এইচএসসিতে ‘তৃতীয় বর্ষ’ থেকে বলছি
মানবজাতি ইতিহাসের অভূতপূর্ব নিদারুণ একটি সময় পার করছে। বিশ্বের পূর্ব থেকে পশ্চিম কিংবা উত্তর থেকে দক্ষিণ, প্রাচ্য কিংবা প্রতীচী অথবা মেরু কিংবা মরু, উপকূল বা পর্বত—সমগ্র বিশ্ব প্রায় তিন বসন্ত ধরে আমূল বদলে গেছে। বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ কালে কালে এক রূপ থেকে অন্য রূপ ধারণ করেছে। সময়ের সঙ্গে হয়েছে পূর্বের তুলনায় আরও ভয়ানক। কখনো ডেলটা, আবার কখনো অমিক্রন নামের বিভিন্ন ধরন আগের তুলনায় আরও ভয়ানক হয়ে এসেছে। পৃথিবী কোভিডের বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে নেমে এসেছে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। কোথাও সৃষ্টি হয়েছে নিদারুণ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকট, কোথাও জেঁকে বসেছে স্বৈরাচার, কোথাও নেমে এসেছে অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্বের অভিশাপ। কোভিডের ক্ষত ধীরে ধীরে পৃথিবী কাটিয়ে উঠছে। গবেষণালব্ধ তথ্য ও বাস্তব জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রমাণিত, কোভিড-১৯–এর আকস্মিক বিপর্যয়ে পৃথিবীজুড়ে যে যে খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে শিক্ষা খাত।
কোভিড–পরবর্তী সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই বিস্ময়কর সফলতা দেখিয়ে বিশ্বের দরবারে আশ্চর্যের সৃষ্টি করেছে। অর্থনীতির ক্ষতি কাটাতে মোটামুটি সফল হলেও বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত শিক্ষায়। শিক্ষা খাতের মানসম্মত পারফরম্যান্স কেমন হবে, তার ওপরই নির্ভর করে অনাগত কালে জাতির ভবিষ্যৎ কেমন হবে। শিক্ষা খাত জাতির আশা ও আকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্র। যদিও বাজেটে শিক্ষা খাতে ব্যয়ের হার দেখলে এমনটি সহজে মনে হয় না। অবশ্য নীতিনির্ধারকেরা শিক্ষা খাতে অর্থ বরাদ্দকে যদি ব্যয় হিসেবে বিবেচনা না করে সামাজিক বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করেন, তাহলে হয়তো অবস্থার উত্তরোত্তর ইতিবাচক পরিবর্তন হতে পারে।
আমি উচ্চমাধ্যমিকের লাখো পরীক্ষার্থীদের একজন বলছি। সেই ২০২০–এর মার্চের শুরুতে যখন আবহমান বাংলার প্রকৃতি বসন্তবরণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, সেই সময়ে আমাদের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট বা এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়। এসএসসি পরীক্ষা যেদিন শেষ হয়, এখন পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে সেদিনটি ছিল এক ভিন্ন রকমের আবেগের দিন। বাঙালি শিক্ষার্থীসমাজে ফাইনাল পরীক্ষার সমাপ্তি যে মনে কী মনোরম অনুভূতি জাগায়, সেদিন সেটি উপলব্ধি করেছিলাম। একদিকে প্রকৃতি শীতকে বিদায় জানিয়ে বসন্তবরণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, অন্যদিকে ১৮ বছর বয়সী একদল তরুণের মনে বাসন্তী হাওয়া বইতে শুরু করল। প্রকৃতিতে যেমন নবপল্লব, বাতাসে পরাগের ছড়াছড়ি, আকাশে নীলের উচ্ছ্বাস, তেমনি এ দেশের একদল তরুণ সবে ১৮ কিংবা ১৭ ছুঁয়েছে।
০২২ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের মনে এখন এই প্রার্থনাই যে নভেম্বরের পরীক্ষার সময় যেন আর না বাড়ে। পৃথিবীটা আবার সুস্থ হয়ে উঠুক। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়ন হোক।
