নিরাপদে বাড়ি ফেরা ও আনন্দের ঈদ
ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানেই উচ্ছ্বাস। এই আনন্দ তখনই পূর্ণতা লাভ করে, যখন পরিবারের সবাই মিলিত হয়ে ঈদ উদ্যাপন করার সুযোগ মেলে। তাই বলা হয়, ঈদ মানেই বাড়ি ফেরা।
স্বাধীনতার পর থেকে দেশে দ্রুতগতিতে নগরায়ণ ও শিল্পায়নের বিকাশ ঘটেছে। বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যার ৩১ দশমিক ৬৬ শতাংশ নগরে বাস করে। জনবিজ্ঞানীদের ধারণা, ২০৩০ সাল নাগাদ দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৪৫ শতাংশ নগরে বসবাস করবে। নগরগুলো আজ শিল্পায়নসহ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কর্মসংস্থানের আশায় মানুষ নগরে পাড়ি জমায়। সংগত কারণে প্রতিবছর ঈদকে কেন্দ্র করে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী দেশের প্রান্তিক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ঈদের ছুটিতে নিরাপদে বাড়িতে ফেরা এ দেশের মানুষের কাছে অনেকটা নিয়ম বা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীরা বিষয়টাকে বাড়ি ফেরার সংস্কৃতি বলতে আগ্রহী।
বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় ২৩ শতাংশ মুসলিম। আর বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯৩ শতাংশ মুসলিম। বাংলাদেশের মতো বিশ্বের অন্য মুসলিম দেশগুলো ও ব্যাপক উৎসাহ ও ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে ঈদ উদ্যাপন করে। এর মধ্যে একটি বিশেষ ঐতিহ্য হলো ঈদে বাড়ি ফেরা। জানা যায়, ইন্দোনেশিয়ার বেশির ভাগ মুসলিমই পরিবারও বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঈদ উদ্যাপন করতে শহর ছেড়ে গ্রামে পাড়ি জমায়। এক তথ্যমতে, এবার ঈদ উপলক্ষে ইন্দোনেশিয়ার প্রায় ৯ কোটি মানুষ কর্মস্থল থেকে গ্রামের বাড়িতে যাবেন। কর্মের সুযোগসহ অন্যান্য সুবিধার কারণে দেশের মোট জনসংখ্যার ২৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ ঢাকা বিভাগে বসবাস করে। ঈদে ঠিক কত মানুষ ঢাকা ছাড়েন, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে কমপক্ষে অর্ধেক নগরবাসী যে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে যান, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ঈদযাত্রার মাত্র ৩ থেকে ৪ দিনে ১ কোটি ৭০ লাখ জনসংখ্যার ঢাকা শহর থেকে ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ বাড়ি ফেরেন। সে হিসাবে ঈদ মৌসুমে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ বাড়ি ফেরেন। উল্লেখ্য, প্রতিদিন ঢাকা থেকে দেশের সব জেলায় চলাচলকারী যানবাহনের যাত্রী ধারণক্ষমতা রয়েছে ২২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ বাস-মিনিবাসে, ১ লাখ ৫ হাজার মানুষ রেলে, ১ লাখ ২৫ হাজার লঞ্চে, ৩ লাখ মোটরবাইকে এবং ৩ লাখ ব্যক্তিগত গাড়িতে বাড়ি যান। অর্থাৎ দেশের বেশির ভাগ যাত্রী সড়কপথে বাড়িতে যান এবং ফিরেও আসেন এই সড়কপথেই।
ঈদ-পার্বণে বাড়ি ছুটে যাওয়া, এটা দেশের মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ঈদ করার জন্য সবাই বাড়ি ফেরেন। চোখে–মুখে খেলা করে অন্য রকম দ্যুতি! কী সেই অমোঘ টান, যার জন্য মানুষ হাজারো কষ্ট স্বীকার করে বাড়ি ফেরেন? যানবাহনে কোথাও পা ফেলার জায়গা নেই, তবু কারও মধ্যে যেন এতটুকু বিরক্তি নেই। সবাই নিজে এবং চেনা-অচেনা মানুষদের সঙ্গে ফেরে আপন নিবাসে।
ঈদ কেবল মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবই নয়, আনন্দ-বিনোদন ও মিলনমেলাও। প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ করা, কারও মা–বাবার প্রতি টান, কারও পূর্বপুরুষের ফেলে যাওয়া বসতভিটার প্রতি অনুরাগ, কেউ সন্তানকে তাঁর শিকড়ের সঙ্গে সংযোগ করিয়ে দিতে চান। কেউ কেউ চান পরিবার ও আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া–প্রতিবেশী সবার সঙ্গে দেখা ও কুশল বিনিময় করতে। পারিবারিক বন্ধন বা সংহতি বজায় রাখার তাগিদও অনেকের মধ্যে লক্ষ করা যায়। এমন অসংখ্য কারণ নগরবাসীকে তাঁদের নিজ গ্রামের বাড়িতে টেনে নিয়ে যায়। এই ফিরে যাওয়ায় অনেক সময় প্রেরণা হয়ে থাকে গ্রামের দিগন্তজোড়া সবুজ মাঠ, খেলার মাঠ, স্কুল বা কলেজ প্রাঙ্গণ, পুকুরপাড়, বন্ধুদের সঙ্গে চায়ের আড্ডা, সবাই মিলে খেলাধুলা, গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীটি। যে খালে গোসল করতেন ছোটবেলায়, যে বটগাছের কাছে গিয়ে আশ্রয় মিলত রোদ-বৃষ্টিতে, সবই মনের মধ্যে কোথায় যেন লুকিয়ে থাকে।
