পুঁজিবাদের মাশুল: জলবায়ুর পরিবর্তন

১.

ডগলাস রাশকফ নিউইয়র্কের বাসিন্দা। সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের অধ্যাপক। অধ্যাপনার বিষয় মিডিয়া তত্ত্ব এবং ডিজিটাল অর্থনীতি। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তিনি। সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের ল্যাবরেটরি ফর ডিজিটাল হিউম্যানিজমের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ইনস্টিটিউট ফর দ্য ফিউচারের একজন রিসার্চ ফেলো এবং বিশ্বব্যাপী মিডিয়া, প্রযুক্তি, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতির বিষয়ে বক্তৃতা দেন। মানুষের জীবনে ডিজিটাল প্রযুক্তির কী প্রভাব পড়ছে এবং পড়তে চলেছে—এটাই তাঁর দীর্ঘদিনের চর্চা ও অনুসন্ধানের বিষয়। অধ্যাপনার পাশাপাশি এ বিষয়ে বিভিন্ন কোম্পানি বা সংগঠনের উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেন। অনেকগুলো বহুল প্রচারিত এবং পুরস্কৃত বই লিখেছেন। ‘টিম হিউম্যান’ নামে একটি পডকাস্টও চালান তিনি। ২০১২ সালে এমআইটি টেকনোলজি রিভিউ প্রণীত বিশ্বের প্রথম ১০ জন ‘প্রভাবশালী ব্যক্তি’র তালিকায় তিনি ছিলেন ৬ নম্বরে।

বছর কয়েক আগে যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচজন অতিবৃহৎ ব্যবসায়ী তাঁর মুখোমুখি বসে কিছু পরামর্শ নেওয়ার জন্য তাঁকে আমন্ত্রণ জানালেন। ডিজিটাল দুনিয়ার গতিপ্রকৃতি এবং ব্যবসায়িক সম্ভাবনার বিষয়ে নিয়ে হয়তো তাঁরা আলোচনা করবেন, এমনটাই বুঝেছিলেন ডগলাস। অত্যাধুনিক কনভেনশন সেন্টারের সভাকক্ষে যথাসময়ে বসানো হলো তাঁকে, শ্রোতাদের সামনে। অল্পক্ষণের মধ্যেই বোঝা গেল, প্রযুক্তির বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞের নিজের বক্তব্য শোনার তাগিদ তাঁদের নেই। বরং তাঁদের উদ্দেশ্য ভিন্ন। তাঁরা নিজেদের প্রশ্নমালা নিয়েই এসেছেন, তার উত্তর জানতে চান। প্রথম দিকে প্রশ্নগুলোর ধরন ছিল এ রকম। যেমন বিটকয়েন, না এথেরিয়াম? ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি, না অগমেন্টেড রিয়েলিটি? কোয়ান্টাম কম্পিউটারের দুনিয়ায় কে এক নম্বর হবে, গুগল না চায়না? কিন্তু ডগলাসের মনে হচ্ছিল এগুলো জানা তাঁদের মূল উদ্দেশ্য নয়, তাঁরা আসলে অন্য কিছু জানতে চান।

এবার বের হলো তাঁদের  প্রকৃত প্রশ্নমালা। প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটি ছিল ‘নিউজিল্যান্ড, না আলাস্কা? জলবায়ু সংকটের ফলে বিপর্যয়ের ধাক্কা কোথায় সবচেয়ে কম লাগবে?’ বিপর্যয় ঘটার পর বাইরের পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে বেঁচে থাকার জন্য (ভূগর্ভস্থ বাংকারে বা অন্য আশ্রয়স্থলে) কত দিনের রসদ তৈরি রাখতে হবে? নিজস্ব বাতাস সরবরাহের আয়োজন রাখতে হবে কি? পানি বিষাক্ত হওয়ার আশঙ্কা কতটা? অবশেষে একটি ব্রোকারেজ কোম্পানির কর্ণধার জানালেন, তিনি মাটির নিচে নিজস্ব বাংকারের গোটা ব্যবস্থা প্রায় তৈরি করে ফেলেছেন, কিন্তু তাঁর প্রশ্ন হচ্ছে, ‘ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার পরে আমার নিরাপত্তারক্ষীদের ওপরে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখব কী করে?’

