১২ বছরে ১৯ হাজার মানুষকে ফার্স্ট রেসপন্স ট্রেনিং দিয়েছেন শামসুন্নাহার
হার্ট অ্যাটাক হলে কিংবা পানিতে ডুবে গেলে যদি কাউকে উদ্ধার করা হয়, তার পরবর্তী প্রাথমিক চিকিৎসা হলো কার্ডিও পালমুনারি রিসাসিটেশন (সিপিআর)। ২০১০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জ-শহরের বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণি–পেশার ১৯ হাজারেরও বেশি মানুষকে এ সিপিআরের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন শামসুন্নাহার। সবার কাছে তিনি পরিচিত নাহার আপা হিসেবে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়েননি তিনি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। কিন্তু মানুষের জীবন বাঁচানোর এ প্রশিক্ষক হতে তা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
ছয় বোন আর তিন ভাইয়ের মধ্যে চতুর্থ শামসুন্নাহারকে এ পথে যেতে বাধা দিয়েছেন পরিবারের সবাই। কেবল সাহস জুগিয়েছেন তাঁর চাচা, যাঁর কাছে তিনি বড় হয়েছেন। তাঁরই অনুপ্রেরণায় ২০০৮ সালে প্রথম সিপিআরের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নেন। তখনো জানতেন না, এ প্রশিক্ষণই তাঁর জীবনের ব্রত হয়ে যাবে একদিন। যুক্তরাজ্যভিত্তিক দাতা সংস্থা রয়্যাল লাইফবোট ইনস্টিটিউশনের প্রশিক্ষকের কাছ থেকে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ নেন ফার্স্ট রেসপন্ডার ট্রেইনার হওয়ার। এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। চিকিৎসাবিজ্ঞানের জটিল ইংরেজির বদলে সাধারণ মানুষের বোধগম্য হয়—এমন সাবলীল বাংলায় তিনি আয়ত্ত করেন পুরো সিপিআর দেওয়ার কৌশল। তিনি বলেন, ‘আমি দেখতাম, সাধারণ মানুষ “সিপিআর” বা “কার্ডিও পালমুনারি রিসাসিটেশন” বললে ভড়কে যায়। শেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। প্রশিক্ষক আর আমার প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের সঙ্গে আলোচনা করে দেখলাম, পুরো সিপিআর পদ্ধতিকে যদি আমি “মুখে শ্বাস বুকে চাপ” বলি, তাহলে সহজে বোঝা যায় আর মানুষের মনে রাখাও সহজ হয়। প্রথম দিকে আমার সঙ্গে প্রশিক্ষক হিসেবে যে পেশাদার নার্স বা ডাক্তাররা ছিলেন, তাঁরাও বিষয়টা ভালোভাবে নিতে পারেননি। কিন্তু একসময় তাঁরাও দেখলেন, এটা বললেই বরং সবাইকে সহজে বোঝানো যাচ্ছে।
বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৬৩টিতে ঘুরে মানুষকে এই ‘মুখে শ্বাস বুকে চাপ’–এর প্রশিক্ষণ দিয়েছেন নাহার। কৃষক, জেলে, শ্রমিক, গৃহিণী, ছাত্র, শিক্ষক থেকে শুরু করে নার্স, এমনকি চিকিৎসকদেরও প্রশিক্ষক হয়েছেন নাহার। ঢাকার নামীদামি ১৪টি স্কুলের তিন শতাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি। তিনি জানান, মানুষের জীবন বাঁচানোর এ পদ্ধতি শিখতে লেখাপড়া জানার দরকার নেই। মোটামুটি সাত বছর বয়স থেকে শুরু করে যেকোনো বয়সের মানুষই শিখে নিতে পারে এ পদ্ধতি। যখন মানুষের হার্ট অ্যাটাক হয় কিংবা পানিতে ডুবে যাওয়ার পর উদ্ধার করা হয়, তখন সামনে থাকা লোকজনই পারে তার জীবন বাঁচাতে আর তা এই ‘সিপিআর’ বা ‘মুখে শ্বাস বুকে চাপ’ পদ্ধতিতে। হাসপাতাল বা ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়ার আগপর্যন্তে এটাই একমাত্র চিকিৎসা।
প্রশিক্ষকজীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত কী, তা জানতে চাইলে নাহার জানান, ঢাকার অদূরে মাওয়া ফেরিঘাটে একদিন এক মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচাতে পেরেছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে গ্রাম থেকে ঢাকা ফেরার সময় কাঁঠালবাড়ি থেকে মাওয়া আসছিলেন স্পিডবোটে। মাঝনদীতে দেখতে পান, আরেকটি স্পিডবোট দাঁড়িয়ে আছে, আর যাত্রীরা উদ্ভ্রান্ত। তিনি দেখেন মধ্যবয়স্ক একজন ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে আছেন। তিনি জলদি স্পিড বোট তীরে আনতে বলেন, আর অসুস্থ লোকটির আত্মীয়দের অনুমতি নিয়ে তাঁকে সিপিআর দিতে শুরু করেন। ঘাট থেকে ঢাকার পান্থপথের একটি হাসপাতালে আসা পর্যন্ত তাঁকে অনবরত সিপিআর দিতে থাকেন নাহার। শেষ পর্যন্ত সেই ব্যক্তিকে বাঁচাতে সক্ষম হন তিনি। নাহার বলেন, সেদিন হাসপাতালের ডাক্তাররাও বলছিলেন, ঠিক সময় সিপিআর দেওয়া না হলে মারা যেতে পারতেন লোকটি বা জীবনের তরে চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলতে পারতেন তিনি।
সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশের সঙ্গে ২০০৬ সাল থেকে যুক্ত শামসুন্নাহার। এ প্রতিষ্ঠান থেকেই তাঁর ফার্স্ট রেসপন্ডিং ট্রেইনারের যাত্রা শুরু। তিনি বলেন, ডেটা কালেক্টর হিসেবে চাকরিজীবন শুরু করেছিলাম। কাজের অংশ হিসেবে ফার্স্ট রেসপন্ডার ট্রেনিং নিতে হয়েছিল। কিন্তু সেই এক ট্রেনিংই যে এভাবে ক্যারিয়ারের অংশ হয়ে যাবে, তা প্রথমে ভাবিনি। জীবনের লক্ষ্য কী, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, মানুষের জীবন বাঁচানোর এই ‘মুখে শ্বাস বুকে চাপ’ কৌশল তিনি আজীবন মানুষকে শেখাতে চান।