ঈদ পর্বের সঙ্গে ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কিছু বিষয় জড়িত থাকে। যেমন অনেকেই ঈদের দিন সকালে ঈদগাহ মাঠে নামাজ আদায়ের পরপরই চলে যান মৃত মা-বাবা বা দাদা–দাদি, নানা–নানির কবর জিয়ারত করতে। জানা যায়, প্রাচীনকালে যাযাবর মানুষের স্থায়ী আবাস গঠনে সহায়তা করেছে এই কবর। তাই নগরে অনেকের স্থায়ী আবাস হলেও অন্তত মা–বাবাসহ অন্য নিকট আত্মীয়স্বজনের কবরের টানেও তাঁকে ফিরে যেতে হয়। সারা বছর না গেলেও অন্তত ঈদের ছুটিতে যাওয়ার সুযোগ কেউ হাতছাড়া করতে চান না। ঈদে বাড়ি ফেরার এটিও একটি কারণ।
গ্রামে ফেরার অন্যতম সুফল হচ্ছে গ্রাম-নগরের মেলবন্ধন। স্বল্প সময়ের মেলামেশায় যেটুকু ভাবের আদান-প্রদান ঘটে, তা আত্মিক উন্নয়নে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখে। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর যোগাযোগব্যবস্থার বিকাশ এমনিতেই নগর ও গ্রামের মধ্যকার দূরত্ব অনেকখানি কমিয়ে দিয়েছে। ঈদ উপলক্ষে বাড়ি ফেরা এ ধারাকে আরও এগিয়ে নিতে পারে। যান্ত্রিকতার এই যুগে ভাইবোনের সন্তান-সন্ততিরা অনেকেই একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারে না। ফলে ঈদের সময় বাড়িতে গিয়ে তারা সবাই মিলিত হয়। একে অন্যের সঙ্গে কুশল, মুঠোফোনের নম্বর বিনিময় করে। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ওয়াটসঅ্যাপ, টুইটারে একে অন্যের বন্ধু হয়। এভাবে পরবর্তী প্রজন্মের উভয়ের মধ্যে মেলবন্ধন স্থাপিত হয়। এমন ঘটনা এখন সব পরিবারেই দেখা যায়। সেদিক বিবেচনায় ঈদ সবার কাছে একটা সম্মিলনের উৎসব। এ ছাড়া ঈদ উৎসবের মধ্যে নানা পারিবারিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডও সম্পন্ন হয়। যেমন অনেক সময় আত্মীয়স্বজনের মধ্যে নানা বিষয়ে ভুল-বোঝাবুঝি বা মনোমালিন্য হতে পারে। ঈদ এসব পারিবারিক বিবাদ বা ঝামেলা নিরসনের একটা সুযোগ করে দেয়। আবার জমিজমাসংক্রান্ত নানান জটিলতা বা পারিবারিক অন্যান্য সমস্যার বিষয়ে এ সময় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ইদানীং বিয়ে, খতনা, আকিকা, জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী ইত্যাদি অনুষ্ঠান ঈদের মৌসুমে গ্রামের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। কারণ, বছরের এই সময়ে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা পরিবারের সব সদস্য বাড়িতে ফিরে আসে। ফলে এ ধরনের অনুষ্ঠানের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। ঈদ উৎসব যেন সব উৎসবকে ছাপিয়ে যায়। মিলনমেলায় রূপান্তরিত এ উৎসবে দৃঢ় হয় পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন।
ইদানীং স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের ঈদের সময় বাড়িতে এসে পুনর্মিলনীর আয়োজন করতে দেখা যায়। অনেক সময় একই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ব্যাচভিত্তিক পুনর্মিলনী চোখে পড়ে। সাধারণত ঈদের পরের দিন এ রকম আয়োজন অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। এ ধরনের পুনর্মিলনী ঈদের আনন্দের মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। ফলে নতুন প্রজন্মের সদস্যরা গ্রামের বাড়িতে আসার একধরনের তাগিদ অনুভব করে। ঈদ আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক সমাজের সব বয়স, পেশা ও শ্রেণির মানুষের মধ্যে, ঈদযাত্রা হোক নিরাপদ।
*লেখক: সমাজ–গবেষক ও শিক্ষক, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর
‘নাগরিক সংবাদ’-এ নানা সমস্যা, জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]