আমাদের বিজয়, আমাদের কবিতা, আমাদের অস্তিত্বরক্ষা
আমাদের প্রধানতম অর্জন হচ্ছে স্বাধীনতা-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জন করা। ছাত্র, শিক্ষক বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ অসাধ্য বিজয় অর্জনে সক্ষম হয়েছি। কবিদের জোরালো উচ্চারণ সহায়কের ভূমিকা পালন করেছে। তাদের অনেকের উচ্চারণ ছিল রক্তজবার মতো প্রোজ্জ্বল, ফলার মতো তীক্ষ্ণ। হাসান হাফিজুর রহমান থেকে নির্মলেন্দু গুণ, শামসুর রাহমান কিংবা আল মাহমুদ, আসাদ চৌধুরী, রফিক আজাদ, শহীদ কাদরী, রুদ্র, হুমায়ুন আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, হেলাল হাফিজ প্রমুখ কোন কবির কলমে রক্ত ঝরেনি? প্রতিবাদী কণ্ঠ হায়েনাদের ভয় ডরায়নি? কবি সিকান্দার আবু জাফরের ‘বাংলা ছাড়ো’ কবিতার অগ্নিবার্তা কী সহজে ভোলা যায়!
১৪ ডিসেম্বর বহু বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও দেশীয় দোসররা। ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রাদেশিক সরকারের বেসামরিক উপদেষ্টা মেজর রাও ফরমান তাদের দোসরদের সঙ্গে সদর দপ্তরে রাতে এক গোপন বৈঠক করে। সেখানে তৈরি করা হয় বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা। সেই নীলনকশা অনুযায়ী হত্যা করা হয় জাতির মেধাবী সন্তানদের। বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষকদের ১৪ ডিসেম্বরে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা। এটা ছিল পরিকল্পিত। পরাজয় নিশ্চিত ভেবে পাকিস্তানি হায়েনাদের এ বর্বর কর্মকাণ্ড বিশ্বকে বেশি করে জানাতে হবে। এ কথা এখন অনেক আলোচনা হলেও আগে কম আলোচিত হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে একটা জাতিকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনা আমাদের আরও আলোচনা করতে হবে। বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মুক্তিযোদ্ধারা আলোচনা বেশি করলে পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারবে প্রকৃত ইতিহাস। বিজয় দিবসে জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক কর্মকর্তা জন কেলি সকালে ঢাকায় আসেন। সেনানিবাসের কমান্ডো বাংকারে লে. জেনারেল নিয়াজীকে পাওয়া না গেলেও বিধ্বস্ত অবস্থায় পাওয়া যায় জেনারেল রাও ফরমানকে। রাও ফরমান জন কেলিকে বলেন, তাঁরা মিত্রবাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রস্তাব মেনে নিয়েছেন এবং তাঁরা আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তুত। কিন্তু মিত্রবাহিনীর সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগব্যবস্থা না থাকায় এ বিষয়টি তাদের জানাতে পারছেন না। এ সময় জন কেলি রাও ফরমানকে জাতিসংঘের বেতার সংকেত ব্যবহারের কথা বলেন। তখন আত্মসমর্পণের জন্য সময় নির্ধারণ করা হয় বিকেল সাড়ে ৪টা। সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে ঢাকায় প্রবেশ করে মিত্রবাহিনী। বিকেল সাড়ে ৪টায় লে. জেনারেল নিয়াজীর নেতৃত্বে আত্মসমর্পণ করে ৯১ হাজার ৫৪৯ জন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সেনা। মেজর জেনারেল জ্যাকবের তৈরি করা আত্মসমর্পণের দলিলে বিকেলে সই করেন লে. জেনারেল নিয়াজী ও লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। সেখানে মুজিবনগর সরকার থেকে সেখানে উপস্থিত ছিলেন ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। কিন্তু আত্মসমর্পণ দলিলে পরাজিত বাহিনীর সম্মুখে লিখিতভাবে মেনে নিয়ে মালিকানা ত্যাগ বা হস্তান্তর করার বিষয়টি আমাদের জন্য গর্বের। রমনা রেসকোর্সের এই দলিলকেই বলা হয় ‘দ্য পাকিস্তানি ইনস্ট্রুমেন্ট অব সারেন্ডার’ বা পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের দলিল। এ দলিল বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এটা গর্ব করার মতো বিষয় আমাদের জন্য। পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। স্বাধীনতা যে আমাদের মধ্যমণি কিংবা অস্তিত্ব, তার প্রমাণ পাই শামসুর রাহমানের কবিতাতেও:
স্বাধীনতা তুমি
‘রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝঁকড়া চুলের বাবড়ি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপাÑ
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা
...স্বাধীনতা তুমি
যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।’
[স্বাধীনতা তুমি/শামসুর রাহমান]
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য কবিতাকে অস্ত্র করে তুলেছিলেন জসীমউদ্দীন। ‘কবির নিবেদন’ শীর্ষক কবিতাটি ‘আ পয়েটস আপিল’ শিরোনামে সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের নানান প্রচারমাধ্যমে মুদ্রিত হয় কিংবা হয় উচ্চারিত। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মানুষ হত্যা করেছে, জ্বালিয়ে দিয়েছে ঘরবাড়ি, সংঘটিত করেছে মানব-ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা। এই গণহত্যার বিরুদ্ধে কবি জানাচ্ছেন তীব্র ঘৃণা। কবির শক্ত উচ্চারণ:
‘সে বাঙলা আজি বক্ষে ধরিয়া দগ্ধ গ্রামের মালা,
রহিয়া রহিয়া শিহরিয়া উঠে উগারি আগুন জ্বালা
দস্যু সেনারা মারণ-অস্ত্রে বধি ছেলেদের তার,
সোনার বাঙলা বিস্তৃত এক শ্মশান কবরাগার।
বনে জঙ্গলে লুণ্ঠিত গৃহে কাঁদে শত নারী-নর,
কোথায় যাইয়া মিলিবে তাদের পুনঃ আশ্রয়-ঘর!