বৈঠক শেষে নিউইয়র্কে ফিরেই ডগলাস রাশকফ এই অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি লেখা পোস্ট করেন। এরপরই ক্রমাগত নানা মাপের কোটিপতিদের অনুরোধ-বার্তা পেতে থাকেন—ওই পাঁচজনের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া যায় কি? তাঁরা তৈরি থাকতে চান, যাতে ‘ঘটনাটা’ ঘটলে আত্মরক্ষা করা যায়। কেউ কেউ আবার সম্ভাবনা দেখে বাংকার তৈরি করার ব্যবসায় নেমেছেন। অনেকেই যথেষ্ট বিনিয়োগ করার লোক পাচ্ছেন না, ডগলাস কি সে ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবেন?

রাশকফ তাঁর ওপরের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন তাঁর সর্বশেষ প্রকাশিত বই ‘সারভাইভাল অব দ্য রিচেস্ট’ অর্থাৎ ধনকুবেরদের বেঁচে থাকা নামক বইটিতে। বইটি ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়েছে।

উপরিউক্ত অভিজ্ঞতা থেকে যে বিষয়টা রাশকফের উপলব্ধি হলো, সেটা ‘মাইন্ডসেট’ বা মানসিকতা। যাঁরা অতিধনী এবং ধনকুবেদের সাম্রাজ্যে বড় বড় আসনে অধিষ্ঠিত, তাঁদের এক বিরাট অংশের মানসিকতা। তাঁরা ভালো করেই জানেন, ক্রমাগত এই সাম্রাজ্য বিস্তারের কারণে পৃথিবী আর তার মানুষের জীবনে সংকট প্রতিনিয়ত গভীরতর হয়ে উঠছে। বিপর্যয় শিয়রে সমাসন্ন। কিন্তু তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার থামছে না। তাঁদের ব্রেক কষা চলবে না, ফেরার তো কোনো প্রশ্নই নেই। তাঁরা বুঝতে পারছেন, বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী, তাই আত্মরক্ষার এত আয়োজন। স্থলে, জলে, অন্তরিক্ষে দুর্ভেদ্য আশ্রয় নির্মাণের রকমারি প্রকল্পের চিন্তায় তাই লগ্নি। যে যত বড় ধনী, তার লগ্নির ক্ষমতা তত বেশি, তার প্রকল্প তত জোরদার। রাশকফ এ প্রবণতার নাম দিয়েছেন ‘ইনসুলেসন ইকুয়েশন।’ কেউ যদি এ রকম মনে করেন যে আমি x কাজ করে যদি এই রকম যথেষ্ট পরিমাণ টাকা কামাই যা দ্বারা x–এর কারণে সৃষ্ট ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখতে পারব তাহলেই তিনি ‘ইনসুলেসন ইকুয়েশন’–এর কথা বিবেচনা করছেন। কিন্তু x–এর কারণে সৃষ্ট ক্ষতিকর প্রভাব কীভাবে বন্ধ বা কমানো যায়, সে ব্যাপারে তার সে রকম কোনো আগ্রহ নেই।

২.

