বন্ধুত্ব মানুষকে সুখী করে

বন্ধুত্বের হয় না তুলনাফাইল ছবি প্রথম আলো

পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্কের নাম বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব হলো মন ও আত্মার বন্ধন। পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সততা, সহমর্মিতা, সহযোগিতা, সমবেদনা, মনের অনুভূতি প্রকাশ, ভয়কে জয় করায় নির্ভরশীল সঙ্গী হলো বন্ধু। সমমনা ব্যক্তিরাই সফলভাবে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পারেন। মূলত বন্ধুত্ব হলো বিশ্বাস ও নির্ভরতার প্রতীক। বন্ধুত্বের স্থায়িত্ব সৎ ও মননশীল চিন্তার ওপর নির্ভরশীল। তাই বলা হয় একজন বন্ধু হলো ব্যক্তির আদর্শের মাপকাঠি। এই বন্ধুত্ব ব্যক্তি জীবনের যেকোনো পর্যায়ে গড়ে উঠতে পারে। সাধারণত একই বয়স, মানসিকতা, চিন্তাধারা এবং মেজাজের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সম্পর্কটি উদ্‌যাপন করতে প্রতিবছর আগস্ট মাসের প্রথম রোববার পালিত হয় বিশ্ব বন্ধুত্ব দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘জটিল বিশ্ব সংস্কৃতিতে বন্ধুদ্ধ শক্তিশালী হোক।’

বন্ধু দিবসের উৎপত্তি কখন, কীভাবে তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে ধারণা করা হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, ভয়াবহতা ও হিংস্রতা মানুষের মধ্যে অনেকটাই বন্ধুর অভাববোধ তৈরি করে। এ পরিপ্রেক্ষিতেই রাষ্ট্রীয়ভাবে বন্ধুত্ব দিবস পালন করার চিন্তা এসেছিল বলে অনেকে মনে করেন। এক সূত্রমতে, ১৯১৯ সালে আগস্টের প্রথম রোববার বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে কার্ড, ফুল ও নানা উপহার বিনিময় করত। এরপর ১৯৩০ সালে বিশ্বখ্যাত উপহারসামগ্রী ও কার্ড বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান হলমার্কের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জয়েস হল হলমার্ক কার্ড বন্ধুদিবস পালনের রীতিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়। তিনি প্রতিবছর ২ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রে বন্ধুত্ব দিবস উদ্‌যাপন শুরু করেন। এদিন মূলত কার্ড আদান-প্রদানের মাধ্যমে বন্ধুদিবস পালন করার রীতি শুরু হয়। অবশ্য তাঁর সে প্রচেষ্টা ততটা সফল হয়নি। কারণ, মানুষ বুঝতে শুরু করে যে এটা কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নয়, বরং হলমার্কের কার্ড ব্যবসা বাড়ানোর ফন্দি মাত্র। এরপর থেকে বন্ধুদিবস উদ্‌যাপন প্রায় বন্ধই হয়ে যায়। তবে জয়েস হলের উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্রে হালে পানি না পেলেও ইউরোপ এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে একসময় ধীরে ধীরে বন্ধুদিবস উদ্‌যাপনের রেওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ১৯৩৫ সালের আগস্ট মাসের প্রথম শনিবারে মার্কিন সরকার এক ব্যক্তিকে হত্যা করে। এর প্রতিবাদে ঠিক তার পরদিন রোববার মৃতব্যক্তির এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ঘোষণা দিয়ে আত্মহত্যা করে। এর পর থেকে জীবনের নানা ক্ষেত্রে বন্ধুদের অবদানের প্রতি সম্মান জানাতে মার্কিন কংগ্রেসে ১৯৩৫ সালে আগস্টের প্রথম রোববারকে বন্ধুদিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। মূলত তখন থেকেই সারা পৃথিবীতে বন্ধুত্ব দিবস ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

