কাঁচা কাঁঠালের বাণিজ্যিক সম্ভাবনার হাতছানি
পুষ্টিগুণে ভরপুর কাঁঠাল ফলের মধ্যে গুণের রাজা হিসেবে স্বীকৃত। কাঁঠালে আছে বেশি পরিমাণে আমিষ, শর্করা ও বিভিন্ন ভিটামিন, যা মানবদেহের জন্য বিশেষ প্রয়োজন। উপমহাদেশে ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভুটানের জনসাধারণ কাঁচা কাঁঠাল সারা বছর সবজি হিসেবে খেয়ে থাকে। ভারতের কেরালায় এক শ ধরনের কাঁচা কাঁঠালের খাদ্যসামগ্রী বিভিন্ন রেস্তোরাঁ ও ফুড সার্ভিস প্রতিষ্ঠানে বছরব্যাপী পাওয়া যায়।
আমাদের দেশে গাজীপুর, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, রাজশাহী, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, যশোর, খুলনা, সুনামগঞ্জ, পার্বত্য চট্টগ্রামে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কাঁঠাল উৎপন্ন হয়ে থাকে। ভরা মৌসুমে দেশের আনাচকানাচে সর্বত্রই রাস্তাঘাটে, ভ্যানে, রিকশায়, অটোরিকশা, টেম্পো, ট্রাক ও রাস্তার মোড়ে ও বাজারে ক্ষুদ্র চাষি, ব্যবসায়ী, আড়তদার, ব্যাপারী ও পাইকারি বিক্রেতাদের স্তূপ করে কাঁঠাল বিক্রি করতে দেখা যায়। চিত্রটি প্রায় প্রতিবছরই একই রকম। দামও খুব কম হওয়ায় হতাশাগ্রস্ত হৃদয়ে কাঁঠালচাষি ও উদ্যোক্তাদের কম মূল্যে বিক্রি করতে দেখা যায় বা বিক্রি করতে একরকম বাধ্য হয়ে থাকেন।
এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে প্রতিবছর কোটি টাকার ওপর কাঁঠালের অপচয় হয়ে থাকে। কৃষক তাঁর ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন বলে অনেক কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়। আরও লক্ষণীয় যে কৃষক সময়মতো বিক্রি করতে না পারা ও ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না হওয়ায় অনেকে কাঁঠালগাছ কেটে ফেলছেন এবং কাঁঠালবাগানের পরিবর্তে অন্য ফসল, বিশেষত উচ্চমূল্যের ফসল উৎপাদনের পরিকল্পনা করছেন। দেশের অধিকাংশ মানুষই কাঁঠাল বলতে পাকা কাঁঠালকে খাদ্য হিসেবে গণ্য করে থাকেন।
গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকার কৃষক, ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কাঁঠালকে শুধু পাকা ফল হিসেবে খাওয়ার কারণে এটি যখন পাকতে শুরু করে, তখন একসঙ্গে বেশির ভাগ কাঁঠালই পেকে যায়। ফলে সে সময় গাছ থেকে ৩০-৪০ ভাগ কাঁঠাল প্রাকৃতিকভাবে পড়ে যায়, যা খাওয়ার উপযোগী থাকে না। অর্থাৎ, প্রচুর কাঁঠাল এ ক্ষেত্রে নষ্ট হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে শুরুতেই কাঁচা কাঁঠালের ব্যবহার বাড়াতে এক-তৃতীয়াংশ বা অর্ধেক পরিমাণ কাঁঠালগাছ থেকে সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাতকরণ কাজে ব্যবহার করা হলে খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তায় যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, তেমনি কাঁঠালের অপচয় রোধেও সহায়তা করবে। এ ছাড়া কাঁঠাল উৎপাদনকারী কৃষক শুরুতেই বিক্রয় মূল্য বেশি পাবেন, যা ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতেও সহায়তা করবে। কাঁঠালকে বাণিজ্যিকীকরণের যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে এবং পরিচর্যা ও প্রক্রিয়াজাত করা খাদ্যসামগ্রী তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করা হলে একে সারা বছর খাবার টেবিলে পাওয়া যাবে।
কাঁচা কাঁঠালের বহুমুখী ব্যবহার বাড়াতে এবং অপচয় কমাতে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের (কেজিএফ) অর্থায়নে পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ ও নিউভিশন সলিউশনস লিমিটেড যৌথভাবে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পটির মাধ্যমে কাঁচা কাঁঠালের ফ্রেশকাট, ফ্রোজেন, আচার, রেডি-টু-কুক প্রডাক্টসহ অন্যান্য প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে এবং উদ্ভাবিত প্রযুক্তি উপকারভোগী ব্যক্তিদের মধ্যে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এতে করে অনেক কৃষক, কিষানি, উদ্যোক্তা বিশেষ করে কুটিরশিল্পপর্যায়ে উদ্যোক্তা তৈরি হতে শুরু করেছে এবং নারী উদ্যোক্তারা নিজ এলাকায়, ভ্যান, রিকশাযোগে সরাসরি কাঁচা কাঁঠালের ফ্রেশকাট পণ্য বিক্রয় করছেন। এ ছাড়া উদ্যোক্তাদের বিপণনে সহযোগিতা করায় তাঁরা সুপারমার্কেট, সুপারশপ ও বিভিন্ন ফুড ভেন্ডারদের কাছে কাঁচা কাঁঠালের তৈরি খাদ্যসামগ্রী বিক্রি করছেন। জনসচেতনতামূলক কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করার ফলে দিন দিন এর চাহিদাও বাড়ছে বলে উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে জানা যায়।