শিল্পবিপ্লবের পর থেকে কিংবা তার ও আগে থেকে মানুষ যখন কলকারখানা এবং যানবাহন চালাতে বা শীতে ঘর গরম রাখতে তেল, গ্যাস এবং কয়লা পোড়াতে শুরু করল, সেই সময়ের তুলনায় পৃথিবীর তাপমাত্রা এখন ১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। বায়ুমণ্ডলে অন্যতম একটি গ্রিনহাউস গ্যাস কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ঊনবিংশ শতাব্দীর তুলনায় ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে।। গত দুই দশকে বেড়েছে ১২ শতাংশ।

জাতিসংঘের জলবায়ুর পরিবর্তন–সংক্রান্ত আন্তসরকার কমিটি বা আইপিসিসির ২০২১ সালের এক গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্টে মূল যে বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে, তা হচ্ছে:

• ২০১১-২০২০ এই এক দশক মেয়াদকালে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ১৮৫০-১৯০০ এই মেয়াদকালের চেয়ে ১.০৯ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছে।

• ১৮৫০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত থাকা রেকর্ড অনুযায়ী গত পাঁচ বছর ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে উষ্ণতম।

• ১৯০১-১৯৭১ এই মেয়াদকালের সঙ্গে তুলনায় সমুদ্রের পানির স্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির সাম্প্রতিক হার প্রায় তিন গুণ বেড়েছে।

• ১৯৯০–এর দশক থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী হিমবাহগুলো গলে যাওয়া এবং আর্কটিকে সামুদ্রিক বরফস্তর কমে যাওয়া—এ দুটির পেছনে মানুষের কর্মকাণ্ডই যে দায়ী, এমন সম্ভাবনা খুবই জোরালো (৯০ শতাংশ)।

• এটা এখন ‘প্রায় নিশ্চিত যে ১৯৫০–এর দশকের পর থেকে অতিরিক্ত গরম পড়া এবং তাপপ্রবাহ অনেক বেশি ঘন ঘন ঘটছে। অন্যদিকে ঠান্ডা পড়ার তীব্রতা কমে যাচ্ছে এবং তা ততটা ঘন ঘন হচ্ছে না।

রিপোর্টে জাতিসংঘের বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষের কর্মকাণ্ড পরিবেশের ওপর যে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে, তা মানবসমাজের জন্য একটি ‘লালসংকেত’। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, জলবায়ুর এ পরিবর্তন এত দ্রুত হারে এখন ঘটছে যে অনেক প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। যেমন বরফ গলতে থাকায় পোলার বিয়ার বা উত্তর মেরুর শ্বেতভালুকের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ছে পাশাপাশি, আটলান্টিক মহাসাগরের স্যামন মাছ বিপন্ন হবে, কারণ যেসব নদীতে ঢুকে তারা ডিম পেড়ে বাচ্চার জন্ম দেয়, সেগুলোর পানি গরম হয়ে যাচ্ছে। ট্রপিক্যাল অঞ্চলের কোরাল রিফ বা প্রবালপ্রাচীর উধাও হয়ে যেতে পারে, কারণ বায়ুমণ্ডলের অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড সাগরের পানিতে মিশে পানির অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।

৩.

নাওমি ক্লাইন একজন কানাডিয়ান সাংবাদিক, কলামিস্ট ও লেখক। তিনি ‘দ্য নেশন’ পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখক। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য আরও যেসব প্রকাশনায় তিনি লেখেন, তা হলো ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’, ‘দ্য লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস’, ‘দ্য গ্লোব অ্যান্ড মেইল’, ‘এল পাস’, ‘লাস্প্রেসো’ এবং ‘দ্য নিউ স্টেটসম্যান’। সাংবাদিকতায় অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কার তিনি পেয়েছেন। কানাডার ইউনিভার্সিটি অব কিংস কলেজের সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব সিভিল ল’ পাওয়া ক্লাইনের বেশ কয়েকটি বিখ্যাত বই রয়েছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে, ২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘দিস চেঞ্জেস এভরিথিং: ক্যাপিটালিজম ভার্সেস দ্য ক্লাইমেট।’