তবে এই দিবস উদ্‌যাপনের বিষয়টিকে মোড় ঘুরিয়ে দেন ‘ওয়ার্ল্ড ফ্রেন্ডশিপ ক্রুসেড’–এর প্রতিষ্ঠাতা প্যারাগুয়ের চিকিৎসক র‌্যামন আর্থেমিও ব্রেচ। তিনি ২০ জুলাই বন্ধুদের সঙ্গে উত্তর আমেরিকার প্যারাগুয়ের পুয়ের্তো পিনাসকোতে এক নৈশভোজের আয়োজন করেন। সে রাতেই এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা পায়। সংস্থাটি জাতি, বর্ণ, ধর্ম, ভাষা, লিঙ্গ–নির্বিশেষে নিঃস্বার্থ ও মানবদরদী বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য কাজ করে। এরপরই বিশ্বব্যাপী ধর্মবর্ণ–নির্বিশেষে বন্ধুত্ব, ঐক্য ও ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে গঠন করা হয় ‘বন্ধুত্ব ক্রুসেড’। ওয়ার্ল্ড ফ্রেন্ডশিপ ক্রুসেডের তরফ থেকে ১৯৫৮ সালের ৩০ জুলাই আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব দিবসের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। ১৯৫৮ সালের ৩০ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বব্যাপী বন্ধু দিবস পালনের জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব পাঠায়। প্রায় ৫৩ বছর পর ২০১১ সালের ২৭ জুলাই জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ৩০ জুলাইকে বিশ্ব বন্ধু দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। বন্ধু দিবসের তাৎপর্য হলো—ব্যক্তি, রাষ্ট্র, সংস্কৃতির মধ্যে বন্ধুত্ব শান্তিকে সুনিশ্চিত করবে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন জাতির মধ্যে সেতুবন্ধন ঘটাবে। এই উদ্দেশে আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব দিবসের সূচনা করা হয়।

বন্ধুত্বের সম্পর্ক চিরদিনের সম্পর্ক এবং মধুর সম্পর্ক। বন্ধুত্বের সম্পর্ক রক্তের সম্পর্ক নয় কিংবা কামনা-বাসনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বা পরিচালিত নয়। বন্ধুত্বের উৎসস্থল হলো হৃদয় এবং বন্ধুত্ব হৃদয়ের ভালোবাসা দিয়ে গড়া। তাই তো গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘একজনও বন্ধুর মতো বন্ধু থাকা পরম ভাগ্যের ব্যাপার।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিটি নতুন জিনিসকেই উৎকৃষ্ট মনে হয়। কিন্তু বন্ধুত্ব যতই পুরোনো হয়, ততই উৎকৃষ্ট ও দৃঢ় হয়।’ ফ্রান্সিস বেকন বলেছেন, ‘ভালোবাসা হলো লাল গোলাপের মতো; কিন্তু বন্ধুত্ব হচ্ছে ছায়াময়ী বৃক্ষের মতোই জীবনের প্রতিদিনের প্রয়োজন এবং বাস্তবতার মধ্যেই তার সরল বিচরণ।’ কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন ‘অনাত্মীয়কে আমরা ঢাকঢোল পিটিয়ে সাদরে গ্রহণ করি; কিন্তু বন্ধুকে হৃদয় দিয়ে এবং হৃদয়ের হাসি দিয়ে বরণ করি।’ কেউ কেউ বন্ধুত্বকে সোনালি সুতার সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, ‘বন্ধুত্ব হচ্ছে সোনালি সুতো, যা হৃদয়কে একসূত্রে গেঁথে দেয়।’

আরও পড়ুন

জীবন চলার পথে ভালো বন্ধু থাকাটা জরুরি। তবে বন্ধু তৈরি করা কঠিন এবং সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। গবেষণায় দেখা গেছে, নতুন পরিচিতি তৈরি করতে কয়েক ডজন ঘণ্টা সময় একে অপরের সঙ্গে কাটানো প্রয়োজন। আর ভালো বন্ধুত্বের জন্য প্রয়োজন কয়েক শ ঘণ্টা। যে সময় একটা নতুন বন্ধুত্বে দেওয়া প্রয়োজন, তা আসলেই অনেক সময় এবং ধৈর্যের ব্যাপার। ওয়ার্ল্ড হেপিনেস ডেটাবেস গবেষণায় দেখা যায় বন্ধুত্বের কারণে মানুষ সুখী হয়। আসলে জীবনে পরিবারের পরেই বন্ধুত্বের অবস্থান। মাঝেমধ্যে পরিবারকেও ছাপিয়ে যায় বন্ধুত্ব। বন্ধু মানে নিছক আড্ডার সঙ্গী নয়, বরং বন্ধুর খুশিতে খুশি হওয়া, বন্ধুর দুঃখের সঙ্গী হওয়া। বন্ধুর বন্ধুর পথে পথচলার চালিকাশক্তি হওয়া। বন্ধুকে সফলতার পথে এগিয়ে দেওয়া। বন্ধুত্ব জীবন দেয় ও বাঁচিয়ে রাখে। এ প্রসঙ্গে যিশুখ্রিষ্ট বলেছেন, ‘বন্ধুত্বের জন্যে প্রাণ দেওয়ার চেয়ে বড় ভালোবাসা মানুষের আর কিছু নেই।’ তিনি বন্ধু বলতে মানুষকে বুঝিয়েছেন।