গবেষকেরা মনে করেন, কাঁঠালকে সঠিকভাবে কাঁচা থেকে ব্যবহার করা গেলে আমাদের দেশেই থাইল্যান্ড বা ভিয়েতনামের মতো কাঁঠালের চিপস, ভেজিটেবল মিট, ফ্রেশকাট, ফ্রোজেন, রেডি-টু-কুক, আচারসহ নানা রকম উৎকৃষ্ট মানের ও মুখরোচক খাদ্যসামগ্রী বছরজুড়েই অনায়াসে তৈরি করা যাবে। কাঁচা কাঁঠাল দিয়ে কাটলেট, ভেজিটেবল রোল, শিঙাড়া, সমুচা, পাঁপড় ইত্যাদি বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী তৈরি করা যায়। কাঁচা কাঁঠালের পাউডার বা আটা ঔষধ শিল্পে, শিশুখাদ্য ও ফর্টিফিকেশনের মাধ্যমে বিভিন্ন খাদ্যে মূল্য সংযোজন করে পুষ্টি উন্নয়ন এখন সময়ের দাবি। এ ছাড়া ভর্তা, মুগ ও ছোলা ডালে কাঁচা কাঁঠাল ব্যবহার করলে খাদ্যের গুণগতমান যেমন বাড়বে, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তাবিধানেও সহায়তা করবে নিঃসন্দেহে।
খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যমতে, বিশ্বে বছরে প্রায় ৩৭ লাখ টন কাঁঠাল উৎপাদিত হয়, যার অধিকাংশই উৎপাদিত হয় ভারতে (১৮ লাখ টন)। এর পরের অবস্থানে বাংলাদেশ (১০ লাখ টন)। পুষ্টি বিবেচনায় চীন, জাপান, মালয়েশিয়াসহ পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশই কাঁঠালকে প্রক্রিয়াজাতকরণ কাজে ব্যবহার করায় উৎপাদন চলমান রাখতে বিভিন্ন দেশ থেকে কাঁঠাল আমদানিও করছে। এ ক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট মানের ও সুনির্দিষ্ট জাত উদ্ভাবন এবং সঠিক পরিপক্বতা নির্বাচনের মাধ্যমে বিদেশে রপ্তানির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে, যা দেশের কৃষক ও উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করবে।
উপমহাদেশের কাঁঠালের মধ্যে পরিচিত জাতগুলো হলো গালা, খাজা ও দোরোসা বা রস খাজা। কাঁঠালকে জনপ্রিয় ও যথাযথ ব্যবহার বৃদ্ধির প্রয়াসে বিএআরআই এ পর্যন্ত ৩টি জাত বারি কাঁঠাল-১, বারি কাঁঠাল-২ ও বারি কাঁঠাল-৩ উদ্ভাবন করেছে।
দেশে উৎপাদিত কাঁঠালের খুব অল্প পরিমাণে বিদেশে রপ্তানি হয় এবং এর ক্রেতা অধিকাংশই প্রবাসী বাংলাদেশি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্যমতে, কাঁঠালের রপ্তানি আগের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে এবং এর রপ্তানি বৃদ্ধির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে, গত ২০১৯ ও ২০২০ সালে কাঁঠালের রপ্তানি ছিল প্রায় এক হাজার টন।
আমাদের দেশের কাঁঠালের মধ্যে হবিগঞ্জের বড় ও ভালো মানের কাঁঠাল ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে কাতার, ওমান, বাহরাইন, সৌদি আরব, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। উত্তম কৃষিচর্যা, উন্নত প্যাকেজিং প্রযুক্তি, সঠিক পরিপক্বতা নির্ধারণ, সুনির্দিষ্ট জাত নির্বাচন, প্যাকিং হাউজ সুবিধাসহ যথাযথ প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রযুক্তি প্রয়োগ করার মাধ্যমে জাতীয় ফল কাঁঠালকে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে রপ্তানি বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হবে, যা কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি যেমন নিশ্চিত করবে, তেমনি অধিক পুষ্টিসমৃদ্ধ কাঁঠালের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। সর্বোপরি খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তাবিধানসহ দেশের অর্থনীতিকে বেগবান করবে।
*লেখক: মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও খাদ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক গবেষক, পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, বিএআরআই, গাজীপুর
**নাগরিক সংবাদ লেখা, ছবি, ভ্রমণ অভিজ্ঞতা পাঠাতে পারেন আপনিও। ঠিকানা [email protected]