নাওমি ক্লাইন এ বইয়ে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সংকট জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য চলমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে দায়ী করেছেন। তাঁর মতে, জলবায়ু পরিবর্তনকে মোকাবিলা করতে হলে মুক্তবাজার অর্থনীতির আদর্শকে পরিত্যাগ করে বৈশ্বিক অর্থনীতিকে পুনর্বিন্যাস করতে হবে। সেই সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করতে হবে। তিনি মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তন একটি মহাবিপৎসংকেতের ডাক।

তাঁর মতে, বাজারব্যবস্থা জলবায়ু সংকটের সমাধান করতে পারেনি এবং পারবে না; বরং আরও খারাপ অবস্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পুঁজিবাদের মাধ্যমে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিবেশ ও জলবায়ুর ধ্বংসসাধন করতে থাকবে। আমরা প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার মোহে, শর্ত সাপেক্ষে জলবায়ু ও পরিবেশ সংকটের সমাধান করতে চেয়েছি। যার ফলে কোনো সমাধান আসেনি।

রাশকফের মতো ক্লাইনও ধনীদের একধরনের মানসিকতার কথা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। আর সেটি হচ্ছে অস্বীকারের মানসিকতা। বইয়ের একটা অংশে দক্ষিণপন্থী ধনবান চিন্তন প্রতিষ্ঠান এবং লবি গ্রুপগুলো জলবায়ু পরিবর্তনকে অস্বীকার করতে কীভাবে প্রচুর অর্থ ঢালছে তার বর্ণনা রয়েছে। যেমন প্রভাবশালী মার্কিন চিন্তন প্রতিষ্ঠান হার্টল্যান্ড ইনস্টিটিউটকে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে করপোরেট কোম্পানিগুলোর পক্ষ অবলম্বন করতে দেখা যায়। আর এর মূলে রয়েছে অর্থ। এক্সন মোবিল, প্রভাবশালী মার্কিন ব্যবসায়ী গ্রুপ কোচ ব্রাদার্স এবং রক্ষণশীল প্রয়াত অর্থদাতা রিচার্ড মেলন স্কেইফের কাছ থেকে হার্টল্যান্ড ইনস্টিটিউট ১০ লাখ ডলারের বেশি অর্থ গ্রহণ করেছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। এসব অর্থদাতাই বৃহদাকারে কার্বন নির্গমন করে থাকে। ক্লাইন লিখেছেন, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রভাবশালী ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্য গার্ডিয়ান’ একটি প্রতিবেদনে দেখিয়েছে, যেসব গোষ্ঠী জলবায়ুবিজ্ঞান নিয়ে সন্দেহ ছড়াচ্ছে, তাদের মার্কিন ধনকুবেরদের একটি নেটওয়ার্ক প্রায় ১০ কোটি ২০ লাখ ডলার অর্থ প্রদান করেছে।

ক্লাইন দেখিয়েছেন, যারা জলবায়ু পরিবর্তনকে অস্বীকার করছে, তারা বড় বড় পরিবেশবাদী সংগঠন বা গ্রিন গ্রুপকে প্রভাবিত করছে। যেমন পরিবেশ সংরক্ষণ আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী নেচার কনজারভেন্সি তার নিজের সংরক্ষিত জমিতে তেল উত্তোলন করছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসব পরিবেশবাদী সংগঠনের পরিচালনা পর্ষদে রয়েছে বড় বড় কার্বন নির্গমনকারী বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানির পরিচালকেরা। তাঁরাই এসব পরিবেশ সংরক্ষণ আন্দোলনের সংগঠনগুলোর কার্যক্রমের জন্য অর্থ প্রদান করছেন। এ অবস্থায় এসব সংগঠন এ ব্যবস্থা পরিবর্তনের ব্যাপারে কতটুকু জোরালো দাবি জানাতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়?