প্রথম প্রেমের গল্প, মন ভাঙার গল্প, এ সবই নিজের বন্ধুর সঙ্গেই শেয়ার করে থাকি। এমনকি মন খারাপ হলে রাতে গল্প করার জন্য বন্ধুকেই বিরক্ত করি। অনেক না-বলা কথাই আমাদের বন্ধু জানতে পেরে যায়। শৈশবে স্কুল ছুটি হলে গাঁয়ের বন্ধুরা মিলে দল বেঁধে নদীতে ঝাঁপাঝাঁপি, বিকেল হলে ফুটবল, হাডুডু, কানামাছি আর গোল্লাছুট খেলায় কাটিয়েছি। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে ক্যাম্পাস কিংবা করিডোরগুলোকে প্রতিদিনই মুখরিত করে রেখেছি নানা গুঞ্জনে। আজ আধুনিকতার কারণে অনেকেই হারাতে বসেছি প্রকৃত বন্ধুদের। বন্ধুত্ব এখন আটকে আছে কতিপয় অ্যাপসে। আধুনিক যুগে বন্ধুত্ব ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে দূর তেপান্তরে। গোটা বিশ্ব হাতের মুঠোয় চলে এসেছে প্রযুক্তির কল্যাণে। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে মানুষ যোগাযোগ রাখতে পারছে বন্ধুর সঙ্গে। ফলে বন্ধুত্বের পরিধি আজ বিশ্বময়। যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুত্বের ধরন পাল্টে গিয়েছে বহুলাংশে।

বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে মানুষ আস্তে আস্তে একা হয়ে পড়ছে। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে বর্তমান পূরুষদের মধ্যে ৮৬ শতাংশের বেশি এবং ৬১ শতাংশের বেশি নারীর নিজস্ব মুঠোফোন রয়েছে। এ ছাড়া স্মার্টফোন ব্যবহার করে ৬৩ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ। সেই হিসাবে ৬১ শতাংশ পুরুষের বিপরীতে ৩৪ শতাংশ নারী স্মার্টফোন ব্যবহার করে। এদিকে গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। দেশে ফোনের ব্যাবহার যত বেড়েছে, ততই বেড়েছে মানুষের দূরত্ব। মানুষ দিন দিন একা হয়ে পড়ছে; নিজের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলছে। দেখা যায় বন্ধুরা একসঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়েও নিজ নিজ মুঠোফোনে ব্যস্ত। কেউ কেউ হয়তো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু দেখছে, কেউ গেম খেলছে, আবার কেউ হয়তো কারও সঙ্গে টেক্সট করছে। ফলে আড্ডার মুখ্য উদ্দেশ্য, যা পারস্পরিক সম্পর্ক মজবুত করা বা একসঙ্গে কিছু সময় কাটানো, সেটা ব্যাহত হয়। তাই একসঙ্গে থাকলেও যেন সবাই আলাদা। এক গবেষণায় বলা হয় ভারত ও বাংলাদেশে মুঠোফোনের ব্যবহার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। যুক্তরাজ্যের জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশটির ২৪ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তীব্র একাকিত্ব সমস্যায় ভুগছে। এসব সমস্যার একমাত্র ওষুধ সমবয়সী বন্ধু খুঁজে পাওয়া। তবে সোশ্যাল মিডিয়া পুরোনো বন্ধুদের ধরে রাখতে সহায়তা করলেও সম্পর্ক বেশ হালকা অবস্থায় থাকে। এ ক্ষেত্রে বেশ ভালো সম্পর্কের জন্য কথাবার্তা বলা জরুরি। সেটা হতে পারে সরাসরি কিংবা ফোনে।

একজন ভালো বন্ধু আজীবনের সম্পদ। গবেষণা বলছে, একজন ভালো বন্ধু থাকা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। বন্ধু কখনো পুরোনো হয় না। বন্ধুত্ব সে তো চিরদিনের এবং সে তো চিরঞ্জীব। আজ বন্ধু দিবস স্মরণ করিয়ে দেয়, দূরের বন্ধু, কাছের বন্ধু, দেখা বন্ধু, অদেখা বন্ধু ও ভুলে যাওয়া বন্ধুদের। বন্ধু দিবসে আহ্বান জানাই, বন্ধুত্বের বন্ধন দিয়ে সবাইকে কাছে টানার এবং সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার। ভালো থাকুক সব বন্ধুরা।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও প্রধান, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর

‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]