানে টারজানের মতো দড়িতে ঝুলে ঝুলে খেলা করতাম।

আমাদের দুজনকে আদর করে ময়না, টিয়া, হনুমান বলা হতো। বড় হওয়ার পরও আম্মার আদর পাওয়ার জন্য আমরা এক ভাই আরেক ভাইকে ধরে আম্মার কাছে ঠেলে বলতাম, ‘ও আপনার বান্ধবীকে ভেঙ্গিয়েছে।’ আম্মা রাগ করে চুল ধরে ঝাঁকুনি দিতেন। পরীক্ষার সময় তসবিহ হাতে যতক্ষণ আমাদের পড়া না শেষ হয় বসে থাকতেন, একটু পরপর দোয়া পড়ে ফুঁ দিতেন, মাথায় হাত বুলিয়ে সাহস দিতেন। মনে হতো, এই হাতের মাধ্যমে কী এক অপার্থিব শক্তি আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে।

চাকরিতে ঢোকার পর অনেক ভোরবেলায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে নরসিংদীতে ডিউটি করতে তিতাস কমিউটার ট্রেন ধরতাম। গেটে আওয়াজ না করে চুপি চুপি বের হয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখতাম, বারান্দার জানালায় আম্মার আবছা অবয়ব। এখনো প্রায়ই রাতে বা ভোরে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় পেছন ফিরে অভ্যাসবশত তাকাই জানালায় একটি আবছা অবয়ব দেখার আশায়। ঝাপসা চোখের পানি মুছে এগিয়ে যাই, আম্মাকে তো আর দেখব না।

  • লেখক: আসফাক বীন রহমান, সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর

  • নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]