‘লাস্ট ট্রেন’
‘লাস্ট ট্রেন’ শব্দটির মর্মান্তিক গভীরতা আজকে উপলব্ধি করলাম। সময়ের সঙ্গে প্রেম বহমান কিন্তু নিষ্ঠুর সময় বড্ড ইনট্রোভার্ট। ১ মিনিটের জন্য ট্রেন মিস করে শুনতেই হেসে পৈশাচিক আনন্দ পেতাম, কিন্তু তাদের করুন পদভার আর চোখের পলকের ভারি চাহনি কখনোই উপলব্ধি করতাম না যে ট্রেন মিস করা কতটা সাইক্লোজিক্যাল যন্ত্রণা।
ট্রেন কোনো যাত্রীবাহী যান নয়, ট্রেন একটি জাতির, একটি মানুষের মনুষ্যত্বের ধারক ও বাহক।
ট্রেন ভ্রমণের মধ্য দিয়ে একজন মানুষের দেশের প্রতি পরম প্রেম জন্মায়, যে প্রেম তাঁকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শেখায়, স্বৈরাচারের বুলেটের স্বাদ নিতে শেখায়, জাতির চিত্রে শুকুনের আনাগোনাতে বাঁশরী থেকে বিদ্রোহ করতে শেখায়।
গ্রাম দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী, নালা, ফসলের মাঠ সবকিছুই তাঁকে ঊষ্ণ আঘাত করে খরাময়ী রিদয়ে আশার ফসল বুনে—মস্তিষ্কের গলদ দূর করে দেয়, তখনই পবিত্রতার সঙ্গে বলতে থাকে এ বঙ্গ-বাংলা-আমার সোনার বাংলাদেশ!!
আমার বঙ্গ মায়ের সৌন্দর্যে কার না চোখ জুড়ায়, তবে সেই প্রেম শুধু ট্রেনভ্রমণের মাধ্যমে সস্তায় স্থায়িত্ব পায়।
বঙ্গের পাড়ি প্রকৃতির নিদারুণ চারুতে পরিপূর্ণ সীতাকুণ্ড কিংবা সুন্দরবন, সমুদ্রসৈকত কিংবা আমার খ্যাঁকশিয়ালি, কপতাক্ষ নদ প্রকৃতির উপমায় যেন পাড়ির প্রতি কণা-পিঁপড়া ষোড়সী নববধূ!
ভাইবার মাধ্যমে সম্মান প্রথম বর্ষের পরিক্ষার ইতি টানলাম বেশ মুক্ত আমি, এ জন্য নীলক্ষেত থেকে হরেক রকম বই কিনলাম তার পর হলে ফেরার পর বন্ধু মেহেদির রুমে প্রবেশদ্বার দেখলাম পাদপহীন। তখন বেশ স্বাধ করে একটু খোঁজ নিতেই জানতে পারলাম তারা সীতাকুণ্ডের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে ও আমাকে কয়েকবার ফোন দিয়েছিল কিন্তু আমি আনমনা ছিলাম।
হটাৎ করে আবার ও ফোন আসল মেহেদী আমাকে বলল ট্রেন ছাড়বে ১২টা ১০ মিনিটে তুই যেতে চাইলে দ্রুত স্টেশনে চলে আয়। আমি তখন পরনের কাপড় নিয়েই রওনা হলাম তখন বাজে ১১টা ২৫।
স্টেশনে পৌঁছালাম ১২টা ১০ বাজার ১২ মিনিট পূর্বে।
রিকশা থেকে নেমে বেশ স্বাছন্দবোধ করলাম যে, হাতে তো সময় আছে। কয়েক কদম হাঁটতেই বন্ধুকে ফোন দিতেই আওয়াজ ভেসে আসল দ্রুত আয় ট্রেন ছেড়ে দিছে, তখন প্ল্যাটফর্ম নম্বর শুনেই দৌড় দিলাম স্টাফরা বলতে লাগল হেয় মিয়া দৌড় দেন কিল্লাইগা? গাড়ি মাত্র ছেড়ে গেছে!!
ট্রেন নেই তবু প্লাটফর্মের শেষ অব্দি দৌড়ে গেলাম যদি ট্রেনটা একটু থামে।
হটাৎ নিজের অজানায় চোখ ভিজে গেল চিবুকের পানে করুন মেঘের নিদারুণ ঝড় শুরু হলো আর লাস্ট ট্রেন শব্দের তিক্ত সত্য উপলব্ধি অনুভব হতে লাগল আর মিস করতে লাগলাম বঙ্গমায়ের অজস্র উপমার বাস্তবিকতা।
আহ কতই না প্রকৃতিময়ী শব্দযুগল, আন্তনগর! শোভন চেয়ার! প্ল্যাটফর্ম!
আজ রাতে ফুটবে কত নবীন ফুল তার ওপর জমবে শিশির প্রভাত হতেই ঊষারের রিমঝিম রশ্মির পরশে জ্বলন্ত ফুলের নব্য যৌবন আর মৃদু ঘাসের ঝলক দেখ হলো না কিন্তু গভীর রাতে ষ্টেশনের নওজোয়ানদের জীবন উপলব্ধি করছি।
ডান দিকে কিছু ছোকরা বস্ত্রহীন অবস্থায় আগুনের স্বাদ নিচ্ছে আবার বৃদ্ধ দাদু চিড়ে, মুড়ির সঙ্গে রাতের ডিনার করতেছে, এক পথ শিশু তার সহপাঠীর মাথা আচড়ে দিচ্ছে। পাকড়া মোচ নিয়ে কেউ পত্রিকা পড়তেছে আবার সিএনজি চালকেরা যাত্রীদের নিয়ে টানাটানি করতেছে—
আবার কেউ মেঝেতে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
সবকিছু শেষে ট্রেন ষ্টেশনও মনুষ্যত্ব্যের পরম উপলব্ধি শেখায়।
* লেখক: মিরাজ ইবনে রহমান, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা কলেজ, ঢাকা ১২০৫