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসকারী প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে নেওয়া বেশির ভাগ প্রকল্পের ক্ষেত্রেই সাধারণত বলা হয়, এগুলো পরিবেশের ক্ষতি করবে না বা খুব কম ক্ষতি করবে। প্রকৃতির সহিষ্ণুতা অনেক বেশি এবং ছোটখাটো ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে বলে বাহানা দেওয়া হয়। যেমন আমাদের সুন্দরবনের অসুন্দর রামপাল পারমাণবিক প্রকল্পের ব্যাপারে এই রকমই বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এটি সুন্দরবনের তেমন কোনো ক্ষতি করবে না। বিশ্বে এই রকম প্রকল্প আরও অনেক হয়েছে।

ক্লাইন কিন্তু সে রকম মনে করেন না। তিনি মনে করেন, সহ্যক্ষমতা থাকলেই কি কাউকে অত্যাচার করতে হবে? ক্লাইন তাই লিখেছেন, ‘Just because biology is full of generosity does not mean its forgiveness is limitless. With proper care, we stretch and bend amazingly well. But we break too- our individual bodies, as well as the communities and ecosystems that support us.’ । যেকোনো প্রাণের স্বাভাবিক বৃদ্ধি আর সংগ্রাম করে টিকে থাকার অর্থ কি এক? স্বাভাবিক বৃদ্ধি যেখানে তার পুনরুৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি করে, সংগ্রাম করে টিকে থাকা হয়তো খুব বেশি হলে কেবল তার বেঁচে থাকা নিশ্চিত করে।

পুঁজিবাদী উন্নয়নের আরেকটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য, এটা প্রাণজগতে বিষাক্ত বর্জ্য নিষ্কাশন করে পরিবেশগত ও সামাজিক ধ্বংসোন্মাদনার দায়ভার সামগ্রিকভাবে সমাজের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। বড় পুঁজিপতিরা অনেক বেশি লাভ করতে পারে যদি শিল্পবর্জ্য দূরীকরণ, পরিশোধন বা পুনর্ব্যবহারের বিষয়টি অগ্রাহ্য করতে পারেন। তাদের কাছে বরং বিষাক্ত বর্জ্যগুলো বাতাসে বা কাছাকাছি নদীতে ঢেলে দেওয়া অনেক সস্তা ও সহজ কাজ।

৪.

বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং লিখেছেন, ‘আমার কাছে এখন সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো মানবেতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে আমাদের এই গ্রহে সম্মিলিতভাবে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। আমাদের সামনে কয়েকটি ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ এসে দাঁড়িয়েছে। সেগুলো হলো জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য উৎপাদন, জনসংখ্যার আধিক্য, নানা প্রজাতির প্রাণীর বিলুপ্তি, মহামারি রোগ, মহাসাগর দূষিত হয়ে ওঠা ইত্যাদি।’ মৃত্যুর আগে বিবিসিতে দেওয়া তিনি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মানুষের লোভ এবং মূর্খতা দায়ী।’ পরিবেশ সংকট বিভিন্নভাবে মানুষকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে কি আদৌ সিরিয়াস আমরা?

রাশকফের বইটি থেকে একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করি। তিনি লিখেছেন, ‘সমাজের মহান বিজয়ীদের সঙ্গে বসে আমদানি করা আইসবার্গ গলানো পানিতে চুমুক দিতে দিতে এবং শেষের সেদিনের নানা সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলতে বলতে উপলব্ধি করেছিলাম, তাঁরা আসলে পরাজিত, ব্যর্থ। ওই মহাধনীরা অর্থনীতির খেলায় জিতছেন না, তাঁরা সেই খেলার ভয়ংকর বিকৃত নিয়মগুলোর শিকার। আর তাই পুঁজিবাদী রাজ্যের পরাক্রম রাজা–বাদশাহরা দুর্ভেদ্য বাংকারে কিংবা সমুদ্রে ভাসমান জাহাজে অথবা মঙ্গল গ্রহে পাড়ি দেওয়ার আয়োজনে ব্যস্ত থাকার চিন্তায় মশগুল থাকাটা অবাক করার মতো বিষয়ই নয় মোটেও।

* লেখক: কলামিস্ট।

** নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]