পঞ্চানন্দপুরে কয়েক ঘণ্টা
আমাদের পরিকল্পনা ছিল বন্যার্ত পরিবারগুলোকে শুকনা খাবার, পানি ও প্রয়োজনীয় ওষুধ পৌঁছে দেওয়া। পরিচিতি ব্যক্তিদের খবর নিয়ে জানাতে বলেছিলাম, এখনো সহায়তা পৌঁছায়নি, সে রকম জায়গা খুঁজে বের করতে। আমরা এই সংকটকালে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াব। টাকা সংগ্রহের জন্য এক দিন আগেই শ্রীমঙ্গল শহরের চৌমুহনা চত্বরে আমাদের অর্ধশত যন্ত্র ও কণ্ঠশিল্পী জড়ো হয়ে গেল। গান গেয়ে চলল অর্থসংগ্রহ। এর মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টি জানানোর পর দেশ–বিদেশ থেকে পরিচিতজনেরা সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিল। টাকা সংগ্রহের জন্য সব মিলিয়ে দুই দিন সময় পাওয়া গেল। কাজ ভাগ করে প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। প্রথম প্রস্তুতি খাদ্যসামগ্রী ক্রয় করা। দায়িত্ব ভাগ করে কাজে নেমে পড়ায় কেনাকাটার পর্বটা রাত ১০টার মধ্যে শেষ হয়ে গেল। আগেই বলে রাখা হয়েছিল, যত রাতই হোক না কেন, প্যাকেজিংয়ের কাজটা রাতের মধ্যেই শেষ করতে হবে। কেননা, পরদিন সকালেই সবকিছু নিয়ে বন্যাকবলিত এলাকার উদ্দেশে রওনা দেওয়া হবে। সেই মোতাবেক কাজ হলো। সবার সহযোগিতা থাকায় মধ্যরাতের মধ্যেই খাদ্যসামগ্রী প্যাকেজিং করতে সক্ষম হওয়া গেল। খাদ্যসামগ্রী গাড়িতে লোড করা ছাড়া সোমবার (২ সেপ্টেম্বর) সকালের জন্য আর কোনো কাজ বাকি রাখা হলো না। সে জন্য নির্ধারিত সময় সকালেই সবকিছু নিয়ে রওনা দেওয়া সম্ভব হলো।
আমরা ১৬ জন। দুই ঘণ্টার কিছু সময় পর আমরা আমাদের গন্তব্যের আরেক উপজেলা রাজনগরের কামারচাক ইউনিয়নের পশ্চিম পঞ্চানন্দপুর গ্রামে পৌঁছে গেলাম। যেখানে গত বুধবার থেকে টানা চার দিন মানুষ পানিবন্দী ছিল। দুই দিন ধরে পানি কিছুটা নামছে। কয়েকটি বাড়ির ভেতর পানির ক্ষতচিহ্ন দেখতে গিয়ে চোখে পড়ল, মাচার ওপর তুলে রাখা হয়েছে বাড়ির আসবাবপত্র। যেখানে ঠাঁই হয়েছে রান্নাঘরের হাঁড়িপাতিল থেকে শুরু করে বিছানাপত্রেরও। একটি বাড়ির পূজার ঘরের মাঝখানে দেবতার ছবিসহ আসনটি চোখে পড়ল। বাড়ির ভেতর থেকে পানি নেমে গেলেও আঙিনায় এখনো হাঁটুর নিচসমান পানি জমে আছে। কয়েকটি পরিবার নিজ বাড়িতে টিকতে না পেরে বাধ্য হয়ে উঠেছে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখানে গিয়ে চোখে পড়ল, মানুষের পাশাপাশি গৃহপালিত চারটি পশুও আশ্রয় নিয়েছে বিদ্যালয়টির দ্বিতীয় তলায়। নিচে যেখানে এখনো হাঁটুপানি। অন্যদিকে কোমরপানি পাড়ি দিয়ে স্রোতের মধ্যেই অচেনা পথ হেঁটে ২১টি পরিবারকে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়াটা ছিল নতুন এক অভিজ্ঞতা। অবশ্য পশ্চিম পঞ্চানন্দপুর গ্রামের এই পাড়ার অধিকাংশের কাছে এ রকম বন্যা পরিস্থিতি একেবারেই নতুন। একটি পরিবার এতটাই ঘুমের ঘোরে ছিল যে জানালা পর্যন্ত পানি ওঠার আগমুহূর্ত পর্যন্ত নাকি টেরই পায়নি। পরবর্তী সময়ে আশপাশের প্রতিবেশীরা জানালা খুলে গিয়ে উদ্ধার করতে সক্ষম হন। যদিও এই বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ ছিলেন না। তাঁরা প্রবাসে।
রাজনগরের টেংরাবাজার পার হয়ে দেওয়ানদিঘির পার। ব্রিজ দিয়ে নদী পার হয়েই তারাপাশা বাজার। নদীর এপারে হরিপাশা বাজার। তারপর সায়েস্তা বাজার হয়ে পঞ্চানন্দপুর গ্রামে উপস্থিত হলাম। এখানে দুচোখ যেদিকে গেল, শুধু পানি আর পানি। গ্রামের রঞ্জিত দাশ, ইউনুস আলী ও হরিপদ দাশ গ্রামের প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বাড়ি বাড়ি আমাদের সহায়তার খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিতে সহযোগিতা করলেন। ৬১টি পরিবারের বসবাস এ পাড়ায়। অপরিচিত রঞ্জিত দাশ তো ২০০ পরিবারের বসবাসরত পুরো পশ্চিম পঞ্চানন্দপুর গ্রামে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিতে আমাদের সঙ্গেই থাকলেন। আমাদের বিদায় দিয়ে বাড়িতে ফিরেছিলেন।
পানির স্রোতের মধ্যেই এক পাড়া থেকে আরেক পাড়া বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাবার পৌঁছে দেওয়ার সময় আয়াত, নাফসিয়াদের মতো শিশুদের বানের জলে খেলার ছলে সাঁতার কাটার দৃশ্য চোখে পড়ল। চোখে পড়ল পাঁচ দিন পর সবকিছু ফেলে রেখে চলে গিয়ে আবার নিজ বাড়িতে ফেরা দুটি পরিবারকে। আমাদেরও ফেরার পালা। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেক পাড়ায় গিয়ে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার ইচ্ছাটা মনের মধ্যেই কবর দিয়ে রওনা দিলাম নিজ শহরের উদ্দেশে। তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার উপক্রম। পঞ্চানন্দপুরকে দেওয়া কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে নিজ শহর শ্রীমঙ্গলে এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে পুরো শহর নিয়ন আলোয় আলোকিত হয়ে গেছে।
**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]