এসএসসি পরীক্ষার সমাপ্তি তাদের কিছু সময়ের জন্য দিয়েছিল ছুটি। বন্ধুমহলের সবাই সেদিন নানা পরিকল্পনার কথা জানাল—কারও মন বসে না আর কংক্রিটের নগরে, সে যাবে নীল সাগরে; কেউবা ছুটে যাবে পাহাড়ে, কেউ ঘুরে আসবে হাওরে। হঠাৎ গুড়েবালি ফেলে টিভির পর্দায় খবর এল, দেশে এসেছে এক বিপর্যয়—কেউ ঘর থেকে বের হতে পারবে না। শিক্ষার্থীরা শিক্ষাঙ্গনে যেতে পারবে না। নিমেষেই সমগ্র দেশ হয়ে পড়ল নিস্তব্ধ। না, তখন দেশে বর্গি আসেনি। দেশে হানা দিয়েছিল কোভিড-১৯ নামের বৈশ্বিক মহামারি। ভেবেছিলাম, এই তো হয়তো কিছু সপ্তাহ লকডাউনে থাকা লাগবে, তখন কে জানত, এই লকডাউন, শাটডাউন বছরের গণ্ডি পেরোবে। সে সময়কার বিস্মৃতির কথা আজ নাহয় অন্য দিনের জন্য জমা থাকুক।
এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলো, কিন্তু স্কুলে গিয়ে সিনিয়রদের মতো শিক্ষক আর বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠার সুযোগ হয়নি। কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হলো কলেজে ভর্তি প্রক্রিয়া।
মফস্বল থেকে রাজধানী শহরের নামকরা কলেজে ভর্তির সুযোগ পেলেও কলেজে ক্যাম্পাসে যাওয়ার সুযোগ পাইনি। আমাদের ওরিয়েন্টেশন ক্লাস শুরু হয় অনলাইনে। শ্রেণিকার্যক্রম যথারীতি চলতে থাকে অনলাইনেই। বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, বিতর্ক—সবই অনলাইনে চলছিল। অবশ্য কোভিড আমাদের অনলাইন শিক্ষাপদ্ধতিকে ব্যাপক হারেই ত্বরান্বিত করেছে, যা হয়তো স্বাভাবিক অবস্থায় আরও কিছু বছর সময় নিত। অনলাইনে ক্লাস করতাম, অনলাইনেই দিতাম পরীক্ষা।কলেজজীবন অনলাইনেই কাটছিল। তখন মাঝেমধ্যে এমনও মনে হতো হয়তো কখনো ক্যাম্পাসেই যাওয়া হবে না। ২০২১ সালের কোনো এক কাকডাকা ভোরে চায়ের পেয়ালা হাতে মুঠোফোন হাতে নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম নিমেষেই। প্রথমে ভেবেছিলাম, হয়তো কেউ ফেসবুকে গুজব ছড়াচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে টিভি চালু করে নিউজ দেখলাম। দেখে মনে হলো, রূপকথার জগতে যাওয়ার মাধ্যম পেয়ে গেছি। সেদিন ঘোষণা এল, সেপ্টেম্বর থেকে কলেজ খোলা। যদিও এর আগে বহুবার এমন খবর এসেছিল, কিন্তু সেদিন কেন যেন মনে হচ্ছিল, এবার আসলেই কলেজ খুলতে যাচ্ছে।
কলেজপড়ুয়া স্বপ্নবাজ এক তরুণ যে কলেজে ভর্তি হয়ে প্রায় এক বছর পর কলেজ যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে, তার সেদিনের অনুভূতি আসলে লিখে প্রকাশ করার মতো নয়, যদি ভাষায় প্রকাশ করা যায়ও তাহলে আমার সেই ভাষাজ্ঞান নেই। জীবনে এল এক নতুন মাত্রা। কলেজে সশরীর উপস্থিত হলাম, ক্যাম্পাসে গেলাম। কলেজজীবন উপভোগ করা শুরু করলাম। পড়ালেখা, আড্ডাবাজি, প্রতিযোগিতা—সবই চলতে থাকল।
বিশেষ ব্যাচ হিসেবে আমাদের পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য পরীক্ষার সময় পেছানো হলো। ঘোষণা ছিল, এ বছরের আগস্টে শুরু হবে পরীক্ষা, কিন্তু সিলেটের বন্যা বিপর্যয়ের পর এসএসসি পরীক্ষা পেছানো হলো। স্বাভাবিকভাবেই এইচএসসিও পেছাল। বারবার আমাদের ব্যাচের ছন্দপতন হলো। আমরা পড়াশোনায় যখনই খুব সিরিয়াসলি মনোনিবেশ করা আরম্ভ করেছি, তখনই হয়েছে ছন্দপতন। এখন তো শুনছি, নভেম্বরে হবে পরীক্ষা। তাই আবারও পড়ার টেবিলে পূর্ণ মনোযোগের সঙ্গেই আমরা সবে বসা শুরু করেছি। ২০২২ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের মনে এখন এই প্রার্থনাই যে নভেম্বরের পরীক্ষার সময় যেন আর না বাড়ে। পৃথিবীটা আবার সুস্থ হয়ে উঠুক। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়ন হোক। শিক্ষা খাতে বরাদ্দকে বিনিয়োগ হিসেবে দেখার আকুল আবেদন জানিয়ে সবার কাছে ২০২২ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য দোয়া কামনা করছি।
*লেখক: তামিম হোসেন পাভেল, শিক্ষার্থী, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ, ঢাকা, বাংলাদেশ।