প্লাবনের চেয়ে মারিভয় চেয়ে শতগুণ ভয়াবহ,
নরঘাতীদের লেলিয়ে দিতেছে ইয়াহিয়া অহরহ।
প্রতিদিন এরা নরহত্যার যে কাহিনী এঁকে যায়,
তৈমূরলং নাদির যা দেখে শিহরিত লজ্জায়
[কবির নিবেদন/জসীমউদ্দীন]
বিজয় সবার হোক। সব পেশার কিংবা সব সম্প্রদায়ের জন্য কল্যাণকর। রাজনীতি কিংবা অর্থনীতি কিংবা পরিচালনায় নারী ও পুরুষের বৈষম্য কমিয়ে উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। সবাই মিলে বৈষম্যহীন কিংবা অসাম্প্রদায়িক-চেতনায় লালিত হয়ে উঠি বাংলাদেশি। স্বাধীনতার দুর্বার চেতনা বহিঃশক্তির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করতে পারব। বিজয়ের স্বপ্ন যেন হাতে ধরা দেয়। কবিতার পঙ্ক্তিতেই বলি:
‘এক পৌঢ় বললেন, তিনি খাচ্ছেন
পরে কথা বলবেন
আমার শিহরিত মন বলল, ভুল দেখছি?
এবার পৌঢ়ের হাসিতে আলোকিত বস্তিটি
অষ্টাদশী মেয়েটি বলল, সে সুখেই আছে
তার হাসির ফোয়ারা নীল-আকাশে উজ্জ্বল মেঘ
এখন তার মুখখানি অবাধ বাংলাদেশ।
শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনির এক নৌকায় কয়েকটি শিশু
তাদের হাতে ব্যাগÑতাতে বই, কলম, পেনসিল
হুর-রে!
স্কুলে যাওয়ার আনন্দে নদীর স্রোত এলোমেলো।
পথের গাছতলায় দেখা এক কবির সঙ্গে
তিনি লিখছেন, শুধুই লিখছেন
দূর থেকে দেখি পৃষ্ঠার কোণে লেখা, প্রতি জগন্নাথ
ইতি ফয়সাল
বুঝতে বাকি নেই আজকের বিজয় শুধু আমার নয়Ñসবার।’
[বিজয়ে চাওয়া/আবু আফজাল সালেহ]
বিজয়কে সুসংহত করতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করে তারুণ্যকে আনন্দ দিতে পারলেই বিজয়ের প্রকৃত স্বাদ পাব। তরুণদের পথচলা হোক আনন্দে। ব্যর্থতায় সম্ভব নয়। তারুণ্যশক্তিকে অলস করে রাখলে দেশ ও জাতির জন্য হিতকর হবে। শিল্পায়নে অগ্রগতি, কৃষি খাতে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, পিছিয়ে পড়া পাহাড়ি, চর, বরেন্দ্র, কিংবা প্লাবনপ্রবণ অঞ্চলে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বাজারের সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে। ওষুধে ভেজাল বন্ধ করতে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত ও সহজলভ্য করার জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিক বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ পরিকল্পনা নিতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষাকে প্রাধিকার দিতে হবে। উচ্চশিক্ষায় গবেষণার জন্য বরাদ্দ ও তদারকি বাড়াতে হবে। বিদেশি-পরিকল্পনা না-গ্রহণ করে তা রূপান্তরিত ও স্থানীয়-পরিবেশবান্ধব করে এগিয়ে যেতে হবে। কৃষিকে সামনে রেখে বিভিন্ন পরিকল্পনা ফলপ্রসূ হবে। আমেরিকান কবি হুইটম্যান। তিনি গণতন্ত্রকামী কবি। তিনি আমেরিকানবাদের মধ্যে সব শ্রেণির মানুষকে আপন ভেবেছেন। বাঙালিরা স্বাধীনতা-সংগ্রামের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। কিছু বাদে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। হুইটম্যান কবিতায় বললেন:
I hear America singing, the varied carols I hear;
Those of mechanics...
The carpenter...
The mason...
The boatman..
(I Hear America Singing)
বিজয়কে সুসংহত ও কার্যকর করতে হলে যার যার অবস্থান থেকে সবার আন্তরিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। বায়ু বা পানি কিংবা আলো দূষণ থেকে দেশ ও জাতিকে বাঁচানোর কার্যকর ও সাহসী বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ ও তা আন্তরিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। ভবিষ্যৎ-প্রজন্মের জন্য উন্নততর অবস্থান রেখে যেতে হবে। তরুণদের জন্য পথ ছেড়ে দিতে হবে। তাদের জন্য পথ আটকানোর পুরোনো অথচ চালাকি উদ্যোগ গ্রহণ না করে তরুণদের জন্য পথ খোলা রাখতে হবে। চব্বিশ অভ্যুত্থান তরুণদের কার্যকারিতা দেখিয়ে দিয়েছে। বায়ান্ন, উনসত্তর, একাত্তর কিংবা স্বৈরাচার এরশাদ পতনে তরুণেরাই সামনের সারিতে ছিল। এখন তাদের কাজে লাগাতে হবে।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক